আমি নিজে যে কি তা নিজেই জানি নাহ
1. মাথার তীব্র ব্যাথাটা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল একই জায়গায় ছুরি দিয়ে কেউ আঘাত করেই চলেছে। দেহ থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলতে পারলে বোধ হয় শান্তি পেতাম। চোখ দুটোও খুলতে পারছিলাম না,অনুভবও করতে পারছিলাম না। নিজের রক্ত,পোড়া কাপড় আর গায়ের ঝলসে যাওয়া মাংসের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
হাতের চামড়া সম্ভবত পুড়ে গেছে,হাত দুটো নড়াতেও খুব কষ্ট হচ্ছিল। বিষ্ফোরনের বিকট শব্দে কানে তালা লেগে গিয়েছিল,এখনো ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছিনা। হঠাত অনুভব করলাম চারটা হাত আমাকে তুলে নিলো আর কোথাও শুইয়ে দিল,খুব সম্ভবত অ্যামব্যুলেনস। চোখ বন্ধ রাখতেই ভাল লাগছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমি কাঁদছি নাকি চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
একটু পর দরজা খোলা আর স্ট্রেচার নড়ার শব্দে বুঝতে পারলাম হাসপাতালে পৌঁছে গেছি। সাইরেনের শব্দ,মানুষের চিৎকার,আর তাদের উন্মত্ত ফোন কলগুলো অসহ্য লাগছিল আমার। তারপর আস্তে আস্তে সব কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। মারা যাচ্ছিলাম বোধ হয়। কিংবা না।
2. মায়ের কন্ঠ শুনে জেগে উঠলাম আমি। আমার কপালে মায়ের উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় এক মুহূর্তের জন্যে সব ব্যাথা,কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার প্রায় সমস্ত দেহ ব্যান্ডেজে ঢাকা। মাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ব্যান্ডেজের কারনে চোখ দুটো খুলতে পারছিলাম না।
-এখন কেমন লাগছে বাবা? আমি দেখতে পারছিলাম না কিন্তু বুঝতে পারছিলাম মা কাঁদছে। -আমি ঠিক আছি মা। গতকালের ঘটনাটার কথা মনে পড়তেই মাকে বললাম,"মা,বাচ্চা মেয়েটা কোথায়?" আমার মাথার উপর মায়ের হাতটা থেমে গেল। উত্তরটা বুঝে নিলাম।
বাচ্চা মেয়েটার নিষ্পাপ মুখটা মনে পড়ছে বারবার।
চিৎকার করে কাঁদছিল মেয়েটা। বাচ্চাটার মা সামনের সিটে অচেতন হয়ে পড়েছিল। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে পৌঁছায়নি তখনো। যে কোন সময় বিষ্ফোরনের ভয় ছিল। জলন্ত গাড়িটার কাছ থেকে মানুষজন যত দূরে পারে পালাচ্ছিল।
আমার হাত শক্ত করে আকড়ে ধরলো আমার বন্ধু। কাছে যেতে বারণ করল। নিজেকে ছাড়িয়ে গাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। মেয়েটাকে যে আমার বাঁচাতেই হবে। -তোর জন্যে গর্বে আমার বুকটা ভরে যাচ্ছে বাবা।
মনে মনে বললাম, "কেন গর্ব করবে মা?কাওকেই তো বাঁচাতে পারলাম না। "
3. ডাক্তার কয়েকবার এসে আমাকে দেখে গেল। মাকে বলল সন্ধ্যায় চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে। ডাক্তারের কথায় বুঝলাম কিছু একটা হতে চলেছে। নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম।
জানি মা ও তাই করছে।
4. মা শক্ত করে আমার হাতটা ধরলো। খুব আস্তে আস্তে চোখ খুললাম আমি। আন্ধকার দেখলাম। কয়েকবার পিটপিট করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে,গভীর মনোযোগ দিয়ে আবার চেষ্টা করলাম। আবারো অন্ধকার। পরিপূর্ণ কালো। -কিছু দেখতে পাচ্ছিনা আমি। কথাটা কাকে বললাম ঠিক জানিনা।
