আমরা এমন একটা পরিবেশ চাই, যেখানে শিশুরা তাদের পছন্দ-অপছন্দের ধাপগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে বড় হবে।
===ফয়সল সাইফ===
ছোটবেলার প্রায় মানুষই জানতে চাইত- বড় হয়ে জীবনের লক্ষ্য কী? বন্ধুদের প্রায় সবাইকে বলতে শুনেছি- কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, কেউ ঊড়োজাহাজ চালাতে চায়, কেউ বড় ব্যবসায়ী হতে চায়। কিন্তু আমি যা হতে চাইতাম- তা কারো কাছে বলতাম না। সেটা বলার মতো ছিলও না। একদিন বড় ভাইয়াকে বলেছিলাম।
শুনে তিনি আমার গালে কষে একটা চড় মেরেছিলেন। গজ গজ করে বলেছিলেন-
হারামজাদা তুই জুয়াড়ি হবি?
সেদিন গালটা লাল করে যে মুখ বন্ধ করেছিলাম, আজ পর্যন্ত এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলিনা। তবে, হ্যা- এখনো আমার অভিন্ন লক্ষ্য- একজন চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, জুয়ারী হব।
একেবারে প্রথম দিন থেকে, স্কুলে যাওয়া কখনোই আমার ভাল লাগেনি। প্রথম কয়েক বছর তো স্কুল নিয়ে এত আতংকিত ছিলাম, যে সেখানে গিয়ে বসতেই কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম।
ফল হয়েছিল ভাল; ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ি। আর এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানে, কাজ উদ্ধার। পড়ালেখায় তেমন মনযোগ নেই। কেউ খুব একটা প্রত্যাশা নিয়ে চাপাচাপিও করে না।
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই, স্কুল ফাঁকি দিয়ে- এলাকার কিছু লেজপড়া মেরুদন্ডহীন ছাগলের আশপাশে বসে, এর-ওর গল্প শুনতাম।
কে কীভাবে কাকে মারল, কে কোথায় কাকে ধরল। কখনো শুনেছি জালু গুন্ডা চাঁদা না পেয়ে সিনেমায় তালা দিয়েছে। গর্জে বলেছে- রে, হারামজাদারা- যা এইবার তোদের সব বন্ধ। আর সত্যি সত্যিই সব বন্ধ।
বয়স যখন চৌদ্দ- আমি ভাবি, সিনেমার দরজায় তো আমার সেই প্রভাব নেই।
চাঁদার জন্য তালা মারব দূরের কথা; সাথে দুজন নিয়ে ফ্রি একটা সিনেমাও তো দেখতে পারি না।
মনে প্রশ্ন জাগে, জালু গুন্ডা কীভাবে এমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে?
কয়েক দিনের মধ্যেই জানতে পারি, অহরহ গন্ডগোল পাঁকিয়ে।
আমি সিদ্ধান্ত নেই- আমারও সেই পথ ধরতে হবে। তারপর অনেক দিন গন্ডগোল ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু নেই। মানুষের সাথে ভাল করে কথা বলা, একদম পরিহার করি।
কর্কশ স্বর ছাড়া মূখ দিয়েও কিছু বের হয় না। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমার আচরণ রুক্ষè হয়ে উঠে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রুক্ষè আচরণ করি- আমার মায়ের সাথে।
একদিকে আমার প্রতি মায়ের ভালবাসা আর অন্যদিকে তাঁর সাথে আমার খারাপ আচরণ। ফলে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া আসে না।
আমার জন্য পরিস্থিতিটা অনুকূল হয়ে যায়।
দেশের ১৪-১৫ কোটি মানুষের মধ্যে যাঁরা রাজনীতি করে, তাঁরা সবাই গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক। আর সাধারণ মানুষ এই সৈনিকদের সময়-সুযোগমতো জিম্মি করার উপকরণ। এমন পরিস্থিতিতে আমিই বা কেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক হব না?
