বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আর যা-ই হোক, স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করা যায় না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পর সারা দেশে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, সারা দেশে যে ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তাতে কেবল যে উদ্বেগ, আশঙ্কা, আতঙ্ক ও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে তা-ই নয়, অনেকেই এ প্রশ্ন তুলছেন যে এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে কি না। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে অসহায়ত্বের বোধ ছড়িয়ে পড়েছে, নিরাপত্তাহীনতা এখন সমাজের সর্বস্তরে। যাদের পরিবার-পরিজনের প্রাণনাশ হয়েছে, তাদের মানসিক অবস্থার কথা বর্ণনা করার চেষ্টা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাদের ক্ষতি কোনো বর্ণনাতেই তুলে ধরা সম্ভব নয়। দলীয় অন্ধ বিবেচনার বাইরে দাঁড়িয়ে যে সাধারণ মানুষ এ পরিস্থিতিতে কথা বলছ, তাদের কণ্ঠস্বরকে আর্তনাদের মতোই শোনাচ্ছে।
আর কত মানুষের মৃত্যু, আর কত মানুষের অগ্নিদগ্ধ শরীর, আর কত ধ্বংসযজ্ঞের পর সরকার ও বিরোধী রাজনীতিবিদেরা বুঝতে পারবেন যে এর অবসান দরকার? এ প্রশ্নই এখন সাধারণ মানুষের
মনে। ক্ষমতার রাজনীতির পৃথিবী কি এতটাই অন্ধকার যে সেখানে জীবিত ও মৃত মানুষের মধ্যে ফারাক করা যায় না? সেই অন্ধকারে লাল রক্তের ধারা কি অদৃশ্য হয়ে যায়? সেই পৃথিবীতে কি মৃত মানুষের আর্তনাদ, জীবিতের আহাজারি কারও কানেই পৌঁছায় না?
সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু গত কয়েক দিনের পরিস্থিতি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এখনকার অবস্থা আগের কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে আর তুলনীয় নয়। কয়েক বছর ধরেই রাজনীতিতে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং এ বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডব ও নির্বিচার আক্রমণ তা আগের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু গত কয়েক দিনের ঘটনা এর চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের কর্মী ও সমর্থকদের নেতৃত্বে সারা দেশে তৈরি হয়েছে এক ভয়াবহ অবস্থা।
সরকারের পক্ষ থেকে তা মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে যে সহিংসতার প্রকৃতি, মাত্রা ও পরিসরে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, যা মানবিক বিবেচনায় যেমন, তেমনি রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিবেচনায়ও সবার মনোযোগ দাবি করে। তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাগিদ থেকে এ লেখা। প্রথমত, সহিংসতা ক্রমেই ভৌগোলিকভাবে বিস্তার লাভ করছে। অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়, সেটা ১৯৯৪-১৯৯৬ কিংবা ২০০৬ সালেও সহিংস ঘটনা কার্যত বড় বড় শহরকেন্দ্রিক ছিল।
কিন্তু এখনকার ঘটনাবলি কেবল নগরকেন্দ্রিক নেই; গত এক মাসের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের দিকে তাকানোই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল হিসেবে কেবল আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ওপরই নির্ভর করা হচ্ছে। তাতে করে এসব সহিংতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা। সহিংসতার এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়, তবে তা রাষ্ট্র ও একদল মানুষকে মুখোমুখি করে তুলবে কি না, সেটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার বদলে শক্তি প্রয়োগের ধারায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধীরা কয়েক কদম এগিয়ে আছে।
কিন্তু তাদের এ পদক্ষেপ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলছে কি না, তারা কি সেটা ভেবে দেখেছে? গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়লে গণতন্ত্রের প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে, সরকারের অনমনীয়তা এবং মূল রাজনৈতিক কারণের দিকে দৃষ্টি না দেওয়ার নীতির সম্ভাব্য পরিণতির বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কতটা মনোযোগী, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এই আশঙ্কা কি অমূলক যে এখন অবস্থা যা, তার আরও অবনতির অর্থ হবে যে দেশজুড়ে এক ‘অসম সংঘাতের’ (এসিমেট্রিক্যাল কনফ্লিক্ট) তৈরি হওয়া? যেকোনো ধরনের অসম সংঘাতের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টে শক্তিশালী ও বৃহৎ শক্তি যদিও মনে করে যে তার বিজয় নিশ্চিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ঘটে না। কিন্তু তাতে রক্তক্ষয় ও প্রাণনাশের সংখ্যাই কেবল বাড়ে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এ সহিংসতার রূপ দেখে মনে হয় যে তা দেশে ‘সহিংসতার কুটিরশিল্প’ তৈরি করে দিচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহে সহিংসতায় ব্যবহূত বোমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক যে দেশের ভেতরে তৈরি, সেটার একটা ইতিবাচক দিক হলো, এখনো তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, এগুলো তৈরির একধরনের শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে এবং একে কেন্দ্র করে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। কোনো দেশে এ ধরনের একটা সহজ বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হলে এবং তার অনুকূল পরিবেশ থাকলে তা একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বাধ্য। আজকে যারা এ কাজে উৎসাহ জোগাচ্ছে, কাল তাদের প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে এ কৌশল ব্যবহার করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভবিষ্যতে তা যে রাজনীতির বাইরে বিস্তৃত হবে না, সে নিশ্চয়তা কে কাকে দিচ্ছে?
তৃতীয়ত, এই যে সহিংসতা, তা কি কারও নিয়ন্ত্রণের ভেতরে আছে? আজকে বিরোধীরা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও হয়তো বলতে পারে যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেই এর অবসান হবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, এ সহিংসতা শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের হাতে না-ও থাকতে পারে।
কেননা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সহিংসতার মাত্রা বাড়বে এবং তা নতুন নতুন রূপ নেবে। এতে করে এর ওপর এমন শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বিরোধী দলের যেমন তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারকেও তা অনুধাবন করতে হবে। একটি নির্বাচনই গণতন্ত্র ও রাজনীতির শেষ কথা নয়।
রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ সহিংসতার পথে দেশ ইতিমধ্যে এগোতে শুরু করেছে, তার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
এ পরিস্থিতির অবসান কেবল রাষ্ট্রশক্তি বা রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয়ের আশায় বসে থাকলে হবে বলে মনে করার কারণ নেই। এ জন্য ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অহিংস নৈতিক শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। তাদের মধ্য থেকেই এ দাবি সামনে রেখে সমবেত হতে হবে যে আমরা শান্তি চাই, আমরা ক্ষমতার লড়াইয়ে পড়ে আর মরতে চাই না। তাদের নৈতিক চাপ প্রয়োগ করা দরকার বিরোধীদের ওপরে যেমন, তেমনি সরকারি দলের ওপরেও।
অহিংস নৈতিক শক্তির দরকার বাংলাদেশে, যা এর আগে এত বেশি করে আর কখনোই অনুভূত হয়নি।
আলী রীয়াজ: পাবলিক পলিসি স্কলার, উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।