মায়ের কান্নার শব্দ শুনলাম। আমার হাত ছেড়ে দিলো মা। বোধ হয় রুমের বাইরে চলে গেল। ডাক্তাররা আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করল আর এমন কিছু ডাক্তারি শব্দ আওড়াতে লাগলো যার কোনটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার প্রশ্ন শুনতে ভাল লাগছিলনা।
আমার চোখ দুটো খোলা তারপরও কেন সব অন্ধকার!গাঢ় অন্ধকার। -চলে যান এখান থেকে। প্রচন্ড রাগে চিৎকার করতে লাগলাম আমি।
5. রাত ১০ টা। মা মোবাইলে প্রতি ঘন্টায় অ্যালার্ম সেট করে দিয়েছে।
তাই বলতে পারছি। মাঝে মাঝে অ্যালার্ম বন্ধ করার জন্য চিৎকার করে নার্সকে ডাকি। তখন নিজেকে পাগল মনে হয়। মাঝে মাঝে একটা জিনিস খুঁজতে গিয়ে অনেক গুলো জিনিস ভেঙে ফেলি। নিজের এই দুর্বলতার জন্যে প্রায়ই কাঁদি আমি।
দরজাটা হঠাত খুলে গেল আর ভেতরে কেউ ঢুকলো। -কে?নার্স? -আপনি গতরাতে কাঁদছিলেন। আমি শুনেছি। কোন রকম পরিচিতি পর্ব ছাড়াই এরকম প্রশ্নে আমি অবাক হলাম। রাগও হলো।
-তাতে আপনার কি? বিরক্তির সুরে বললাম আমি। -আমার মনে হয় আপনার একজন সঙ্গী দরকার। পুরুষ মানুষকে ওভাবে কাঁদতে দেখলে আমার কেমন জানি লাগে। -আমার কাওকে লাগবেনা। আমি একাই আমার জন্য যথেষ্ট।
-তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মেয়েটা খোঁটা দিলো আমাকে। -আমি মার্শাল আর্ট জানি। আমি ফাইট করতে জানি। -হ্যাঁ আমি তাও জানি।
কাল রাতে চিৎকার করতে করতে এটাও বলেছিলেন। তা এখানে গায়ের জোর দিয়ে কি হবে শুনি? মেয়েটার কথা শুনতে ভাল লাগছিল না। কি মনে করে নিজেকে! -কি হলো?? -আমি ফাইট করতে জানি,আমি ফাইট করতে জানি। চিৎকার করে বললাম আমি। মেয়েটাকে বললাম নাকি নিজেকে বললাম জানিনা।
-আমার কাওকে লাগবেনা। আমি একাই বাঁচতে পারবো। -আমি জানি। খুব শান্ত কন্ঠে বলল মেয়েটা। আমি উত্তর দিলাম না।
মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে আমার। অজানা অচেনা মেয়েটার সাথে কথা বলার আর কোন ইচ্ছে নেই। -চলে যান। আমাকে একা থাকতে দিন। চিৎকার করলাম আমি।
আমার এরকম ব্যাবহারে মেয়েটার হতবাক চেহারাটা কল্পনা করতে পারছিলাম। নাকি সে এখনো চুপচাপ দাড়িয়েই আছে! কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খোলা আর বন্ধের শব্দ পেলাম। ঝটকা বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগলো।
6. পরদিন সকালে দেরীতে ঘুম থেকে উঠলাম। আমার চারপাশে কি হয় বোঝার চেষ্টা করি সবসময়।
শব্দ শুনি,জিনিসের গন্ধ নেই। কিন্তু কখনো বুঝে উঠতে পারিনা।
-কেমন আছ পরী? পাশের কেবিন থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো। কেউ উত্তর দিলনা। -তোমাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে।
দেখো তোমার জন্যে গোলাপ এনেছি। আজ সকালেই পাশের বাসার বাগান থেকে চুরি করেছি। বলে লোকটা একা একাই হাসতে লাগলো। -আমাদের বিয়ের পর আমাদের বাসার সামনে একটা গোলাপের বাগান করবো। তোমার পছন্দের সব রংয়ের গোলাপ থাকবে বাগানে।
আচ্ছা তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো? আমার মনে হলো লোকটা পাগল। একা একাই কথা বলে চলেছে। কয়েক সেকেন্ড পর খুব সুন্দর কন্ঠে ওয়েস্টলাইফের "i wanna grow old with u" গানটা গাইলো। তারপর প্রোপজ করলো। কাকে করলো কে জানে।
নীরাবতা ছাড়া তার কোন উত্তর ছিলনা।
7. রাত ১০ টা। বাথরুমে যাওয়ার দরকার ছিল। একাই একাই যেতে চাচ্ছিলাম। বাথরুমটা ঠিক কোথায় মনে করার চেষ্টা করলাম।