মাঝে মাঝেই, বিরোধীদল গণতন্ত্র বাঁচাতে দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। যা আমার জন্য পরিস্থিতিটা আরো অনুকূল করে তুলে।
এই হরতাল অমান্য করে বেরসিক দেশবাসী ঠিকই দোকানপাট খুলে বসে। স্থানীয় প্রভাবের জন্য দোকানদার-দেরকে দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্যও করা যায় না। তবে, মহাসড়কের দূরযাত্রার গাড়ীঘোড়া সব বন্ধ। কথা থাকে, এসব গাড়ী রাস্তায় চললেই আটকে ভাঙচুর করতে হবে।
বেশি ছোট বলে, এই ভাঙাভাঙির কাজে আমার ডাক না পড়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু নিজে থেকে সুযোগ নিতে অসুবিধা কোথায়। ইতিমধ্যে শুনেছি, আমার বয়সী না হলেও- কয়েক বছরের বড় অনেকেই দলবল নিয়ে জায়গায় জায়গায় গাড়ী আটকে- ভাঙচুরে না গিয়ে, চাঁদা আদায় করে ছেড়ে দিচ্ছে। হরতালে তাঁদের ব্যাপক আয় রোজগার। আমিও যদি এমন করতে পারি- আইডিয়াটা মন্ধ নয়।
হরতালের দিন ভোরেই সাথে তিন বন্ধুকে নিয়ে, মহাসড়কে গাড়ীঘোড়া থামাতে শুরু করি।
অর্ধ দিবস চাঁদাবাজি করেই হাজার টাকার বেশি পকেটে চলে আসে। তাই দুপুরের খাবারটা হোটেলে খেয়েই আবার চাঁদাবাজিতে চলে যাই।
বিকেলের দিকে এক লাইনে বরযাত্রী ভর্তি কতগুলো গাড়ী যাচ্ছে দেখেই, একটা ইট হাতে গাড়ীর দিকে তাক করে ইশারায় থামতে বলি। অপ্রত্যাশিত ক্ষতি এড়াতে ড্রাইভার সাথে সাথে আদেশ মেনে গাড়ী দাঁড় করায়। সাথে সাথে আমার দুই বন্ধু গাছের ডাল নিয়ে গাড়ীর ওপর চড়াও হতেই, করজোড়ে দুটো হাত গাড়ী থেকে বেরিয়ে আসে।
লোকটা মধ্য বয়সী। বেশ বড়সড়। আমরা তিনজনে তাঁর কাছে তিনটা ছাগলের বাচ্চা ছাড়া আর কিছু নই। তা ছাড়া এখান থেকে আমাদের বাসা প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে। তাই লোকটার অতি বিনীত ভাব সত্ত্বেও কিছুটা ভয় পাই।
তাঁর পেছনে সারি সারি গাড়ী ভর্তি বরযাত্রীর দলও ভয়ের অন্যতম কারণ। উল্টাপাল্টা কিছু করলে, সবাই এক হয়ে কখন যে ধোলাই শুরু করে। কিন্তু সময় গড়াতেই মনে হয়- মানুষগুলো সংগঠিত নয়।
মনে সাহস সঞ্চার করে আমি বলি-
৫০০ টাকা বের করে দিন। নইলে গাড়ী ভাঙব।
লোকটা জানায়-
পেছনেই তো দিয়ে এলাম। এখন আবার?
ওরা আমাদের লোক নয়। তবে, আমাদের বড় দলটা সামনে। এখানে দিয়ে গেলে- সামনে দিতে হবে না।
তা বুঝলাম।
কিন্তু বাবা’রা, আবার এত টাকা- তোমরা আমার ছেলের বয়সী।
মিথ্যা কথা, আমার বাবা আপনার চেয়ে বয়সে বড়। দিন টাকা দিন, ৫০০ টাকা- তাড়াতাড়ি। জ্যাম হয়ে যাচ্ছে, গাড়ী ছাড়তে হবে।
এখন আবার এত টাকা...
