নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট সহিংস অবরোধ কর্মসূচিকে গণদাবির প্রকাশ মনে করলেও ভাষ্যকাররা তাতে দ্বিমত পোষণ করছেন।
সহিংসতার কারণে সৃষ্ট আতঙ্কের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন সংঘাত বিশেষজ্ঞ ‘চোরা-গোপ্তা হামলাকে’ দায়ী করেছেন।
সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত সারাদেশে সহিংসতায় অন্তত ২৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ এলাকাতেই ঘটছে অতর্কিত আক্রমণ। পরিবহনে আগুন ও বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানো, নির্বাচন কমিশন অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলার মধ্যে দিয়েই কেটেছে গত সপ্তাহের ৭১ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি।
অবরোধ সহিংসতায় আতঙ্কিত হয়ে পড়া মানুষদের একজন রাষ্ট্রায়ত্ব একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা আসলাম হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যতক্ষণ আমি অফিসে বা বাসার উদ্দেশে রাস্তায় থাকি ততক্ষণ আমার পরিবারের সদস্যরা প্রচণ্ড আতঙ্কে থাকেন। আমি নিজেও আতঙ্কে থাকি। কখন বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, কখন বোমা হামলা চালানো হয়- সারাটা রাস্তাজুড়েই থাকে এ আতঙ্ক।
“তীব্র আতঙ্ক নিয়েই হরতাল বা অবরোধের দিনগুলোতে আমাদের অফিস করতে হচ্ছে।
”
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ কর্মসূচি নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় সহিংস রূপ নিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর দেশের যেসব জেলায় সহিংসতার মাত্রা বেশি ছিল, এবারের অবরোধেও ওইসব জেলাজুড়েই সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বেশি।
রাজধানীতে অবরোধ কর্মসূচিতে জোট নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়েনি, ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ জায়গার চিত্রও একই রকম।
এবারের অবরোধে যুক্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলা ও ট্রেনের বগিতে আগুন দেয়ার ঘটনা, যা সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পরের সহিংসতার সময়ও দেখা গেছে।
সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৭১ ঘন্টার অবরোধ শেষ হওয়ার পর শনিবার সকাল থেকে চলতি সপ্তাহের ৭২ ঘন্টার অবরোধও চলছে সহিংসতার মধ্য দিয়ে।
চলমান অবরোধ কর্মসূচিকে বিএনপির পক্ষ থেকে গণআন্দোলন বলে দাবি করা হচ্ছে।
বিএনপির মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদ শনিবার বিকালে এক বিবৃতিতে বলেন, “গণ আন্দোলনের তীব্রতা দেখে সরকার অতিমাত্রায় ভীত হয়ে দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, হত্যা-গ্রেপ্তারের চালিয়ে শেষ রক্ষা পেতে চায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, সব স্বৈরাচারের পতন হয়েছে গণ আন্দোলনের মুখে। ”
ঘটনার গতি-প্রকৃতি ও সহিংসতার ধরন দেখে অবরোধ কর্মসূচিকে ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করছেন সংঘাত বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডালেম চন্দ্র বর্মণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে গণের কোনো অভ্যুত্থান নেই।
যদি থাকতোও তাহলেও তা হতো ব্যতিক্রম। কারণ গণঅভ্যুত্থানে এভাবে চোরা-গোপ্তা হামলা হয় না। ”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবরোধের নামে দেশে যা হচ্ছে, এটাকে কোনভাবেই গনআন্দোলন বলা যায় না। দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি পকেটে (জায়গায়) জনবিচ্ছিন্ন, সন্ত্রাসী ও গুপ্তহত্যামূলক কর্মকাণ্ড চলছে। ”
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় সারাদেশে প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় সাড়ে ৩০০ মানুষের।
এর আগে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে রাজনৈতিক সহিংতায় প্রাণ হারিয়েছিল অর্ধশতাধিক মানুষ।
সাংবাদিক ও রাজেনীতি বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, “ঘটনার গতি-প্রকৃতি দেখে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের আগমনের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি কি না, সেটাই সন্দেহ হচ্ছে। ”
তিনি মনে করেন, এর আগে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বা ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ইট পাটেকেল নিক্ষেপ, হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। ওইসময় একটি বাসে পেট্রোল বোমাও ছোড়া হয়েছিন, কিন্তু ওই ঘটনা ধারাবাহিক ছিল না।
“কিন্তু এবারে গাড়িতে বোমা ছুড়ে বা আগুন লাগিয়ে মানুষ দগ্ধ করার ঘটনা ধারাবাহিক রূপ নিয়েছে।
পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলাও হচ্ছে। জনাকীর্ণ জায়গায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করার আধুনিক সন্ত্রাসবাদীদের যে কৌশল-সেটাই প্রয়োগ করা হচ্ছে মনে হয়। ”
সোমবার অবরোধ ঘোষণার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলছে অতর্কিত বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগ।
অবরোধের সহিংসতার আগুনে দগ্ধ, বোমা হামলা ও গাড়ি চাপায় রাজধানীতে গত ছয় দিনে কমপক্ষে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার সকাল পযন্ত ৭১ ঘণ্টার অবরোধে বেশ কয়েকটি স্থানে বোমা ফাটানো হয় ও গাড়িতে আগুন দেয়া হয়।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অবরোধকারীদের ছোড়া হাতবোমায় নিহত হয় একজন ব্যাংক কর্মচারী। শাহবাগের কাছে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হলে ১৮ জন দগ্ধ হয়, যাতে এখন পযন্ত মারা গেছে ২ জন। শনিবার মালিবাগে পেট্রোল বোমা আক্রান্ত বাস চাপায় একজন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে।