কেবিন থেকে বেরিয়ে ৩০ ডিগ্রি বেঁকে ১০ কি ১২ পা সামনে। কিন্তু ভয় হচ্ছিল ছেলেদের বাথরুমে না ঢুকে যদি মেয়েদের টায় ঢুকে যাই! সব যুক্তি,চিন্তা আর দুশ্চিন্তা গুলোকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম। হাতড়ে হাতড়ে অন্ধকার কেবিনটার দরজা পর্যন্ত পৌঁছালাম। কিন্তু দরজার সামনের ম্যাট পর্যন্তই আমার যাত্রা পথের সমাপ্তি ঘটলো। কিভাবে যেন পড়ে গেলাম।
একটা মৃদু আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলাম। কেউ শুনেছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। হঠাত দুটো কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম। হাত দুটো আমাকে ধরে আমার পায়ের উপর দাড় করালো।
-আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। নার্সকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু কৃতজ্ঞতা বোধটাকে চেপে রাখলাম। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাইলাম না।
হাত ধরে আমাকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে গেল নার্স। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো আমার জন্যে। বাথরুম থেকে বেরোবার পর আবার কেবিন পর্যন্ত পৌঁছে দিল। -গুড নাইট। গলাটা চিনতে খুব বেশি দেরী হলোনা আমার।
-আপনি? -আপনাকে পড়ে যেতে দেখেছিলাম। শান্ত কন্ঠে বলল মেয়েটা। -আমি একাই যেতে পারতাম। আবারো মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে চাইলাম না। অতি কষ্টে রাগটাকে দমন করলাম।
8. বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিলাম। রাতটা যেন শেষই হতে চাচ্ছিল না। কিছুক্ষনের জন্যে আমি চোখ বন্ধ করি,একটু পর আবার খুলে ফেলি। আমার চোখ বন্ধ বা খোলা রাখার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। প্রতিবারই গাঢ় কালো অন্ধকার।
মাঝে মাঝে আমার যেন কি হয়। "আমি ফাইট করতে জানি "বলে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকি। চিৎকার করে কাকে বলি ঠিক জানিনা। প্রতিবারই ভেতর থেকে কিছু একটা প্রত্যুত্তরে বলে ওঠে,"তুই আর কখনো ফাইট করতে পারবিনা "মাঝে মাঝে আমি কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ি।
মা থাকলে বোধ হয় ঘুম পাড়িয়ে দিত। 9. আমার পরের সকালটা শুরু হলো সেই পাগল লোকটার একাকী উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা শুনে। মাঝে মাঝে ডাক্তার আসে,আমাকে দেখে আর কিছু না বলে চলে যায়। মা আমাকে সবসময় হাসি খুশি রাখতে চায়। বন্ধুরা আসে,আমাকে দেখে যায়।
আমাকে হাসাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই বিফলে যায়। 10. -কাল রাতে আমি চলে যাওয়ার পর আপনি আবার চিৎকার করছিলেন। তখন রাত ২ টা। আমি বিছানায় বসেছিলাম।
কেন জানি আমার এই একাকী নিঃসঙ্গ রাতগুলোতে মেয়েটার সঙ্গ আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। -আপনি কি ঘুমান না? -ঘুমাবোনা কেন?ঘুমাই। আপনি বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সেই শব্দেই তো ঘুম ভেঙ্গে গেল। হাসলো মেয়েটা।
হাসিটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। পাগল লোকটার কথা মনে পড়তেই বললাম, -তাহলে তো মনে হয় আমি অন্য সবাইকেও জাগিয়ে দিয়েছি। মেয়েটা আবার হাসলো। অদ্ভুত! -হাসছেন কেন?হাসার মতো কিছু বলেছি? -যদি সবাইকে জাগাতে পারতেন তাহলে তো ভালই হতো। আপনার পাশের কেবিনের মেয়েটা প্রায় এক বছর হলো কোমায় আছে।
-মেয়ে?কিন্তু আমি তো প্রতিদিন একটা লোকের কন্ঠ শুনি। লোকটা খুব সম্ভবত পাগল। -পাগল হবে কেন?মেয়েটা উনার প্রেমিকা। বুঝেছেন? -হুম বুঝলাম। -ইনগেজমেন্ট হয়েছিল ওদের।
