আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার সেকাল একাল



বাংলাদেশকে বিদায় জানিয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বী এক ব্যাক্তির দেশত্যাগের প্রস্তুতিকালে তার সাথে আলাপ হচ্ছিল । কথার এক পর্যায়ে তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, তাঁর বাবা,দাদাসহ সব আত্মীয়স্বজন এক-এক করে এ দেশ থেকে বিদায় নিলেও কেবল তিনিই পড়ে ছিলেন তাঁর এই জন্ম-জন্মান্তরের মাটি কামড়ে। কিন্তু অতি সম্প্রতি তার এলাকায় হিন্দু পরিবারের ওপর ভয়ংকর সহিংসতার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনিও বিদায় জানাবেন বাংলাদেশকে। বলেছেন, তিনি চলে গেলে বংশানুক্রমে একটা পরিবার যে এই দেশে জীবন-জ্ঞাপন করেছিল,তার আপাত আর কোন চিহ্নই থাকবেনা। তবে একটা গোপন অদৃশ্য চিহ্ন থেকে যাবে,যার খবর জানেন শুধু তিনি নিজে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী তার বড় ভাইকে হত্যা করে সমাহিত করছে এ দেশেরই কোন এক গনকবরে। সেই ভাইয়ের অস্থি মাংস মিশে আছে এ দেশের মাটিতে। সদলবলে দেশছাড়া হলেও এদেশে তাঁর পরিবারের বসবাসের চিহ্ন হিসেবে পেছেনে ফেলে রেখে যাচ্ছেন তার ভাইয়ের দেহাবশেষ । এই বিদায়ী মানুষ প্রসঙ্গে ফিরব। তার আগে প্রসঙ্গক্রমে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ বিষয়ে আমার পরিচিত আরেক ভদ্রলোকের (পেশায় শিক্ষক) কিছু ব্যাক্তিগত মতামত তুলে ধরলাম ।

তিনি বলেছেন, তার ইঞ্জিনিয়ার বাবার চাকরিসুত্রে সত্তরের দশকের গোড়ায় তাঁরা ছিলেন সিলেটের শাহজিবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাহাড়ি অরণ্যক এক স্থানে । সেই স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সন্তানদের জন্য স্থাপিত প্রাইমারি স্কুলেই উনার পড়াশুনা শুরু । সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামপদ চক্রবর্তী উনার গৃহশিক্ষকও ছিলেন । ঐ শিক্ষকের তত্বাবধানে শাহজিবাজারের মতো এক অখ্যাত স্কুল থেকে দেশব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। রামপদ চক্রবর্তীর কাছ থেকে প্রথম পাঠ নিয়ে এরপর তিনি দেশ-বিদেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্টানে সবোর্চ্চ ডিগ্রি নিয়ে অধ্যাপনা করেছেন বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উনার ইঞ্জিনিয়ার বাবা পঞ্চাশের দশকে ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে (যা পরবর্তীকালে বুয়েট হয়) ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন । উনার বাবা নাকি তার শিক্ষার ঋণের কথা বলতে গিয়ে বার-বার বলেন তাঁর প্রথম জীবনের শিক্ষক জামালপুরের নান্দিনা হাইস্কুলের নলিনীমোহন দাশ(মাখন বাবুর) এর কথা । সেই শাহজির বাজারে থাকতেই তার মা ম্যাট্রিকের পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার । দ্বিধান্বিত ছিলেন । তাঁকে সাহস দিয়ে পড়াতে এগিয়ে এসেছিলেন হবিগঞ্জ কলেজের শিক্ষক মনমোহন চক্রোবর্তী।

বলেছিলেন ‘সাহস রাখো মা,তুমি পারবে’। মনমোহন বাবুর সেই উৎসাহে/সাহসে ভর করে উনার মা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে পরবর্তীকালে গ্র্যাজুয়েশন,মাস্টার্স করে ঢাকার একটি কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পর অবসর নিয়েছেন। তার দাদা রইসোদ্দীন আহমদ তুখোর ইংরেজী লিখতেন। দাদা গর্বের সঙ্গে বলতেন সরীষাবাড়ীর পিগনা হাইস্কুলের তাঁর ইংরেজী শিক্ষকের কথা। নাম ধনঞ্জয় সরকার কি-না ঠিক তার মনে পড়ছিলো না ! কিন্তু তিনি নিশ্চিত যে সেই শিক্ষক হিন্দু ধর্মাবলম্বীই ছিলেন ।

