আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষ ভরসা কূটনৈতিক তৎপরতা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি পর্যালোচনাও করছে বিশ্বসম্প্রদায়। পর্যালোচনার পরই সিদ্ধান্ত হবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা হবে কিনা। উন্নয়ন সহযোগী, দেশ ও সংস্থাগুলোর সবাই চাচ্ছেন 'অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ' নির্বাচন। সহিংস পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানানো হয়েছে বড় জোট ও দেশগুলোর পক্ষ থেকে। ঢাকায় আবাসিক কূটনীতিকরা সংকট নিরসনে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন।

তারা বৈঠকের পর বৈঠক করে চলেছেন সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে। তাদের বাইরেও প্রভাবশালী দেশ ও জোটের পদস্থ কর্মকর্তারা পরিস্থিতি সরাসরি পর্যবেক্ষণের জন্য আসার সূচি নির্ধারণ করেছেন। পরপর ঢাকা সফরে আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং, জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ও ব্রিটিশ দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সিনিয়র পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাঈদা ওয়ার্সি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কয়েকজন পার্লামেন্টারিয়ানেরও সফরের প্রস্তুতি রয়েছে। এর মধ্যে তারানকো আসছেন সংকট সমাধানে সরাসরি মধ্যস্থতা করতে।

আর যুক্তরাজ্য ও ভারতের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ সরকারের মনোভাবের কথা জানাবেন। ইউরোপের পার্লামেন্টের সদস্যরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবেন নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষণ পাঠানো হবে কিনা।

কূটনৈতিক সূত্রের তথ্যানুসারে, প্রতিবেশী ভারত ও প্রভাবশালী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য প্রায় সব দেশের পক্ষ থেকে সরাসরি সমর্থন দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের উদ্যোগের প্রতি। দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকার দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকে তারানকোর সফরের প্রতি সমর্থনের কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ ডিসেম্বর চার দিনের সফর শুরু করবেন তারানকো।

তার সফরে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে। কারণ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন মনে করছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন সীমায় চলে গেছে যে এই সংকট নিরসনের জন্য আর নষ্ট করার মতো সময় নেই। তারানকোর এই সফর নিয়ে নির্ধারণ হওয়ার পর ঢাকায় আবাসিক পশ্চিমা কূটনীতিকরা দুই দফায় বৈঠকও করেছেন। তারা নিজেদের মধ্যে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুই দফায় বৈঠক করেছেন। জানতে চাইলে জার্মান রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনজে শুক্রবার বলেছেন, রাজনৈতিক মতভেদ দূর করে শান্তি বজায় রাখতে তারানকোর উদ্যোগের সফলতা কামনা করে জার্মানি।

এই উদ্যোগের সঙ্গে জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নও পাশে থাকবে। অপরদিকে, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা দেশে আসবেন। গতকাল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে ঢাকার ইউরোপিয়ান নিউনিয়নের প্রতিনিধি দলের প্রধান ইউলিয়াম হানা বলেছেন, পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন রাষ্ট্রদূত হানা। এর বাইরে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ ডিসেম্বর আসবেন তাদের সিনিয়র পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাঈদা ওয়ার্সি।

জানা যায়, ঢাকায় বিভিন্ন দেশের তৎপরতার মধ্যে সর্বাধিক সক্রিয় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ইতোমধ্যেই সফর করে গেছেন দেশটির পররাষ্ট্র বিষয় সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার করে গেছেন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। এখন ভারতের সমমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে ৪ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে আসছেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। তিনি ঢাকার শীর্ষ মহলে ভারতের বার্তা পেঁৗছাবেন বলে জানা গেছে।