শুনেছি গত এক বছরে এমন একটা দিন নেই যেদিন লোকটা আসেনি। হাল ছাড়েনি এখনো। আস্তে হেসে উঠলাম আমি। -বিশ্বাসে দুনিয়া চলেনা। লোকটা বিশ্বাস করেছে বলেই কি মেয়েটা ভাল হয়ে যাবে?ওসব সিনেমাতে হয়,বাস্তবে না।
এসব বিশ্বাস কোন কাজের না। ফালতু সময় নষ্ট। -এটা ভালবাসা। আর ভালবেসে সময় নষ্ট করার একটা আলাদা আনন্দ আছে। একটা ফুলের কয়েকটা পাঁপড়ি ঝরে পড়লেও সেটা কিন্তু ফুলই।
-কিন্তু সেটা তো অসম্পূর্ণ। ঝরা পাঁপড়ি গুলো কিন্তু আর কখনো ফিরে আসেনা। -আসেনা। কিন্তু ওভাবেই ফুলটাকে ভালবাসতে হয়,ভালবাসতে শিখতে হয়। কঠিন মর্ম যুক্ত শক্ত কথাটা হজম করতে একটু সময় নিলাম।
-আপনি কি নার্স? হাসলো মেয়েটা। সবকিছুতে মেয়েটার হাসার একটা বিরক্তিকর স্বভাব আছে। -না। আমি আপনার মতোই এখানকার একজন রোগী। মেয়েটার কিছু হয়েছে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছিল।
কেন লাগছিল জানিনা। -কি হয়েছে আপনার? -তেমন কিছু না। আমি কয়েকদিন পরই এখান থেকে ছাড়া পেয়ে যাবো। -ও!যান,চলে যান। আপনার জীবন আপনার অপেক্ষায় আছে।
আমি এভাবেই পড়ে থাকবো। মেয়েটা চুপ করে ছিল। বোধ হয় কিছু একটা ভাবছিল। -জানেন আমি মার্শাল আর্ট জানি। কিন্তু আমি আর কখনো ফাইট করতে পারবোনা।
যুদ্ধে অন্ধ সৈনিক কোন কাজে লাগেনা। আবারো হাসলো মেয়েটা। রেগে গেলাম আমি। -সবকিছু আপনার কাছে খুব সহজ মনে হয় তাইনা?? -অবশ্যই না। আপনি তো অনেক শক্ত মানুষ তাইনা? প্রচন্ড অস্থির হয়ে গেলাম আমি।
কি উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না। -অন্য কারো সাহায্য চাইতে আমার ভাল লাগেনা। মনে হয় আমার নিজে কিছু করার সামর্থ্য নেই। কারো করুণা পেতে ইচ্ছে করেনা। -তাতে ক্ষতি কোথায়?আমি অ্যাকসিডেন্ট টার কথা শুনেছি।
আপনি অনেক সাহসী মানুষ। আপনার মা আপনাকে নিয়ে অনেক গর্ব করে। আবারো হাসলো মেয়েটা। এতে হাসার কি আছে বুঝতে পারলাম না। মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো আমার।
কি মনে করে ও নিজেকে?আমাকে লেকচার দিতেই বা আসে কেন? -খুব হাসি পাচ্ছে তাই না?ভাবছেন,বেচারা অন্ধ,সব সময় নিজেকে প্রমানের ব্যার্থ চেষ্টায় ব্যাস্ত। -আমি মোটেও তা ভাবছিনা। -আপনি এখান থেকে কিছুদিন পর চলে যাবেন। আমিও যাবো। শুধু আমার এই কষ্টটা,এই যন্ত্রণাটা আমার পিছু ছাড়বেনা কখনো।
আমার পৃথিবীটা সবসময় অন্ধকারই থাকবে। কখনো ভেবে দেখেছেন কেমন লাগে?আমার মতো চোখ বন্ধ করে সব কিছু হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে দেখেন। আর সারা জীবন এভাবেই কাটানোর কথা চিন্তা করেন। আস্তে আস্তে মেয়েটা বলল, -আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তার জন্যে আপনি সবার সাথে রাগারাগি করবেন? -চলে যান এখান থেকে,চলে যান।
চিৎকার করতে শুরু করলাম আমি। কেউ তখন আমাকে কুকুরের সাথে তুলনা করলে হয়তো ভুল করতো না। মেয়েটা চুপ করে ছিল। একটু পর দরজা খোলার শব্দ পেলাম। ঝটকা বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগলো।
সেই মিষ্টি গন্ধটা। -পৃথিবীর সব দুঃখ,কষ্ট শুধু আপনার একার জন্যে না। এটা আপনার বোঝা উচিত। আমি কিছু বলতে পারলাম না। এর উত্তর আমার জানা ছিলনা।
কয়েক সেকেন্ড পর সশব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর হঠাত চিন চিনে একটা ব্যাথা শুরু হলো। এই ব্যাথাটা আবার কোত্থেকে এলো বুঝতে পারছিলাম না।
11. পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো সেই লোকটার কন্ঠ শুনে,যাকে আমি পাগল ভাবতাম। চোখ খুলতেই সব সময়ের মতো চারপাশে দেখলাম কালোর ছড়াছড়ি।
