প্রবাসী
গত মার্চ মাসে চীন থেকে কানাডায় বেড়াতে এসেছেন “এর শুন” এবং “দা মাও” তারা এ দেশে থাকবেন দশ বছর। এর মধ্যে টোরোণ্টোতে থাকবেন পাঁচ বছর আর তাদের বাকী পাঁচ বছর কাটবে ক্যালগারীতে । এই দশ বছরে যদি ওদের ছেলে মেয়ে হয় তাহলে ছেলে মেয়েরা বড় না হওয়া পর্যন্ত তাদের এখানে থাকতে হবে । কারন হল কানাডা সরকারের সিটিজেনশীপ এবং ইমিগ্রেশান আইন অনুযায়ী তারা হবেন কানাডার সিটিজেন। আর থাকবেনই বা না কেন? কানাডার পাসপোর্টর একটা দাম আছে না? এই তো কয়েক দিন আগে চীন থেকে এদেশে আসা ইমিগ্রান্ট সহকর্মী লি’ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাদের দেশ তো দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে , ভাল দেশ ।
তোমরা কেন কানাডাতে ইমিগ্রান্ট হয়ে আসো? লী একটু কৌতুক করেই জবাব দিল “ কানাডার পাসপোর্ট থাকলে যেকোন চীনা মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাবে। অন্য সব বাবা মার মত “এর শুন” এবং “দা মাও” বাবা মায়ের তাদের অনাগত ছেলে মেয়েদের বিয়ের বাজারে ভাল দাম হোক- এমন ইচ্ছে আছে কিনা তা অবশ্য আমি জানি না। ওদের সাথে দেখা কররার সাধ আমার বহুদিনের। ছয় মাসের ও বেশী হয়ে গেল অথচ দেখা করতে যাইনি। মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল ।
বরফ এবং হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রার মধ্যেও গত রবিবারে দেখা করে এলাম “এর শুন এবং “দা মাও” এর সাথে।
আমার মত একজন অখ্যাত লোকের কুখ্যাত লেখা পড়ে কেউ যদি মনে করেন আমার মতই অখ্যাত কেউ হবে “এর শুন” এবং “দা মাও” তারা কিন্তু ভুল করবেন। ওরা কিন্তু অনেক অনেক বিখ্যাত লোক। আমি ভাল করেই জানি আপনারা কেউই আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। ঠিক আছে , আমারও দরকার নেই জোরাজুরি করার।
তবে পরের কয়েকটা লাইন পড়লেই বুঝতে পারবেন তাদের দাম কেমন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং স্টিফেন হারপার চীনা প্রধানমন্ত্রী লিং জীয়ানের সাথে চুক্তি করে তাদের কানাডাতে আনার ব্যাবস্থা করেছেন । অন্যেরা যেখানে কানাডার ভিসা পেতে নাকাল হন ওদেরকে দশ বছরের ভিসা দিয়েছে কানাডা সরকার। দরকার হলে সে ভিসা বাড়ানোও হবে। আপনার আমার মত ছাপোষা লোক যেখানে কস্টে সৃস্টে ইকোনোমি ক্লাসের টিকিটে গাদাগাদি করে যাতায়াত করি, সেখানে ওদের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যাবস্থা করেছিল ফেড এক্স ( Fed Ex ) ।
সে বিমানের যাত্রী মাত্র ওরা দু’জন। কত খরচ হয়েছে ওদেরকে আনতে জানেন সেটা? চল্লিশ লক্ষ ডলার বা ৩১ কোটী টাকা। টোরোণ্টোর পীয়ার্সন বিমান বন্দরে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির ছিলেন স্বয়ং স্টিফেন হারপার। এখানে আসার পর এক মাস আলাদা ভাবে রাখা হয়েছিল ওদেরকে যাকে বলে কিনা কোয়ারেন্টাইন করে রাখা। তারপর আরও তিন মাস ওদেরকে পর্য্যবেক্ষনে রাখা হয়েছিল।
কানাডার ঠান্ডায় সর্দি কাশি হয়ে জ্বরজারি হতেও তো পারে? দুজন ডাক্তারও আনা হয়েছিল চীন থেকে কারন অসুখ বিসুখ হলে কানাডার ডাক্তাররা তাদের ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল । আরো আছে । প্রতি সপ্তাহে দুই বার পাঁচ থেকে সাতশ’ কিলোগ্রাম খাবার আনা হয় ওদের জন্য চীন থেকে বিমানে করে । কানাডার খাবার ওদের আবার মুখে রোচে না , পচা বা বাসী খাবারও ওরা খান না। আরো বেশী কিছু লেখার আগে ওদের বায়োডাটাটা দিয়ে নিই।