কৃষকের সন্তান তার দাদা ইংরেজী শিখে ল্যান্ড সার্ভেয়ার হয়েছিলেন । দেখতে পাচ্ছি উনারা কয়েকপুরুষ যে পেশা নিয়ে বেচেঁবর্তে আছেন তার মূল পুজি হচ্ছে শিক্ষা, আর পুরো পরিবারে এই শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছে হিন্দু শিক্ষকদের হাতেই । এবার একটু ভালো করে খোঁজখবর নিলে দেখতে পাবেন এই কাহিনী শুধু উনার পরিবারের নয়, এই অঞ্চলের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান পরিবারের ইতিহাসও তাই। হিন্দু শিক্ষকদের কাছে বিদ্যাশিক্ষা নিয়েই তারা পা রেখেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে। বলা বাহুল্য,এর একটা ঐতিহাসিক কার্যকারণ রয়েছে।

ব্রিটিশরা যখন পাকিস্তান-ভারতে বিজ্ঞান ও ইংরেজী শিক্ষা চালু করেছিল,তখন হিন্দু সম্প্রদায় তা সাদরে গ্রহন করলেও এখানখার রক্ষনশীল মুসলমানরা ধর্মীয় গোড়ামির কারনে প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে অগ্রাহ্য করে । তাছাড়া বহিরাগত কিছু মুসলমান ছাড়া নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান ছিলেন দরিদ্র কৃষক, ফলে তাদেঁর শিক্ষার সুযোগও ছিল কম। মুসলমান সম্প্রদায় যখন আধুনিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ অনুভব করলো তখন তাদের স্বভাবতই নির্ভর করতে হয়েছে শিক্ষায় অগ্রসর হয়ে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরই। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ যখন স্বাধিকারের আন্দোলন শুরু করে, তখন পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতারা এর জন্য মূলত দায়ী করেছিলেন হিন্দু শিক্ষকদেরই!! তাঁরা এই ধারণা পোষন করতেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের নানা স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে থাকা হিন্দু শিক্ষকরাই নানা রকম বাঙালিয়ানার শিক্ষা দিয়ে এদের যথার্থ মুসলমান হওয়ার পথকে বাধাগ্রষ্থ করছেন। আইয়ুব খানের আত্মজীবনী থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের জবানিতে এ ধারনার প্রচুর প্রমান পাওয়া যায় ।

ফলে এটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, একাত্তরে হিন্দুদের, বিশেষ করে হিন্দু শিক্ষকদের হত্যা করার ব্যাপারে পাকিস্তানিরা ছিল খুবই তৎপর । যার ধারাবাহিকতা পাকিস্তানপন্থীরা এখনও বজায় রেখেছে । পরবর্তীকালে উনি নাকি নেহাত কৌতুহলে উনার আর উনার বাবার সেই শিক্ষক ও তাদের পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন, তারা গত হয়েছেন আর তাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য শুরুতে উল্লেখিত সেই ব্যাক্তির মতোই বাংলাদেশকে বিদায় জানিয়ে আস্তানা গেড়েছেন নানা দেশে । পরিসংখ্যানও এইবাস্তবতার সত্যতা জানাচ্ছে আমাদের । স্বাধীনতার পর এদেশে হিন্দু সম্প্রদায় জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ থাকলেও ২০১০সালে এসে সেটা অর্ধেকে নেমে দাড়িয়েছে ৮শতাংশে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অনগ্রসর বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় একসময় যে হিন্দুদের কাছ থেকে শিক্ষা-দীক্ষার পুষ্টি নিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের রয়েছে ব্যাপক আত্মত্যাগ,তাদের এই স্বাধীন দেশ থেকে ঝাড়ে বংশে বিদায় করার প্রক্রিয়াটা অব্যাহত রাখা হয়েছে। কী কারনে? “এ দেশে থাকলেও হিন্দুদের এক পা সব সময় থাকে ভারতে”-এ রকম একটা ধারণা প্রচলিত দেখা যায় অনেক বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। “হিন্দুরা এ দেশে তৈরী সম্পদ গোপনে ওই দেশে পাচার করে একসময় কাউকে না জানিয়ে নিজেরাও চলে যায়” এরকমই বলেন অনেকে। তাদের ধারণার সত্যতার বিচার করার আগে যাঁরা এমন ধারনা পোষন করেন তাদের প্রতি সহজ-সরল প্রশ্ন জাগে, কী কারনে, কোন বেকুবিতে একজন মানুষ তাঁর বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছেড়ে গোপনে চলে যাওয়ার কথা ভাবেন ? তার উত্তর আছে কি ? অভিবাসনের সুত্রানুযায়ী মানুষ দেশ ছাড়ে, হয় ‘পুশ’ না হয় ‘পুল’ ফ্যাক্টরে। হয় অন্য দেশ তাকে টানে, নয়তো নিজ দেশ তাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়।

