ভারতের চার রাজ্যের নির্বাচনী ফল প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন ভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘বিজেপি উইনার, কংগ্রেস জিরো, এএপি হিরো’।
মাত্র ছয়টি শব্দ খরচ করে সাম্প্রতিক ভারতের সবচেয়ে নজরকাড়া নির্বাচন পর্বের নির্যাসটুকু চমৎকারভাবে উঠে এল প্রভাতি দৈনিকের শিরোনামে। বিজেপি জয়ী—এটা নির্ভেজাল সত্য, কংগ্রেস বিপর্যস্ত—তাও ষোলো আনা সত্যি, কিন্তু ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’র মতো জ্বলজ্বল করছে আম আদমি পার্টির অবিশ্বাস্য উত্থান। এই মিনি সাধারণ নির্বাচনের ‘হিরো’ সদ্যোজাত এই রাজনৈতিক দল, যার নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’।
চার রাজ্যে বিজেপি যে কংগ্রেসকে ছারখার করে দিতে পারবে, তাদের সেই বিশ্বাস দানা বেঁধেছিল নরেন্দ্র মোদিকে দল ও সংঘ পরিবার ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার সময় থেকে।
সেই বিশ্বাস ধাক্কা খেল দিল্লিতে। বিজেপির জয়মাল্যে যে কাঁটাটি খচখচ করছে, তা ওই এএপি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সরকার গড়তে কারও সমর্থন তাঁরা নেবেন না যেমন, কাউকে সমর্থন দেবেনও না। এতে কংগ্রেস আরও কিছুটা চুপসে গেছে। তারা ভেবেছিল, বিজেপিকে রুখতে এএপিকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে দিল্লিতে ‘ব্যাক সিট ড্রাইভিং’ করবে।
এএপির এ কট্টর মনোভাবের ফলে বিজেপিও ঘোড়া কেনাবেচার চেনা রাস্তায় হাঁটতে রাজি হচ্ছে না। অর্থাৎ দিল্লি সম্ভবত ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলেই থাকবে। ছয় মাস রাষ্ট্রপতির শাসনের পর আসছে বছরের সাধারণ নির্বাচনে একসঙ্গে দিল্লির লোকসভা ও বিধানসভার ভোটই আপাতত ভবিতব্য মনে হচ্ছে।
কংগ্রেস যে এভাবে ঘটিবাটিসহ উৎখাত হবে, সেই আশঙ্কা তাদের যেমন ছিল না, এতখানি আশাও হয়তো বিজেপি করেনি। বিশেষত রাজস্থানে।
এই মরুরাজ্যে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট গত দেড় বছরে এমন দুটি কাজ করেছেন, যা তাঁকে জেতানোর জন্য হয়তো যথেষ্ট ছিল। রাজ্যজুড়ে সস্তায় ওষুধ বিক্রির ব্যবস্থা করা এবং গরিব ও বয়স্ক মানুষের জন্য পেনশনব্যবস্থা চালু করা। ব্র্যান্ডেড ওষুধ বিক্রির রমরমা বন্ধ করে প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধ লেখা বাধ্যতামূলক করে রাজ্যজুড়ে তাঁর দোকানের বন্দোবস্ত করার মধ্য দিয়ে অশোক গেহলট একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজস্থানে বিজেপি জিতল তিন-চতুর্থাংশ ভোট পেয়ে!
