বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে রায়েরবাজার। একাত্তরের শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো বর্বর হত্যাযজ্ঞের নির্মম সাক্ষী এই রায়েরবাজার। এখানকার বধ্যভূমি শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ শোক আর বেদনার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে আছে কোটি বাঙালির হৃদয়ে। আপাতদৃষ্টিতে একটি সাদামাঠা জায়গা। আর স্মৃতিসৌধটি ইট-কংক্রিটে নির্মিত একটি সাধারণ স্থাপনামাত্র।
এর পরও প্রতিটি বাঙালির জীবনে এর পেছনের ঘটনা বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। এর পেছনে লুকিয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের ত্যাগ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার করুণ শোকগাথা। এ শোক কখনো ভোলার নয়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানিরা তাদের পরাজয় সম্পর্কে আঁচ করে ওঠে। মুক্তিবাহিনী যখন বীরবিক্রমে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ একের পর এক উড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন দিশাহারা হয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তানিরা।
ওরা নতুন ছক আঁকে। জাতিকে পঙ্গু করার প্রয়াসে ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে সারা দেশে টার্গেট করে প্রায় দুই হাজার শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এদের মধ্যে খোদ ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরে ঢাকাতেই খুন হন প্রায় ১১০০ জন। যুদ্ধের পরও কয়েকজন শহীদ হয়েছেন, যাদের মধ্যে জহির রায়হান অন্যতম। বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করতে ও তুলে আনায় সহায়তার অভিযোগ আছে দেশীয় আল-বদর, আল-শামসের বিরুদ্ধে।
কারফিউ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনারা বাসা ও অন্যান্য জায়গা থেকে তুলে নিয়ে অমানবিক অত্যাচার করে খুন করে দেশবরেণ্য এসব বুদ্ধিজীবীকে। চোখ আর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অগণিত লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার আর মিরপুর বধ্যভূমিতে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার কারণ ছিল বাঙালির বুকে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগানোর পেছনে বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রেরণা। সেই সময়কার ঘটনার জন্যই বাংলাদেশের ইতিহাসে রায়েরবাজার এত তাৎপর্যপূর্ণ।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সেই আত্দত্যাগের স্মরণেই আধুনিক স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে রায়েরবাজারে গড়ে তোলা হয় 'শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ'।
এই সৌধটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে। ছয় দশমিক ৫১ একর জমির ওপর এ সৌধটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সৌধটির প্রধান অংশটি হলো বক্রাকৃতির দেয়াল। দেয়ালটির বক্রাকৃতি অংশের দৈর্ঘ্য ৩৮০ ফুট আর সোজা অংশের দৈর্ঘ্য ৩৩০ ফুট। উচ্চতা ৫৬ ফুট।
দেয়ালের প্রস্থ তিন ফুট। এখানে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার শোক বা বিষণ্নতার আবহ সৃষ্টির জন্য দেয়ালের দুই পাশের কিছু অংশ ভেঙে রাখা হয়েছে। দেয়ালটির মাঝে ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের একটি ফাঁকা অংশ বা ছিদ্র রয়েছে, যা দিয়ে সৌধের পেছনের প্রতিকৃতি বা আকাশ নানা বর্ণে ধরা দেয় দর্শনার্থীর কাছে। প্রতীকীভাবে চিন্তা করলে দর্শনার্থী যেন ফিরে যায় সেই একাত্তরে, ঘৃণা জানায় বর্বরোচিত সেই হত্যাকাণ্ডের। বক্র দেয়ালের সামনেই ১৬ হাজার ৬০০ বর্গফুটের একটি কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে।
এ জলাশয় থেকেই উঠে এসেছে ৩৩ ফুট উঁচু একটি কালো স্তম্ভ, যা এখানে আসা দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের সেই ভয়াল রাতগুলোতে। সরেজমিন দেখা যায়, বধ্যভূমি ও স্মৃতিসৌধ এলাকায় সন্ধ্যার পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি। প্রায়ই এখানে ছিনতাই হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন স্থাপত্যটি দেখতে এলেও তারা আতঙ্কে থাকেন, কখন কী ঘটে যায়। রাতের বেলায় বধ্যভূমিতে খোলা চত্বরে বসে মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আড্ডা।
শুধু ডিসেম্বর এলেই কিছুটা পরিষ্কার করা হয়। বাকি সময় ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি থাকে এ স্মৃতিসৌধটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, রায়েরবাজার বধ্যভূমির পবিত্রতা রক্ষার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।