এই ঘটনার মামলায় অজ্ঞাতনামা দু’তিনজনকে আসামিকে করা হয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচে র্যের দায়িত্ব পালনরত হারুন-অর-রশীদ বলেন, “একটি গণআন্দোলনের মাপকাঠি হচ্ছে, রাজধানীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে কী না।
এবারের আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নেই।
“অংশগ্রহণ না করার অন্যতম কারণ- বর্তমানে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের ড্রাইভিং ফোর্স জামায়াত শিবিরের নিজস্ব এজেন্ডা হলো যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। যেহেতু দেশের বেশিরভাগ মানুষ এরসঙ্গে একমত নয়, তাই তারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে না।
“এছাড়া রাস্তায় নেমে গণ-আন্দোলনের জন্য মানুষের মনে যে ধরনের ক্ষোভ দরকার হয় তাও এখানে অনুপস্থিত। বিরোধীদল একবার নির্দলীয় সরকার আর একবার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাচ্ছেন।
তাই মানুষও এ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে না। ”
মানুষকে অগ্নিদগ্ধ ও বোমা মেরে হত্যার চিত্র দেখেও সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছেন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক এ অধ্যাপক।
বগুড়া, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে গত ফেব্রুয়ারির সহিংসতায় বগুড়ায় ১০ জন, সাতক্ষীরায় নয়জন, সিরাজগঞ্জে তিনজন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনজন করে নিহত হয়েছিল।
অবরোধের সহিংসহতায় এবারো অস্থির হয়ে উঠেছে এসব জেলা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়ায় অবরোধের সহিংসতায় নিহত হয়েছেন একজন।
নির্বাচন কমিশন অফিসে মুখোশধারীরা বোমা হামলা চালিয়েছে। জেলার ছাতিয়ানে ৭২ ফুট রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়। আজিজুল হক কলেজে মৌন মিছিলরত একদল শিক্ষকের ওপর বোমা হামলা করা হয়।
জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরায় অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন চারজন।
এবারের অবরোধেও অশান্ত হয়ে উঠেছে জামায়াতের আরেক ঘাঁটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সোমবার রাতে শহরে বিজিবির গাড়ি লক্ষ্য করে হাতবোমা ছোড়া হলে এক বিজিবি সদস্য আহত হন। বুধবার অবরোধকারীদের হামলায় আহত হন পুলিশের এক এসআইসহ দুই পুলিশ সদস্য।
অবরোধের সহিংসতায় এক পথচারীসহ সিরাজগঞ্জে অন্তত তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুস সোবহানসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের জন্মস্থান বৃহত্তর পাবনার এই অংশে মঙ্গলবার গভীর রাতে রেললাইন কেটে ফেলায় সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
রাজশাহী: সাঈদীর ফাঁসির আদেশ ঘিরে সহিংসতায় রাজশাহীতে নিহত হয়েছিলেন তিনজন।
এবারের অবরোধেও রেললাইনে নাশকতাসহ নানা ধরনের সহিংসতা চলছে সেখানে।
কুমিল্লা: সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর অশান্ত হয়ে ওঠা কুমিল্লায় এবার সহিংসতা আরো তীব্র হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এক বিজিবি সদস্যসহ তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। বুধবার রাতে রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ফেলায় কুমিল্লার অশোকতলায় উদয়ন এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়।
চট্টগ্রাম: সহিংসতার জন্য জামায়াত-শিবিরের শক্ত জায়গা চট্টগ্রামে হত সপ্তহের অবরোধে নিহত হয়েছেন দুজন।
সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জামায়াত-শিবির নাশকতা চালায়। অবরোধের মধ্যেও তা অব্যাহত রয়েছে। সাতকানিয়াতেও গত কয়েকদিনে সহিংসতা ও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর চট্টগ্রামে নিহত হয়েছিলেন পাঁচজন।
কক্সবাজার: কক্সবাজারের চকোরিয়ায় শুক্রবারে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন একজন।
অবরোধের কয়েকদিন আগেই কুতুবদিয়ায় সহিংসতায় একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করেও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কক্সবাজার। ওইসময় দুই জন নিহত হয়েছিলেন।
জয়পুরহাট: সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর জয়পুরহাটে সহিংসতায় ছয়জন নিহত হয়। এবারের অবরোধেও সহিংস রূপ ধারণ করে জয়পুরহাট।
বুধবার ভোরে উড়ি-মাধবপাড়া এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়। ওইদিনই সদরথানা প্রাঙ্গনে দুটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সাইদীর ফাঁসির আদেশের পর অশান্ত হয়ে ওঠা পাবনা, নোয়াখালী, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধা, নাটোর, রংপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর, লালমনিরহাট ও সিলেটসহ একাধিক স্থানে এবারের অবরোধে বোমা হামলা, পুলিশের ওপর হামলা, রেল লাইনে নাশকতাসহ নানা ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়া গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল, রাজবাড়ি, পটুয়াখালী, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জেও সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
হারুন-অর-রশীদ বলেন, “আমরা দেখছি, গত কিছুদিন ধরে সহিংসতা হচ্ছে দেশের কয়েকটি পয়েন্টে।
কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। ”
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, “বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে বলে দাবি করে তারা। তবে তাদের (বিএনপি) ডাকা গণ-আন্দোলনে জামায়াত শিবিরের প্রাধান্য দেখছি আমরা। এতে সন্দেহ হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরের জঙ্গি সংগঠন এসব ঘটনায় অংশ নিচ্ছে কী না।
”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।