গত ১৫ বছরে দিল্লির পরিকাঠামোয় যা কিছু পরিবর্তন, তার কৃতিত্ব শীলা দীক্ষিতের কংগ্রেস ছাড়া আর কারও নয়। শীলাকে চোর অপবাদ তাঁর চরম নিন্দুকেও দেয়নি।
অথচ সেই শীলার কংগ্রেসকে ‘ডবল ডিজিট’-এর নিচে নেমে যেতে হলো! মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির দুই মুখ্যমন্ত্রী এত সহজে তৃতীয়বারের জন্য দায়িত্ব নেবেন, এতখানি নিশ্চিন্ত বিজেপিরও বোধ হয় ছিল না। কংগ্রেসের এভাবে দুরমুশ হওয়ার কারণ তালাশের চেয়েও বেশি চলছে বিজেপির উত্থানের পেছনে মোদি-হাওয়া কতটা, তা পরিমাপ। চলছে এএপির সাফল্যের রসায়নের বিশ্লেষণও।
গত দেড়-দুই বছর ধরে দেশের আনাচকানাচে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটা হাওয়া যে বইছে, তা দৃশ্যমানই ছিল। একের পর এক দুর্নীতি, দুর্নীতিকে আড়াল করার চেষ্টা, সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা, লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উদারীকরণের নামে সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা, অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়দান, সৎ ও নির্ভীক কর্মকর্তাদের হেনস্তা করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জনমত ক্রমে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল।
একের পর এক রাজ্যে এ নিয়ে আন্দোলন সত্ত্বেও কংগ্রেসের উপেক্ষার নীতি এবং তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমে সিদ্ধান্তহীনতায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে। সরকারি স্তরে প্রধানমন্ত্রী এবং সাংগঠনিক স্তরে সোনিয়া-রাহুল গান্ধীর ব্যর্থতার দায় রাজ্যস্তরের নেতাদেরও বিচলিত করে তোলে। পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির উত্থান ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে ভর দিয়ে প্রকৃত অর্থে ‘আম আদমি’র এগিয়ে আসা কংগ্রেসকে দিশাহীন করে তোলে। দিল্লিতে এএপি এবং বাকি তিন রাজ্যে বিজেপির সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলার মতো মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস কংগ্রেস হারিয়ে ফেলে। সেমিফাইনালে গোহারা হার তার স্বাভাবিক পরিণতি।
বিজেপিতে যাঁরা মোদি-অন্তঃপ্রাণ, তাঁদের মুখে এখন মোদির নাম-সংকীর্তন চলছে। মোদি যাঁদের চক্ষুশূল, তাঁরা তাঁকে নম্বর দিতে নারাজ। সত্যটা এই দুইয়ের মাঝামাঝি। মোদি তুরুপের তাস হলে দিল্লির তীরে এসে বিজেপির তরি ডুবত না।
অতএব, ঝড় বা সুনামি ওঠেনি।
তবে মোদির প্রভাব কিছুটা নিশ্চিতই কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী পদে মোদির উত্তরণ সংগঠনকে চনমনে করে তুলেছে। মোদি পারেন, মোদিই পারবেন—এমন একটা বিশ্বাস বিজেপির তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। দিল্লিতে সেই প্রভাব অতটা প্রকট না হওয়ার কারণ, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির হর্ষবর্ধনকে বেছে নিতে দেরি করা, দ্বিতীয় কারণ, আম আদমি পার্টির প্রতি সাধারণের বিশ্বাস ক্রমে বেড়ে চলা। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে মানুষের বীতশ্রদ্ধভাব সেই দলকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে, যে দল কংগ্রেসের ভালো বিকল্প হতে পারে।
দিল্লিতে এখানেই বিজেপিকে টেক্কা দিয়েছে এএপি। আনকোরা একটি দলের কাছে সাংগঠনিক দিক দিয়ে শক্তিধর ও আর্থিক দিক দিয়ে বলশালী বিজেপিকে হার মানতে হলো। একক গরিষ্ঠ দল হয়েও মাত্র তিন-চারটি আসনের জন্য সরকার গড়ার সংকট এএপির কাছে বিজেপির পরাজয়েরই শামিল।