এ দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দীর্ঘদিনধরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটা সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরী করে হিন্দুসহ অন্য সংখ্যালঘুদের যে এক চরম প্রান্তিক, অনিরাপদ অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে তার একাধিক প্রমান রয়েছে বিভিন্ন গবেষনায়, নথিপত্রে,ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায়। অনিশ্চয়তার প্রান্তে ঠেলে দেওয়া যখন সহিংসতায় রুপ নেয়, তখন বাচাঁর সবচেয়ে সুলভ উপায় সীমানা পেরিয়ে নিকটবর্তী দেশে চলে যাওয়া। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের দেশত্যাগকে নেহাত বিশ্বাসঘাতকতা বলে চালিয়ে দেয়ার কোন অবকাশ নেই। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলের হিন্দুদের ঐতিহাসিক আধিপত্য এবং মুসলমানদের অধ:স্তনের প্রসঙ্গ আসে । আমরা জানি হিন্দু-মুসলমানের এই বৈষম্য ঘোচানোর আশায় জন্ম হয়েছিল মুসলসানদের দেশ পাকিস্তান।

কিন্তু শুধু ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তি যে আধিপত্যকে ঘোচায় না, তারর প্রমান ঘটে গেছে পাকিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্রের মৃত্যূর মধ্য দিয়ে । আধিপত্যের ইতিহাস ঘেঁটে যদি আরও পেছনে যাই, তো দেখবো যে হিন্দু আধিপত্যের আগে এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ছিল মুসলিম মোঘলদের আধিপত্যও। এভাবে শুধু ধর্মের পরিচয়কে আত্মপরিচয়ের মূল সূত্র ধরলে এবং সংখ্যাকে সেই পরিচয়ের ভিত্তি করলে তা কত বর্বর,নৃশংস পরিণতি আনতে পারে তার অভিজ্ঞতা ইতিহাসের নানা পর্বে রয়েছে। কথা সত্য যে আজকের পৃথিবীতেও নানা দেশের সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও; কিন্তু পাশাপাশি সেসব বৈষম্য ঘুচিয়ে একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠার অব্যাহত চেষ্টার উদাহারণও পৃথিবীতে অগনিত । আছে সফল উদাহারণও ।

আমরা কোন পথ নেব সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকেই । মানুষ তো আর অ্যামিবা নয় যে নিজেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিকশিত হবে, মানুষের বিকাশ ঐক্যেই । সেই ঐক্যের জয়গানই এ অঞ্চলে ধ্বনিত হয়েছে বহুকাল। এ অঞ্চলের সুফি সাধকরা নানা ধর্ম-জাতির ঐক্যের কথা বলে গেছেন শত শত বছর আগে । ইউরোপে যখন ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্টদের তুমূল হানাহানি সে সময় এ মাটির সন্তান লালন গেয়েছেন “জাতির ফাৎনা ডুবিয়েছি সাত বাজারে “।

এছাড়া খোদ ইসলামের ভেতরই তো রয়েছে নানা মত,পথ । কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সুবিধাবাধী ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির চোরাপথে বাংলাদেশে উগ্র, নৃশংস, পশ্চাৎপদ একটা ধারা সাম্প্রতিক কালে বেশ সেচ্চার হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হলেও এ দেশে হবে জাতি-ধর্ম-বর্ন নিবিৃশেষে সবার জন্য নিরাপদ । এমনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি । মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভাইয়ের দেহাবশেষ পেছনে ফেলে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষটি বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন, তাকে কি এটুকু স্বান্ত্বনা দেওয়া যায় যে, তার ভাইয়ের মতো মুক্তিযুদ্ধের অগণিত মানুষের রক্ত অস্থির শপথ নিয়ে মাঠে নামা তরুন প্রজন্ম, তারা দেশে ধর্মের নামে যাবতীয় মধ্যযুগীয় তৎপরতা ঠেকিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সফল হয়ে আপনাকে আবার দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানাবে এমন বিশ্বাস রাখার ??


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।