শুক্রবার সকাল আটটা বাজে ।
নয়নের মা নয়নকে ঘুম থেকে উঠাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ।
'' বাবা , উঠ । আর কত ঘুমাবি ? ''
'' এইতো । উঠতেছি ।
তুমি যাও আমি উইঠা যাবো । ''
'' তোর বাবা আসতেছে । ''
নয়ন সাথে সাথে উঠে বসে । এরপর ওর বাবা ঘরে ঢুকে ।
'' ঘুমা ।
সারারাত ঘুমাইয়াও এখনও ঘুম হয় নাই । পড়ালেখা আর করা লাগবে না । গ্রামে পাঠাইয়া দিমু তোরে । হাল চাষ করবি । ''
এইটা প্রতিদিনের সকালের চিত্র ।
নয়ন ওর বাবা মার একমাত্র ছেলে । ওকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন । অনেক বেশি । নয়ন তা জানে । কিন্তু পড়ালেখা ওর খুব একটা ভালো লাগে না ।
জোর করে কখনো কিছু বোঝা সম্ভব না যদি তা ভালোই না লাগে । তবু বাবা মা এর স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলে জোর করে পড়তে চেষ্টা করে । কিন্তু কতক্ষণ আর নিজের মনকে জোর দিয়ে বশে রাখা যায় ।
নয়ন উড়তে থাকা পাখি দেখতে ভালোবাসে , ভালোবাসে ভাসমান মেঘ দেখতে কিন্তু ওকে দেখতে হয় কালো কালিতে লেখা মোটা বই ।
যে পাখি উড়তে ভালোবাসে তাকে স্বর্ণের খাঁচায় রেখেও খুশি করা সম্ভব না ।
নয়নের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা । প্রতিদিন শত শত উপদেশ পায় । এই সময় কত মুল্যবান । ওরও একই কথা এই সময় কত মুল্যবান আর ও যেই জিনিস ওর খারাপ লাগে সেই জিনিসে অপচয় করছে । সবাইকে দিয়ে সব কিছু হয় না ।
এইচএসসি পরীক্ষায় তথাকথিত এ+ পেলো কিন্তু সুখ তো পেলো না । পেলো আরো চাপ । পেলো আরো প্রত্যাশার বোঝা । এখন বাসা থেকে ওকে প্রতিদিন বলা হয় প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তার বাবা মায়ের নেই ।
তার বাবা প্রতিদিন বলে , '' দেখ তোর বন্ধুর বাপদের মতো আমার অত টাকা নাই ।
তোরে ভালো কইরা পড়াশোনা কইরা পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হইতে হবে । নাইলে তোরে আর পড়াইতে পারুম না । ''
নয়ন বুঝে কিন্তু কিছুই করার নেই ওর । মনের কথাও প্রকাশ করতে পারে না । আবার মা বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারে কাছে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই ।
তবুও যতটুকু সম্ভব নয়ন চেষ্টা করে চলেছে । রাতে আকাশ দেখে । কালো আকাশ । আকাশ এতো বিশাল কিন্তু একা বড়ই একা । ঠিক ওর মতো ।
'' প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি ।
কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব !
কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা !
কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা । '' [ রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ ]
বেশ কয়েকটি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে নয়ন পরীক্ষা দিল । কোনটাতেই হলো না ।
ওর বাবা মা এখন প্রতিদিন বলা শুরু করলো , '' পড়াশোনা তো তখন করতে কইলাম ।
করলি না তো । মা বাপের কথা শুনবি কেন ? গ্রামে যা হাল চাষ কর , কামলা খাট । ''
ও কাঁদে নীরবে । কষ্টগুলোকে নিজের মধ্যে চেপে চোখের জলের মাধ্যমে বের করে দেয় । কষ্ট কমে না ।
দিনের সাথে কষ্টও বাড়তে থাকে ।
ওরা যে বাড়িতে থাকে সেটি পাঁচ তলা । অনেকদিন পর ও ছাদে উঠলো । রাতের কালো আকাশ দেখতে । টিপ টিপ করে জ্বলতে থাকা তারা দেখতে লাগলো ।
ও ,আকাশের সাথে তো চাঁদ থাকে , থাকে তারা ।
তবে মনে হয় ওই শুধু একা ।
'' আমি একা
এই ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা ।
আমার অন্তর রক্তাক্ত
আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত
আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত । '' [ রূদ্র মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ ]
ও অনেক ভেবে দেখলো ওর বন্ধু ,ওর সব চেয়ে কাছের বন্ধু একাকীত্ব ।
নয়ন ওর বন্ধুর হাত ছেড়ে দিলো । মাটির সাথে সখ্যতা করতে ও আকাশের দিকে ফিরে মাটির কাছে যেতে লাগলো ।
ওর বাবা মায়ের স্বপ্নও পূরন হলো না । ওর নিজের স্বপ্নও না । তবে কার স্বপ্ন পূরন হলো ?
কিন্তু নয়ন তো ভিজলো নয়নের বাবা মায়ের নয়নের জলে ।
[ আমাদের ' সময়ের মূল্য ' নামক রচনা আছে পাঠ্য বইয়ে । আমরা পড়ি , পরীক্ষা দেই । কিন্তু আমাদের কি জানা আছে '' জীবনের মুল্য '' ?? নাকি এইটা এতোই মুল্যহীন যে কয়েক লাইন এই সম্পর্কে লিখতে কালির খরচ সম্পর্কে ভাবনা আসে ? জীবনের মূল্য দেয়া আমাদের সম্ভব হয় নি । '' স্বপ্নের মুল্য '' এই রচনাও আমরা পড়ি না । শুধু সিনেমাতেই দেখি ।
''এগুলো আমাদের জীবনের সাথে যায় না '' ঘরনার বিষয় ।
আর কিছু বলার নাই । আমরা এই রকম অনেক কিছুর মুল্যই দিতে পারি না । কারণ আমাদের শিখানো হয় নি । শিখতে বাঁধা দেয়া হয় বরং ।
'' আজ আমরা আবার সেই
বিশ্বাস আর আনন্দকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
সাহস আর সরলতাকে ফিরে পেতে চাই ,
আজ আমরা আবার সেই
শ্রম আর উৎসবকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
ভালোবাসা আর প্রশান্তিকে ফিরে পেতে চাই । ''- রূদ্র মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ
আরও নয়ন হারাবো । আরও নয়নের পরিবার হবে নিঃস্ব । ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।