আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৭১ এ ঢাকার গেরিলা অপারেশনগুলো। পর্ব ১২- অপারেশন “স্টেট ব্যাংক ২” এবং “ডি.আই.টি!

আমি দুয়ার খুলে বের হয়ে জোছনা ধরতে যাই। আমার হাত ভরতি চাঁদের আলো ধরতে গেলে নাই!

স্টেট ব্যাংক এর [২০ অক্টোবর ১৯৭১] অপারেশন এ গেরিলা ছিল ৫ জনঃ নজমুল, সাদেক, আমান, জসীম এবং ওই ব্যাংক এর একজন কর্মচারী। এই অপারেশনে তাঁদের কাছে ছিল ৮ পাউনড পি.কে। ব্যাংকের সেই বন্ধুটির কাছ থেকেই গেরিলারা জানতে পারে যে ৬ তলায় কয়েকজন পাকি কমান্ডো অবস্থান করছে যারা দুপুরে ঘরেই থাকে। সেজন্য গেরিলারা রেকি করবার পরে সিদ্ধান্ত নেয় যে দুপুরেই বিস্ফোরণ ঘটানো হবে।

একটি ব্রিফকেসে সাজানো হয় পি.কে চার্জ, ৭ মিনিটের ফিউজ ওয়্যার এবং একটি গ্রেনেড-৩৬। নির্ধারিত সময়ে গেরিলারা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং পাম্প শু পরে স্টেনগান লুকিয়ে গেটের অদূরে অপেক্ষা করতে থাকে। সাদেক, আমান এবং জসীম গাড়িতে করে বিস্ফোরক নিয়ে তাঁদের ব্যাংক এর বন্ধুর হাতে দেয় এবং সে সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে যায়। বাথরুম এ গিয়ে ফিউজ ওয়্যার এ ইগনাইট করলে কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয় আর নিহত হয় ২ পাকি গেরিলা। দ্বিতীয়বারের মতো স্টেট ব্যাংক এর অপারেশন সফল হয়।

ডি. আই. টি অপারেশন [২৮ অক্টোবর, ১৯৭১] ছিল গেরিলাদের অন্যতম সফল একটি অপারেশন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এই দুর্ধর্ষ অপারেশন সফল করেছিল দুজন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ঃ জন আর ফেরদৌস এবং তাঁদের সহায়তা করেছিল ডি. আই. টি এর কর্মচারী মাহবুব আলী। তাঁদের মুল পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন টেলিভিশন স্টুডিও এর এন্টেনা টাওয়ারটি কাটিং চার্জ করে ফেলে দেয়া। এই অপারেশনে ব্যাবহার করা হয়েছিল ঃ ১২ পাউনড পি.কে, ৬ ফুট ফিউজ ওয়্যার এবং একটি ডেটোনেটর। তৎকালীন টেলিভিশন স্টুডিও থাকবার কারনে এই ভবনের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল।

ভেতরে প্রবেশের জন্য প্রধান দুটো গেট এর মধ্যে খোলা থাকত একটি। এরপর ঢোকার সময় ছিল চেকিং ব্যাবস্থা। মূল ভবনে ঢোকবার মুখে ছিল চেকপোস্ট, দোতলায় উঠবার সিঁড়ি এবং লিফট এর কাছে ছিল আরেকটি চেকপোস্ট। প্রতি তলাতে সিঁড়ির মুখে ছিল চেকপোস্ট। এইভাবে ৬ টি চেকপোস্ট পেরিয়ে সাত তলায় পৌছুতে হয় এবং মূল অপারেশন এই সাত তলাতেই হয়েছিল।