অন্য একটা সমবয়সী লোক বেরিয়ে এসে ইতস্তত করে।
তারপর আরো বলে-
আমারদের বউ মা কিন্তু খুবই লক্ষী আর সুন্দরী। বাবা’রা এসো, দেখে যাও।
বুঝলাম, ওরা আমাদের গলা হাতিয়ে বোকা বানাতে চাইছে। জ্ঞান আমাদের থাকুক না থাকুক, আমরা কিন্তু অতি চালাক। আমি তাঁদের জানিয়ে দেই-
না, বউটউ দেখতে পারব না।
হাতে সময় নাই।
আরে দেখেই যাও না।
লোকটা স্মিত হেসে বলে।
অপর লোকটা যোগ করে-
এমন সুন্দর বউ- দেখে কিছুতেই বলতে পারবে না ৫০০ টাকাই দিতে হবে। তখন ১০০ তেই মেনে নেবে।
এসো তো তোমরা...
লোকটা আমাকে বউয়ের কাছ পর্যন্ত টেনে নেয়। বউটার নাম জানি না। জানার প্রশ্নও আসে না। তাঁর গায়ে রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। মাথার কালো চুলগুলো ডান কাঁধের ওপর দিয়ে বুকের একপাশ ঢেকে আছে।
শরীর-স্বাস্থ্য ভাল। মূখের গড়নও সুন্দর। দেখতে খারাপ নয়। কিন্তু টাকা কমানো যাবে না বলে, আমি বলি-
ছিঃ কুৎসিত এক বউ। তবে, দিন ৪৫০ টাকা দিন।
এই তো কমেছে। বলেছিলাম না।
কথাগুলো বলেই লোকটা মুচকি হেসে, আমার হাতে ২০০ টাকা ধরিয়ে দেয়।
আমি অনড় স্বরে জানাই-
না না, ২০০ টাকায় কিছুতেই হবে না। সামনে ভাগ দিতে হবে।
এত বড় গাড়ীর লাইন। ফাজলামী পেয়েছেন।
আরে রাখ’রে বাবা। আমরা গরীব মানুষ।
লোকটা হাসছে।
হয়তো আমার এত ছোট মূখে বড় একটা কথা বলে ফেলার কারণেই। কেন যে ফাজলামী শব্দটা উচ্চারণ করতে গেলাম। এমন কথা তো আমার বাবা আমাকে বলেন। ভাবতে ভাবতে আর অনীহাই প্রকাশ করা হলো না। ওরা চলে যায়।
আমরাও দাঁড়িয়ে থাকি।
একটু পরেই শুনি, বড় বাঁচা নাকি বেঁচে গেছি। ওরা যখন গাড়ী থেকে বের হচ্ছিল- আমার দুই সঙ্গী নাকি তখন পালানোর পথ ঠিক করছিল। যদি না তাঁরা মারধোর শুরু করে, এই ভেবে।
হা হা হা হা-
কথা শুনে আমি হাসি।
একটু পর, দূরে রাস্তায় একটা কালো গাড়ী আসতে দেখে, মোসাদ্দেক উল্লাসে ফেটে পড়ে-
এবার বড় দান, এবার বড় দান।
একটাই মাত্র নিরীহ অথচ দামী গাড়ীটা দেখে আমারও তাই মনে হয়। তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। তারপর গাড়ীটা কাছে আসতেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইট তুলে থামার জন্য অবিরত ইশারা দেই।
গাড়ীটা ঠিক আমাদের কাছে এসেই দাঁড়ায়।
তারপর গ্লাসটা ধীরে ধীরে নামিয়ে, একটা লোক মূখ বের করে। মাথায় কালো পট্টি বাধা। চোখে কালো সানগ্লাস। গায়ে কালো ইউনিফর্ম। তাঁকে দেখেই আমার হৃদপিন্ডর ভেতর দিয়ে একটা শীতল ¯্রােত বয়ে যায়।
আর এমনভাবে কাঁপতে থাকি- আমার শুধু মনে হয় জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি। মনে মনে প্রার্থনা করি- তাই যেন হয়। নইলে সোজা ক্রসফায়ার।
ততক্ষণে র্যাব দেখে আমার দুই সঙ্গী ভাল মানুষের মতো গলি রাস্তা ধরে হেটে চলছে। পেছনেও তাকায় না।
