সবুজ এক উপত্যকায় কুনু গ্রাম। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের ধারা। কুনুর মাথার উপর দিয়ে তাকালে নজরে পড়ে সবুজ পাহাড়।
খুব বেশি হলে কয়েক শ’ মানুষের বাস ছিল কুনুতে। ছোট্ট কুঁড়েঘরে বাস করত তারা।
কুঁড়েগুলো দূর থেকে দেখলে মৌচাকের মতো লাগত। কাঁদামাটি দিয়ে তৈরি দেয়াল। মাঝখানে কাঠের লম্বা খুঁটি। তার উপর খড়ের পাতলা চালা। নিচ থেকে মাটি উঠিয়ে নিজেদের কলোনিতে পিঁপড়েরা যে শক্ত ঢিবি বানিয়ে রাখত, কুনু গাঁয়ের কুঁড়েগুলোর মেঝে ছিল ওই উইঢিবি দিয়ে তৈরি! আর মেঝে ঝকঝকে রাখতে গোবর দিয়ে নিয়মিত লেপা হত।
সেই গ্রামে আমার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই।
ঘরের ভেতর আখা জ্বলত। খড়ের চালা দিয়ে দিব্যি বের হয়ে যেত আখার ধোয়া। আর দরজা ছিল খুবই ছোট। মাথা নুইয়ে ভেতরে ঢুকতে বা বাইরে বেরুতে হত।
কুঁড়েঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থাকত। গ্রামে কোনো রাস্তাও ছিল না। তবে ঘাস মাড়িয়ে পায়ে হাঁটার সরু পথ ছিল।
কুনু গাঁয়ের চারপাশে কোনো বড় গাছও ছিল না। তবে কুনুর মাথার উপর দিয়ে তাকালে দূরে সরু লম্বা কিছু গাছ চোখে পড়ত পাহাড়ের গায়ে।
খাবারের তালিকায় ছিল মেইজ, পশ্চিমারা যাকে ভুট্টা বলে থাকে। খাদ্য তালিকায় আরও ছিল মটরশুটি আর কুমড়া। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার বলেই আমরা এগুলো খেতাম এমনটা নয়। আমাদের এগুলোর বেশি কিছু খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে বড়লোক যারা ছিলেন, তাদের খাবারের তালিকায় এর বাইরে থাকত বড়জোর চা, কফি আর সুগার।
অবশ্য কুনুর বেশিরভাগ মানুষের জন্য সে সবই আকাশকুসুম কল্পনা।
রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা আর সেঁচের জন্য দরকারি জলের উৎস ছিল খাল-বিল আর ডোবা-নালা। এসব ছিল নারীদের কাজ। আসলে কুনু ছিল এক রকম নারী ও শিশুদের গ্রাম।
পুরুষেরা দূরে খনিতে কাজ করত।
বছরে বড়জোর দুবার তারা গ্রামে আসত, তাও শুধু লাঙ্গল দিতে। নিড়ানি, আগাছা পরিষ্কার আর ফসল কাটার দায়িত্বটা চাপত নারীদের ঘাড়ে। পড়তে বা লিখতে জানত, এমন লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। অনেকেই মনে করত, পড়াশোনা আসলে ভিনদেশি কূটকৌশল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে ছিল দুটো প্রাইমারি স্কুল।
আমার মা তিনটা কুঁড়েঘরের নেতৃত্ব দিতেন। তিন কুঁড়েঘরের সব বাচ্চাকাচ্চা মিলিতভাবে এমন চিৎকার-চেঁচামেচি করত। সে সব যেন এখনও কানে বাজে! একলা কাটিয়েছি-- এমন একটি দিনের কথাও মনে পড়ে না আমার।
আফ্রিকার সংস্কৃতিতে চাচা-চাচিরা ভাইয়ের ছেলে নয়, নিজের ছেলে হিসেবেই পালিত হয়। এমনকি সৎ ভাই বা সৎ বোন বলেও কিছু ছিল না আমাদের সংস্কৃতিতে।
আমার মায়ের বোন আমার কাছে মা, আমার চাচার ছেলে ছিল আমারই ভাই। আমার ভাইয়ের সন্তান মানেই আমার সন্তান; আমার ছেলে বা আমার মেয়ে।
আমাদের তিনটা ঘরের মধ্যে একটা ছিল হেঁসেলঘর, একটা শোবারঘর আর একটা গুদামঘর। শোবারঘরে বিছানা বা অন্য কিছু ছিল না। আমরা মেঝের উপর মাদুর পেতে ঘুমাতাম।
বসতাম মেঝেতেই। এমনকি ঘুমানোর জন্য বালিশও ছিল না।
খোলা আগুনের উপর তিন-পায়ার একটা লোহার পাত্রে রান্না করতেন মা। আমরা যা খেতাম, সবই ছিল নিজেদের চাষ করা। বেশি চাষ করা হত ভুট্টা।
ভুট্টা থেকে মূলত রুটি বানানো হত। এছাড়া গরু-ছাগলের দুধেরও অভাব হত না।
মায়ের পিঠে ঝোলার ভেতর সেই আমি ছিলাম মানিক-রতন। ছোটবেলা থেকেই বেশিরভাগ সময় কাটাতাম খেলাধুলা করে, আমার বয়সী বালকদের সঙ্গে কুস্তি করে। রাতে ওদের সঙ্গেই খেতাম, একই কম্বলের নিচে ঘুমাতাম।
পাঁচ বছরে হলাম ‘পাল-বালক’। পাল-বালক মানে ভেড়া আর বাছুরের পাল দেখাশোনা করে যে।
শিখলাম গুলতি দিয়ে কী করে উড়ন্ত পাখি মারতে হয়। শিখলাম বন্য মধু আর ফল সংগ্রহ করা, আর সরাসরি গরুর দুধ দুইয়ে গরম গরম খেয়ে ফেলা। শিখলাম বিলে সাঁতার কাটা আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরা।
প্রেমে পড়ে গেলাম কুনুর খোলা হাওয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। আবিষ্কার করলাম, ঈশ্বরের আশীর্বাদ, সুখের স্বর্গ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।