নিজের ভাগ্যকে গালি দেয়া ছাড়া আমার আর বিশেষ কিছু করার থাকেনা। একটু পর খেয়াল করলাম কোত্থেকে যেন একটা সুগন্ধ আসছে। মা বোধ হয় আজকে সকাল সকাল এসেছিল। আমার জন্য ফুল রেখে গেছে। কি ফুল বুঝতে পারছিনা।
11. -শুভ জন্মদিন পরী। কেউ কোন উত্তর দিলনা। লোকটা কন্ঠে উত্তেজনা এনে বলল, -জানো কি হয়েছে?বাবা তোমার জন্য এই কবিতার বইটা গিফট করেছে। তোমার প্রিয় কবিতার বই। তুমি বলেছিলে বাবা আমাদের কোনদিন মেনে নেবেনা।
কিন্তু দেখো,বাবাও আমাদের শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছে। লোকটা কয়েক মুহূর্ত বিরতি দিল। যেন সে কারো উত্তরের অপেক্ষায় আছে। -তুমি আমার সাথে কতদিন কথা বল না। আমাকে ভুলে যাওনি তো?আচ্ছা তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো? যে প্রশ্নগুলো সে সব সময় করে সেগুলোই করছিল।
লোকটা অনেকক্ষন হলো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কি হলো বুঝতে পারছিলাম না। লোকটা কি কাঁদছে। নাকি বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছেনা। ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কিছু আমার কানে আসছিলনা।
আমি অপেক্ষা করছিলাম।
লোকটা হঠাত শব্দ করে কেঁদে উঠলো। আমার মনে হলো এ কান্না দুঃখের নয়,আনন্দের।
-হে আল্লাহ!আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। -আমি জানতাম চোখ খুলে আমি প্রথম তোমাকেই দেখবো।
একটা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম। মেয়েটার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তারপর ও বলছিল। আমি কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। নিজের হ্নদ স্পন্দন গুলো বেশ ভালভাবেই শুনতে পাচ্ছিলাম।
-থ্যাংক্স,আমাকেএতোটা ভালবাসার জন্যে। লোকটা কাঁদছিল। সাথে মেয়েটাও। এ কান্না আনন্দের কান্না। ডাক্তাররা আসলো।
মেয়েটার পরিবারকে জানালো। হাসপাতালের অনেকেই এলো মেয়েটাকে দেখতে। আমিও অনেক খুশি হয়েছি। তবে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি। নিজের ধ্যান ধারনা বিশ্বাস প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে।
12. পাশের কেবিনের আনন্দ উৎসব শুনছিলাম। হঠাত একটা নারী কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম। আমার রুমে নার্স ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলাম, -কি হয়েছে?চিৎকার করলো কে? -ওইতো ওই মেয়েটার মা। উনি যতবার মেয়েকে দেখেন ততোবারই এমন চিৎকার দিয়ে ওঠেন,যেন প্রথম বার দেখলেন। মেয়ের এতো বড় ক্ষতির শোকটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
-কোমায় থাকা মেয়েটা? -না না। ও না। ওই মেয়েটা যার সাথে আপনি কাল রাতে গল্প করছিলেন। অজানা একটা ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম, -কেন,কি হয়েছে উনার? -আমি ভেবেছিলাম আপনি জানেন।
-আমি জানিনা। ও আমাকে কখনো বলেনি। দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়লো নার্স। -ওর অফিসের বস ওর মুখে এসিড মেরেছিল। লোকটা প্রায়ই ওকে অশ্লীল প্রস্তাব দিতো।
ও রাজি হয়নি তাই রেগে গিয়ে জানোয়ারটা..... কয়েক সেকেন্ড থামলো নার্স। তারপর আবার শুরু করলো। -মেয়েটা যখন এখানে প্রথম এসেছিলো তখন অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মুখে রক্ত আর মাংস ছাড়া কিছুই ছিলনা। ওর মা এখনো মাঝে মাঝে ওকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়।
