সত্য পথের অনুসন্ধানি
বাংলাদেশের সংবিধানে "দ্বাদশ সংশোধনী-১৯৯১" এর মাধ্যমে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হয় "৭০ অনুচ্ছেদ"। বহুল আলোচিত, বিতর্কিত এই বিধান নিয়ে পত্র পত্রিকায় ব্যাপক আলোচনা হয়েছে ইতিমধ্যে। নিজের বিবেক অনুযায়ী ভোট দেয়া মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও ৭০ অনুচ্ছেদ মতে একজন সংসদ ভোট দিবেন দলের ইচ্ছানুযায়ী।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন এসে যায় -একজন সংসদেরই যেখানে সুস্থ গণতান্ত্রিক অধিকার নেই সেখানে সাধারণ জনগন কিভাবে অবাধ ভোটাধিকারের স্বপ্ন দেখে ? অবাধ নিরপেক্ষ ভাবে জনগণ যদি ভোটাধিকার প্রয়োগও করে তাতেও কি লাভ? শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আমরা যাকে নির্বাচিত করছি "আলাদা ব্যক্তিত্ব এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট" দেখে তিনি তার সেই স্বাধীনচেতা মনোভাব সংসদের ভোটাধিকারে দেখাতে পারছেন না। দলীয় অথবা দল নেত্রীর অগনতান্ত্রিক এবং একনায়ক সুলভ কার্যাবলীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারে এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে পারে তার জন্যই ভোটাররা তাকে নির্বাচিত করে।
ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী এই আইন বাংলাদেশের অনেক সমস্যার সুতিকাগার হিসাবেও আমরা দেখতে পাই।
পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের সময়ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে এখানে দলগত অথবা সংসদদের নিজেদের ব্যক্তিগত চাওয়াটা প্রতিফলিত হয়নি।
এই আইনের কারনে আমরা এর আগেও দল নেত্রীদের এক নায়ক সুলভ আচরণের ভুরি ভুরি প্রমাণ পাই। সর্বশেষ এরশাদের একক সীদ্ধান্তে কয়েকদিনের মাথায় তার দলের মন্ত্রীদেরকে অনিচ্ছা সত্বেও ঘরে ফিরে যেতে হয়েছে। (তাদের অনিচ্ছার ব্যাপারটা পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য এবং তাদের বড়ি ল্যাংগুয়েজ এবং সার্বিক আচরণের কারণে তৈরী হওয়া পারচেপশন থেকে বলা)
সংবিধানে সন্নিবেশিত ৭০ অনুচ্ছেদটা একটু দেখে নিই:
৭০।
(১) কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।
ব্যাখ্যা। - যদি কোন সংসদ-সদস্য, যে দল তাঁহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া-
(ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা
(খ) সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন,
তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।
(২) যদি কোন সময় কোন রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উঠে তাহা হইলে সংসদে সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বের দাবীদার কোন সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে অবহিত হইবার সাত দিনের মধ্যে স্পীকার সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী উক্ত দলের সকল সংসদ-সদস্যের সভা আহ্বান করিয়া বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত দলের সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করিবেন এবং সংসদে ভোটদানের ব্যাপারে অনুরূপ নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ যদি কোন সদস্য অমান্য করেন তাহা হইলে তিনি (১) দফার অধীন উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।
তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।
(৩) যদি কোন ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার পর কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন, তাহা হইলে তিনি এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে উক্ত দলের প্রার্থীরূপে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