ওদের মনে মৃত্যু প্রস্তুতি আবার বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি।
তবে, বয়স কম বলে- তিনজনেই রক্ষা পাই।
র্যাব আমাকে বলে দিয়েছে-
হালার পু হালা। রংবাজি কর। যেদিকে আসছ ঠিক সেই দিকে হান্দায়া দিমু।
আজীবন মনে রাখার মতো বিরাট বড় হুমকি।
সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর গাড়ী থামিয়ে চাঁদাবাজি নয়।
তবে, একটু বড় হতে হতেই, আমি পুরোপুরি গাঁজা আর বাংলা মদে আশক্ত হয়ে যাই। আশপাশের সবচেয়ে সহজলভ্য মাদক। তখন প্রতিদিনই টাকার সমস্যায় ভূগি।
কিন্তু প্রতিদিনই আবার টাকা যেন ভূতে জোগাঢ় করে দিয়ে যায়। তবে, মাঝে মাঝে পেন্সিডিলের নেশায় ধরলে- এমনি এমনি টাকা জোগাঢ় হয় না। এ জন্য নানা ফন্ধি আবিষ্কার করতে হয়। অন্ধকার জগতে ঢুকে যাওয়ায় দূর-দূরান্তে অনেক বন্ধু তৈরী হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ, কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ নয়।
যাঁদের জোর একটু কম, পাল্টা কিছু করার ক্ষমতা নেই, তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এলাকায় এনে- রাতের বেলা প্র¯্রাবের ছুঁতো ধরে, একটু দূরে সরে- মূখে গামছা প্যাঁচিয়ে পুনরায় এসে সোজা ছিনতাই করে বসি।
তাঁরা কেউই যে ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, এমন নয়। তবে, করতে পারার ক্ষমতা নেই বলে- আজ পর্যন্ত কেউ কিছু করেনি।
এখন আমার বয়স ২৩। প্রতিদিন মাঝরাত পর্যন্ত জুয়া খেলে- একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় বাসায় ফিরে ঘুম দেই।
পরদিন চাচা-মামার কাছ থেকে নানা ছুঁতোয় টাকা জোগাঢ় করি। তারপর সন্ধার পরেই আবার জুয়া খেলায় দৌঁড় দেই। খেলাটা আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে। তাই ছাড়তে পারি না।
একটা অবাক করা তথ্য- মাঝে মাঝে ভাবতে গিয়ে নিজে নিজেই হাসি।
এ পর্যন্ত জুয়া খেলে একদিনও আমি টাকা নিয়ে বাসায় ফিরতে পারিনি। ভাগ্য যে আমার দিকে একেবারেই তাকায় না, এমন নয়। শুধু জুয়ার প্রতি অসীম ভালবাসার জন্যই আমার এই পরিসংখ্যান। কখনো দেখা যায়, জুয়ার আসরে বসেই মূলধনের- কয়েকগুণ তুলে ফেলি। তবে, অন্যদের মতো তখন আমি আসর থেকে উঠে যাই না।
খেলতেই থাকি। জুয়ারিদের টাকা টানতে টানতে পকেট আর পায়ের তলা ভরে যায়। তারপর আবার উল্টো টানে যেতে যেতে সব খালি।
পকেট খালি হলেও- ভরা পকেটের মতোই জুয়ার প্রতি আমার ভালবাসা থেকে যায়। তখন, একে একে সবার কাছ থেকে ধার নেই।
তাও একবার নয়- হাতে পায়ে ধরে এক একজনের কাছ থেকে দুই তিনবার করে। ওসব করতে আমার কোনো লজ্জা হয় না। কারণ আমি গর্বিত জুয়াড়ি। ঠিক ছোটবেলায় যেমন চেয়েছিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।