“এর শুন”- জন্মস্থান – চীনের চংকিং এ। জন্ম তারিখ - ১০ই আগস্ট ২০০৭ , পিতার নাম – লিং লিং, , মাতার নামঃ- নাম ইয়া ইয়া । মা বাবা আদর করে মেয়ের নাম রেখেছেন “এর শুন” চীনা ভাষার এ শব্দের অর্থ হল দ্বিগুন মসৃন। এমন নাম রাখার কারন হল “এর শুন” তার মা’র দ্বিতীয় সন্তান এবং তারা আশা করেন তাদের মেয়ে কোন রকম ঝুট ঝামেলা ছাড়াই বড় হবে , মসৃন হবে তার জীবন। “এর শুন” এর নানী ১৯৮৮ সালে ছয় মাস থেকে গেছিলেন কানাডার ক্যালগারীতে।
শান্তশিস্ট হাসিখুসি স্নেহ পরায়ন মেয়ে “এর শুন” এর ওজন ৯৯.৮ কিলোগ্রাম।
“
"এর শুন"
দা মাও” – জন্মস্থান- চীনের চেংডু শহরে , জন্ম তারিখ- ১০ই সেপ্টেম্বর ২০০৮(চীনা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০০৮ হল ইঁদুরের বছর। , পিতার নাম- জিয়ং বিয়ং, মাতার নাম - মাও মাও । ছেলের এমন নাম রাখার কারন হল সে মা “মাও মাও’য়ের প্রথম ছেলে। ছেলে হিসেবে চমৎকার হাশিখুশি ভদ্রলোক “ দা মাও” ওজন -১০০ কিলোগ্রাম।
দা মাও
ওহো এত কথা বললাম “ এর শুন” এবং “দা মাও” এর সম্পর্কে , কিন্তু আসল কথাটাই বলা হয়নি। ওরা হল চীন দেশের জায়ান্ট বা বৃহদাকৃতির পান্ডা।
জায়ান্ট পান্ডা সম্পর্কে কিছু মজার তথ্যঃ- ১) শুধুমাত্র চীনের মধ্যাঞ্চলের ছয়টি পাহাড়ী বনজঙ্গলে এদের দেখা মেলে। ২) খাদ্যঃ- বাঁশ হল এদের খাদ্যের ৯৯% ভাগ। বিশেষ চার ধরনের বাঁশ খেয়ে থাকে এরা।
বাঁশগাছগুলো ১৫/২০ বছর পর ফুল ধরে মারা যায় ফলে পান্ডাদেরকেও খাদ্যের জন্য নতুন জায়গা খুজে নিতে হয়। ৩) এরা বাঁশ খেয়ে বাচলেও কিন্ত এরা মাংশাসী প্রানীদের গোত্রের কারন হল তৃনভোজী প্রানীদের মত এদের উদ্ভিদের সেলুলোজ হজম করার ক্ষমতা নেই। ৪) যেহেতু সেলুলোজ ছাড়া বাঁশ এ অনান্য পুস্টির পরিমান কম , এদেরকে প্রতিদিন বিশাল পরিমান খাবার খেতে হয় । গড়ে প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ কিলোগ্রাম বা শরীরের ওজনের অর্ধেক। ৫) “হাতী যেমন খায় তেমনি ন্যাদায়” এমন কথা পান্ডার জন্যেও সত্যি।
একটা পান্ডা গড়ে প্রতিদিন ২৭ কিলোগ্রাম পর্যন্ত মল ত্যাগ করে থাকে ৬) খাওয়ার পেছনে এদের প্রতিদিন ব্যয় করতে হয় ১০ থেকে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত। খাওয়া এবং মলত্যাগ প্রায় সমানে চলতে থাকে। এদের পাকস্থলী খুবই ছোট ফলে খাদ্য জমা করে রাখার ব্যাবস্থাও নেই। বাদ বাকী সময় এরা ঘুমায় এবং বিশ্রাম নেয়। ৭) ডি,এন,এ পরীক্ষা করে দেখা গেছে পান্ডারা ভল্লুকক গোত্রের।
ভল্লুকেরা যেমন শীতকালে গুহার মধ্যে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটায় পান্ডাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। বরফের মধ্যেও এদেরকে খেতে হয় কারন এদের দেহে অনান্য ভালুকের মত চর্বি জমা রাখার ব্যাবস্থা নেই। ৮ ) প্রত্যেক পান্ডার নির্দিস্ট এলাকা থাকে অর্থাৎ বাঘের মত এরাও নির্দিস্ট গন্ডির মধ্যেই বসবাস করে। এদের সীমানা চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও অদ্ভুত। গাছের গুড়ির কাছে এসে সামনের পায়ের উপর ভর দিয়ে পেছনের পা গাছের কান্ড বরাবর যতদুর সম্ভব উপরে উঠিয়ে দিয়ে প্রস্রাব করে চিহ্ন দিয়ে রাখে তাদের এলাকার সীমানার ৯) এরা মোটা নাদুশ নুদুশ প্রানী হলেও গাছে উঠতে ওস্তাদ ১০ ) একা থাকতে পছন্দ করে এরা, শুধু মাত্র প্রজননের সময় স্ত্রী এবং পুরুষ পান্ডা অল্প সময়ের জন্য একত্রিত হয়।
বছরে শুধু মাত্র ৩/৪ দিনের জন্য স্ত্রী পান্ডা প্রজননক্ষম হয়। এরা কু কু শব্দ করে সঙ্গীকে ডেকে নেয়। প্রতি দুই বছর পর একটা, এবং কচিত কদাচিৎ দুটো বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চা হয় খুবই ছোট, মাত্র ৩/৪ আউন্স ওজনের যা একটা মোবাইল ফোনের আকৃতির সমান। জন্মের সময় বাচ্চা থাকে অন্ধ এবং গায়ে কোন লোম থাকে না।