অপরদিকে, ঢাকার কূটনীতিকরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে তাদের বৈঠক অব্যাহত রেখেছেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থেকে সরাসরি মাঠে তৎপর আছেন তিন কূটনীতিক। রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনার নেতৃত্বে কাজ করছেন ঢাকায় দ্বিতীয় শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিক ড্যানিলুইজ এবং রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক কাউন্সিলর পুস্পিন্দর ধিলন। মোজেনা গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজসহ বৈঠক করেন। যদিও এই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পর পদত্যাগ করেন তৌফিক-ই-ইলাহী।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে তৌফিক-ই-ইলাহীও আছে মাঠে। এ ছাড়া সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে আসা পুস্পিন্দর ধিলন বুধবার দীর্ঘ বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। মির্জা ফখরুল এই বৈঠক করার আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তারপর কূটনীতিকের বাসায় এসেছেন। আবার শুক্রবার ড্যানিলুইজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরী ও বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী ওসমান ফারুক। সূত্র জানায়, রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।

তিনি আনুষ্ঠানিক একটি আলোচনার সব সুযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে চলেছেন। অন্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন মোজেনা। বিশিষ্ট নাগরিকদের রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার বিষয়েও বিদেশি কূটনীতিকদের একটি নেপথ্য ভূমিকা আছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষেও বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও বোন শেখ রেহানা সম্প্রতি ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

সেখানে কী কথা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি ভারতীয় হাইকমিশনার। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার সাক্ষাৎ করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গতকাল ইসিতে গিয়েছিলেন ইইউ আবাসিক প্রতিনিধি উইলিয়াম হানা। সাক্ষাৎ শেষে হানা বলেছেন, 'আমরা পর্যবেক্ষক নিয়োগ বিষয়ে কী করতে হবে এবং এর কারিগরি বিষয়গুলো নিয়ে সিইসির সঙ্গে আলোচনা করেছি। এখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি।

তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের বিষয়েও জোর দেন তিনি। আমি সিইসিকে জোর দিয়ে বলেছি- আমরা স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সহায়তা করতে চাই। ' ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই)-এর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারা বাংলাদেশের আগের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিচ্ছে।

কারণ ২০০৬ সালে বিএনপি জোটের সরকারের অধীনের নির্বাচন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত ছিল আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তখন পর্যবেক্ষণ করেনি ইইউ, কমনওয়েলথ, এনডিআই, আইআরআই ও ইডবি্লউজি। বিরত থাকার কারণ হিসেবে ইইউ বলেছিল, 'জনগণের অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইইউসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা সফল হয়নি। এ প্রেক্ষিতে এবং সব কটি প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ইওএমের (নির্বাচন পর্যবেক্ষণ) কার্যক্রম আশানুরূপ ফল বয়ে আনবে না।

এ কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ইওএমের কার্যক্রম স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। '

চলছে তারানকোর সফরের প্রস্তুতি : অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফরের জন্য প্রস্তুতি চলছে। আগামীকাল তার সফর সূচি চূড়ান্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নির্বাচন কমিশনসহ সুশীল সমাজের সঙ্গে তারানকোর সাক্ষাতের পরিকল্পনা অনুসারে সবার কাছে সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছে ঢাকার জাতিসংঘ দফতরগুলোর আবাসিক সমন্বয়কারী। এ ছাড়া জাতিসংঘ কর্মকর্তার পাশাপাশি মহাসচিব বান কি-মুনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তারানকো আসবেন উল্লেখ করে দুই নেত্রী ও নির্বাচন কমিশনের কাছে বান কি-মুনের চিঠি পেঁৗছে দিয়েছেন আবাসিক সমন্বয়কারী নিল ওয়াকার।

এই চিঠিতে বিশেষ দূতকে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়েছেন বান কি-মুন। গতকাল ঢাকার জাতিসংঘ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী ৬ ডিসেম্বর শুরু হওয়া চার দিনের এই সফরে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, জাতীয় সংসদের স্পিকার, ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিক, সুশীল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স দফতর থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, মূলত রাজনৈতিক সংলাপে উৎসাহ প্রদান এবং আলোচনার মাধ্যমে আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো চার দিন বাংলাদেশ সফর করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধানে এ বছরের মে মাসে সহকারী মহাসচিব তারানকোর বাংলাদেশ সফরের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবেই এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

 

 




এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।