দুজন গেরিলাকে ভবনে ঢুকবার জন্য পাস জোগাড় করে দেয় মাহবুব আলী। তাঁরা ৭ তলাতে রেকি করবার পরে হিসেব করে দেখে যে বিস্ফোরণের জন্য ১৬ পাউনড পি.কে প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে তাঁরা জায়গা মাপা এবং কাটিং চার্জ বসাবার জায়গা ঠিক করে ফেলে। ভবনের মধ্যে একেবারে ১৬ পাউনড পি.কে নিয়ে যাওয়া একটা ঝুঁকির ব্যাপার ছিল মাহবুব আলীর জন্য তাই ঠিক হয় প্রতিদিন অল্প অল্প করে পাচার করা হবে ভেতরে। অফিস যাবার আগে মাহবুব এর বাসায় গিয়ে জন মাহবুব এর পায়ে প্যান্টের নিচে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ বেধে দেয়।

সেই ব্যান্ডেজ এর নিচেই রাখা হয় ৮ আউন্স পি.কে। দু পায়ের পাতার নিচে জুতার ভেতরে আরও ৮ আউন্স পি.কে দেয়া হয়। এই জিনিসগুলো মাহবুব ভেতরে নিয়ে ভবনের ৭ তলার একটি পুরনো ফাইল এর আড়ালে লুকিয়ে রাখতো। এইভাবে মাহবুব ১২ দিনে ১২ পাউনড পি.কে বহন করে। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দিল।

তাঁরা খবর পেল ৭ তলার সেই ফাইলরুম গোছানোর পরিকল্পনা চলছে। খবর পেয়ে জন আর ফেরদৌস বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রস্তুতি নেয়। ২৮ অক্টোবর, ১৯৭১। মাহবুবের নকল ব্যান্ডেজ এর নিচে বেধে দেয়া হয় ৬ গজ ফিউজ ওয়্যার আর ফাউনটেনপেন এর মধ্যকার অংশ ফেলে দিয়ে খোলের মধ্যে ভরে দেয়া হয় একটি ডেটোনেটর। জন এবং ফেরদৌস এর অডিশনের নাম করে ২ টি পাস যোগাড় করা হল।

গেরিলা দুজন ওইদিন বেলা পৌনে একটায় ভেতরে প্রবেশ করে এবং ৬ তলা পর্যন্ত কোন ঝামেলা ছাড়াই চেকপোস্ট পার হয়। কিন্তু তাঁরা যখন ৭ তলাতে উঠলো তখন পুলিশ আটকালো। গেরিলারা বলল ওরা অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে বুড়িগঙ্গার পানি কতোটুকু বেড়েছে তা দেখবে। এ সময় অন্য লোক এসে পড়ায় পুলিশ ওদের ছেড়ে দেয়। এরপর তাঁরা নির্দিষ্ট জায়গাতে গিয়ে পি.কে একত্র করে।

জন চার্জ সেট করে এবং ফিউজ ওয়্যার এ ইগনিশন পয়েন্ট এবং ডেটোনেটর ফিট করে ফেরদৌস। বেলা ১-১২ মিনিটে ফিউজ এ অগ্নি সংযোগ করে গেরিলা দুজন। হাতে সময় মাত্র তিন মিনিট এবং এরই মধ্যে জন এবং ফেরদৌস ডি. আই. টি ভবন থেকে বেরিয়ে যায়। ওরা যখন স্টেডিয়াম এর বারান্দাতে পৌছুলো তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক কেপে উঠলো। এই বিস্ফোরণে টাওয়ার এর এক অংশে বিরাট ফোকর এর সৃষ্টি হয় এবং ৭ তলার মেঝেতে বিশাল গর্ত হয়ে যায়।

আগুন ৭ তলা থেকে ৬ তলাতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশ কিছু কাগজপত্র পুড়ে যায়। এটি ঢাকার অন্যতম আলোচিত এবং সফল গেরিলা অপারেশন ছিল। [চলবে] তথ্যসূত্রঃ সেলিনা হোসেন, "একাত্তরের ঢাকা", আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ১৯৮৯। ৭১ এ ঢাকার গেরিলা অপারেশনগুলো। ১৩ তম এবং শেষ পর্ব - অপারেশন “মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক” এবং “বায়তুল মোকাররম


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।