মেয়েটা প্রথমেই একটা চোখ হারিয়েছিল। আর একের পর এক অপারেশন করায় অন্য চোখটাও নষ্ট হতে বসেছে।
আমার মনে হলো আমার শরীরটা অবশ হয়ে আছে। একটা কথাও বেরলোনা আমার মুখ থেকে। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ঘামছি আর একই সাথে কাঁপছি।
-আজকে ওর ২২ তম অপারেশন। জানিনা আরো কতগুলো লাগবে। ওর মুখটা এখনো দেখার মতো হয়নি। ছোটরা ওকে দেখলেই ভয় পেয়ে যায়। মেয়েটার না আছে চোখ,না আছে দেখার মতো কোন নাক বা কান।
ভাবতেই কেমন ভয় লাগে। -আমার ভেতরটা কেমন জানি শুন্য শুন্য লাগছিল। মেয়েটাকে কত কিছু বলেছি। কত খারাপ ব্যাবহার করেছি। ও নিঃশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছে।
পৃথিবীর সব দুঃখ কষ্ট আমার একার নয়। ও আমার চেয়ে অনেক বড় ফাইটার। অনেক বড়। -অপারেশন শেষ হলে আমাকে ওর কাছে একটু নিয়ে যেতে পারবেন?আমি ওর সাথে একটু কথা বলবো। -হ্যাঁ পারবো।
মেয়েটা অনেক ভাল। সব সময় হাসি খুশি থাকে আর সবার সাথে খাতির। অপারেশন বিকেলে শেষ হবে। চাইলে রাতেই ওর সাথে দেখা করতে পারবেন।
13. আমি সারাদিন আর কারো সাথে কথা বললাম না।
মাঝে মা একবার এসেছিল। টেবিলের উপর রাখা ফুল গুলোর কথা জিজ্ঞেস করলো। প্রতিটা ফুলেরই নাকি কয়েকটা করে পাঁপড়ি নেই। তবুও ফুল গুলো তাদের সৌরভ ছড়াতে কৃপণতা করছেনা।
হঠাত টের পেলাম আমি মেয়েটাকে মিস করছি।
ওর শান্ত নদীর স্রোতের মতো শান্ত কন্ঠ,ওর মিষ্টি হাসি। মনে মনে ওর একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। না পারলেও চলবে। ও সুন্দর কি অসুন্দর তাতে কিছু এসে যায়না।
14. অবশেষে রাত হলো। নার্স আমাকে মেয়েটার কেবিনে এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। আমি একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলাম। -তো। কেমন আছেন?অপারেশন কেমন হলো? -অপেরাশন আবার কেমন হয়!আমি তো সিরিঞ্জ দেখলেই ভয় পাই।
অজ্ঞান ছিলাম তাই কিছু টের পায়নি। -আপনি আমাকে কখনো বলেন নি। কেন? অভিযোগের সুরে বললাম আমি। আমার কন্ঠে অভিযোগটা কি ও ধরতে পেরেছে! -আমি ফাইট করতে জানি। আমি নিজেই সব কিছু করতে পারি।
আমি কারো করুণা চাইনা। মেয়েটা আমার মতো কন্ঠ করে বলার চেষ্টা করলো। না হেসে পারলাম না। -কয়েকটা পাঁপড়ি ঝরে পড়লো তাহলে? -সবগুলো পাঁপড়িই বলতে গেলে। এত কিছুর পর ও মেয়েটার কোন পরিবর্তন নেই।
এখনো আগের মতোই শান্ত,নরম সুরে কথা বলছে। আমি অবাক হলাম না। আর অবাক হইনা। -আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। -হ্যাঁ বলেন।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম, -আপনি আমার দেখা সব চেয়ে সুন্দর মেয়ে। ও সামান্য হাসলো। -দেখলেন কিভাবে? বিপাকে পড়ে গেলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। -সুন্দর হয়তো ছিলাম।
এখন আর নেই। -সব সময়ই থাকবেন। আমি হাসলাম। ভাবলাম,মেয়েটাও কি হাসছে? -আমি আপনাকে পছন্দ করি। আপনার মতো কেউ আমাকে হাসাতে পারেনা।
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো কথাটা। কিন্তু মনে হলো না আমি কোন ভুল করেছি। -হুমমম। আমিও আপনাকে অনেক পছন্দ করি। আপনিই একমাত্র মানুষ যে আমাকে চেনে অথচ আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়নি।
আমি আবার হাসলাম। কিন্তু এবার আমি জানতাম,আমার সাথে মেয়েটাও হেসেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।