ভারতের যে যে রাজ্যে বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস, সেই রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের হাল আগামী লোকসভা নির্বাচনে আরও খারাপ হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। এএপি থেকে শিক্ষা নিয়ে সাধারণ মানুষকে আরও বেশি দলীয় কাজে অংশীদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাহুল গান্ধী।
গত চার বছরে তিনি যা পারেননি, আগামী চার-পাঁচ মাসে তা করে ফেলার এলেম আর যার থাকুক না কেন, রাহুলের নেই। ফলে পাঞ্জাব, হিমাচল, উত্তরাখন্ড, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড ও হরিয়ানায় বিজেপি বা তাদের মিত্র দলের কাছে কংগ্রেসের বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। উত্তর প্রদেশ ও বিহার মোদির মানচিত্রে বিশেষভাবে চিহ্নিত। এ দুই রাজ্য থেকে অন্তত ৮০টি আসন জিততে তিনি সর্বস্ব পণ করেছেন। সে জন্য তিনি তাঁর মতো করে ছক কষে রেখেছেন আগে থেকেই।
বাকি থাকছে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দাক্ষিণাত্য। মোদির হিসাবে এনডিএ ২০০+ আসন পেলে সরকার গড়তে সাহায্যের হাতের অভাব হবে না।
আম আদমি পার্টির ভবিষ্যৎ কী, সেই প্রশ্ন ভাবাতে শুরু করেছে। দেশের রাজনীতির ‘ট্রেন্ড’-এর বাইরে হেঁটে প্রাচীন ও অবলুপ্ত সেই রাজনৈতিক ধারার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে এএপি, যেখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতি হতো না। হতো আদর্শ ও নীতিভিত্তিক রাজনীতি।
বহু বছর পর আমরা একটি রাজনৈতিক সংগঠন দেখলাম, যেখানে নীতি ও মানুষই বিবেচ্য। দেখলাম, একেবারে সাধারণ মানুষ, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, বস্তিবাসী থেকে ফ্ল্যাটবাসী—সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অপশাসনের বিরুদ্ধে, আইনের শাসনের পক্ষে ও সৎ রাজনীতির জন্য একজোট হয়ে অল্প সময়ে একটি অবিশ্বাস্য ইতিহাস রচনা করলেন। গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে এ এক অনন্য বিদ্রোহ। এটা শহুরে বীতশ্রদ্ধ মানুষের ও প্রধানত যুব সম্প্রদায়ের ‘রোমান্টিসিজম’ নাকি ‘আরব বসন্তের’ এক অন্য রূপ, সেই নিয়েও চর্চা শুরু হয়েছে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরা শুধু জানিয়েছেন, দিল্লিতেই তাঁরা থেমে থাকছেন না, তাঁরা লোকসভার দিকেও নজর দেবেন।
দেশের ৩০০টি স্থানে তাঁরা ইতিমধ্যেই তাঁদের শাখা খুলেছেন। ৫০ থেকে ৬০টি লোকসভা আসন তাঁরা চিহ্নিত করেছেন লড়ার জন্য। আগামী লোকসভায় তাঁরা নিজেদের জাহির করতে প্রস্তুত।
মনমোহন সিংয়ের সরকার এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাকি কটি মাস কাটাবে। একটিও কাজের কাজ তারা করতে পারবে না।
এভাবে আগামী বছরের মে মাসের মধ্যে লোকসভার নির্বাচন শেষে ষোড়শ সংসদ গঠিত হবে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ অথবা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ নাকি কংগ্রেস-সমর্থিত তৃতীয় শক্তি বা ফেডারেল ফ্রন্ট, কে ক্ষমতায় আসতে পারে—এখন পর্যন্ত এটাই চলছে জল্পনার বিষয়।
কে বলতে পারে, ২০১৪-এর পরে আম আদমি পার্টিই উঠে আসবে কি না আলোচনার শীর্ষে। ভারতের রাজনীতিতে আম আদমি পার্টি এক নতুন হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। ‘হিরো’ থেকে তারা ‘উইনার’ হতে পারে কি না, সেদিকেই পরম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।