১১) পান্ডারা মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে থাকে , কোন পান্ডার যুদ্ধ করতে ইচ্ছে না হলে পেছনের দু পায়ের উপর বসে চোখ দুটো হাত দিয়ে ঢেকে রাখে। ১২) পান্ডার মুখ গোলাকৃতি হওয়ার কারন হল এদের চোয়ালের মাংশ পেশীর আকার। যেহেতু বাঁশ চিবিয়ে খেতে হয়, এদের চোয়ালের মাংশ পেশী খুব শক্তিশালী এবং বড়। পেছনের দাঁতগুলো মাংশাসী প্রানীদের মতই বড় বড় । ১৩) বাঁশ হাত দিয়ে ধরে খেতে হয় তাই এদের সামনের পায়ের থাবায় অতিরিক্ত একটা আঙ্গুলের মত থাকে যাকে বলে pseudo thumb অর্থাৎ আঙ্গুল থাকে ছয়টা।
১৪) আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষন সংস্থা বা (International Union for Conservation of nature - IUCN ) এর তালিকায় পান্ডা বিলুপ্তির জন্য অত্যধিক ঝুকিযুক্ত প্রানী (critically endangered species )। বাসস্থান কমে আসা, খাদ্যের অভাব চোরা শিকারী ইত্যাদি কারনে কমে আসছিল এদের সংখ্যা। চীন সরকার , বিদেশী সরকার ও অনান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় এদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। চীনদেশে বনাঞ্চলে এখন এক হাজারের মত পান্ডা বেচে আছে , আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানাতে আছে আরো দুইশ’ মত। ১৫) সুন্দর প্রানী হওয়াতে ১৯৬১ সালে যখন World wild Fund (WWF) গঠিত হয় পান্ডাকে এ সংস্থার প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
১৬) পান্ডাকে সম্মান দেখানোর জন্য প্রতি পান্ডার নাম দুই বার উচ্চারন করা হয় চীনদেশে যেমন, লিং লিং বা মাও মাও ইত্যাদি ১৭) পান্ডার গায়ের রঙ এমন অদ্ভুত সুন্দর সাদা কালোর মিশ্রন কেন হয় তার কারন বের করতে পারেন নি বিজ্ঞানীরা। তবে এ ব্যাপারে একটা রুপকথা আছে চীনদেশে । তা হলঃ-
অনেক অনেক দিন আগে চীনদেশের এক বনে মেষ চরাচ্ছিল চার মেশপালক মেয়ে । এমন সময় এক পান্ডাকে তাড়া করে নিয়ে আসছিল চিতাবাঘ। পান্ডাকে চিতাবাঘের হাত থেকে বাঁচাতে চাইলো মেয়েরা।
কিন্তু না, সব মেয়েরই প্রান গেল চিতাবাঘের হাতে । সেই সময়ে পান্ডাদের পুরো শরীরের রঙ ছিল সাদা । মেশপালক মেয়েদের প্রতি সম্মান জানাতে সমস্ত পান্ডা মিলে অন্ত্যস্টিক্রিয়ার আয়োজন করল, আর শোক প্রকাশ করতে পড়ল কালো জামা। মেয়েদের শোকে কাঁদতে থাকা পান্ডাদের দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকল পানি । কাল কাপড় পরা হাত দিয়ে তারা যখন চোখের পানি মুছতে থাকল তাদের চোখের পাশের লোমগুলোও হয়ে গেল কালো।
শোকে দুঃখে তারা তাদের কান দুটোও ঘষতে থাকল হাত দিয়ে , ফলে সে দুটোর রঙ্গ কালো হল । কান্নাকাটি করতে করতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল পান্ডারা আর শরীরের অনান্য অংশ কোথাও কোথাও ভরে গেল কালো ছোপে। মেশপালক মেয়েদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে পান্ডারা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা এই কাল দাগগুলোকে কোনদিন মুছবে না। বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের পান্ডারা যাতে সেই চার মেশপালক মেয়েকে ভুলে না যায় সেই উদ্দেশ্যে তারা তৈরী করল এক পর্বত, সে পর্বতের চারটে শৃঙ্গ। চীনের সিচুয়ান প্রদেশের উলং ন্যাচারাল রিজার্ভ এ গেলে আজও সেই চার শৃঙ্গ ওয়ালা পর্বতে দেখতে পাওয়া যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।