আইনটি কতটা কঠোর ভাবে তৈরী করা হয়েছে তা সহজে বোধগম্য। এমনকি উপদল গঠন করে যদি সংখ্যাগরিষ্ট অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে উপদলের সবারই সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ না থাকলে আমার মনে হয় না জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা এরশাদের কথায় পদত্যাগ করতেন। এখন দলীয় প্রধানের কথা না মানলে সংসদ সদস্যপদও থাকে না তাই তারা অনিচ্ছা সত্তেও পদত্যাগ পত্র নিয়ে এ ঘর ও ঘর দৌঁড়াচ্ছেন।
সামাজিক মর্যদার জায়গা থেকে দেখলেও তাদের এত সহজে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করার সীদ্ধান্তটা সহজ নয়। কারণ শপথ নেয়ার ব্যাপারটি ছেলে খেলা নয়। অথচ দলীয় প্রধান কোন ধরণের টাইম লাইন না দিয়ে জাপার মন্ত্রীদেরকে একটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে এবং সেই বিব্রতকর অবস্থা তাদেরকে মেনে নিতেও হচ্ছে এই ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে। এরশাদ নির্বাচনে যাওয়ার সীদ্ধান্তটা অনেক সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে নিয়েছেন ;কিন্তু তার সরে আসার সীদ্ধান্তটা কোন আল্টিমেটাম না দিয়েই। এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার সীদ্ধান্ত নিলে হয়ত সরকারীদলও ভিন্ন ভাবে ভাবতো ; নির্বাচন কমিশনও সিডিওল ঘোষনা করত না , এত লোকও মরত না হয়ত।
এরশাদের নির্বাচনে যাওয়ার সীদ্ধান্তটা সরকারকে নির্বাচনে আগ্রহী করে তুলেছ। বলা যায় এরশাদ সরকারকে ইনসিষ্ট করেছে বিএনপি ছাড়া নির্বাচন করা যেতে পারে সে সীদ্ধান্ত নিতে।
এরশাদ/ খালেদা জিয়া /শেখ হাসিনা এই তিন জনের মধ্যে যে একধরনের এক নায়ক এবং একক ডিসিশন নেওয়ার মনোভাব তৈরী হয়ছে সেটা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণেই। কারণ কোন অবাধ্য সংসদ সদস্য তাদের দেখতে হয় না কখনো।
আমার জানা নেই এরশাদ কর্তৃক সর্বদলীয় সরকারে যাওয়া এবং নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টা তার দলের দলীয় সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যদের মাধ্যমে নেয়া রেজুলেশন সম্মত কিনা? তেমনি ভাবে জানতে পারিনা নির্বাচন থেকে সরে আসার সীদ্ধান্তটা সর্ব সম্মত কিনা? সরে আসার সীদ্ধান্তটা যে একক সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় তার দলের প্রেডিয়ামের ৭ জন সদস্য যারা মন্ত্রীসভায় তারাও এই খবর জেনেছেন গণমাধ্যম থেকে।
এটাই কি আমাদের গণতন্ত্র? এটাইকি আমাদের রাজনৈতিক দল গুলার আভ্যন্তরিন গনতন্ত্র ? দলের মধ্যে নুন্যতম গণতন্ত্র না থাকা দল গুলাকে নির্বাচিত করিয়ে আনার জন্য এত তোড় জোড় এবং এত অবাধ নির্বাচনের আয়োজনেরই বা কি ফায়দা? যেখানে সংসদ সদস্যের নিজেরই স্বাধীন এবং অবাধ ভোটাধিকারের সুযোগ নাই!!
আফসুস হয় - ৯০ এর গণআন্দোলের পরাজিত শক্তির আস্ফালন যেমন আমাদের এখনো দেখতে হয় তেমনি ৭১ এর পরাজিত শক্তিরও দেখতে হয় রণ হুন্কার। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা আসলে কাউকে পরাজিত করতে পারি নাই বরং নিজেরাই পরাজিত হতে শিখেছি। সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ বলবৎ থাকলে আমরা আরো পরাজয় দেখবো । দেখবো গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারের আবরণে "এক নায়ক তন্ত্র"। দেখতে হবে কেন বলছি, দেখতে দেখতে ক্লান্ত শ্রান্ত ও বিধস্ত।
আরো পড়ুন: তত্বাবধায়ক যে কারণে সমাধান নয় সম্ভবও নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।