ঘন ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বেশ কিছু নারী মোমবাতি জ্বালিয়ে ধীর গতিতে সামনে এগোচ্ছে। এক একজন নারী তার নিজের সময়কে হাসি মুখে পার করে পিছনের নারীকে সামনে এনে তার আরেক হাতে নিজের মোমবাতির বাকি জ্বলন্ত অংশটুকু রেখে যাচ্ছেন। আলোকিত অন্ধকারের এই সময়ে জাপসা চোখে আমি দেখতে পাচ্ছি নারী জাগরণের প্রথম পথিকৃৎ রাস সুন্দরী দেবী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, নুরুন্নেচ্ছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী, আশালতা সেন, লীলা নাগ প্রমুখ। তবে আমার সময়ে স্পষ্টভাবে যাকে চলে যেতে দেখলাম তিনি বেগম সুফিয়া কামাল। আরেক নারীর হাতে নিজের মোমবাতিটি দিয়ে আমার সময়কে হাসি মুখে অতিক্রম করলেন ।
নারীমুক্তি, গণতন্ত্র ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা কবি বেগম সুফিয়া কামালের আজ ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি মারা যান। ১৯১১ সালের এই দিনে বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। রক্ষণশীল পরিবারে পর্দাপ্রথা অতি কঠোরভাবে পালিত হত। তাই বাড়িতে বসেই তিনি উদ্দু,আরবী, ফারসী ভাষা গৃহ শিক্ষকের কাছে আর বাংলাভাষা মা ও মামার কাছে শিখেছিলেন।
তার বয়স যখন সাত বছর তখন তাঁর পিতা নিরুদ্দেশ হন। পিতার অনুপস্থিতিতে মায়ের স্নেহ-পরিচর্যায় তিনি বড় হতে থাকেন। সুফিয়া কামাল তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার রক্ষণশীল পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্ঠায় হয়ে উঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। পর্দার ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে হয়ে উঠেন একজন আধুনিক মানুষ।
১৯১৮ সালে ছয় কি সাত বছর বয়সে মায়ের সাথে কলকাতায় বেড়াতে গেলে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাথে দেখা হয়। মায়ের সাথে রোকেয়া কথোপকথন এবং কলকাতায় মুসলিম নারী শিক্ষার সূচণা তাকে উৎসাহিত করেছিল। ১২ বছর বয়সে উদারমনা সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। ১৯২৩ সালে তার প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ তরুন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে মাহাত্মা গান্ধির সাথে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তখন থেকে তিনি জাঁকজমকপূর্ণ মোগল পোষাক পরিত্যাগ করে বাংলার সাধারন নারীদের মত তাঁতের শাড়ী পরা শুরু করেন।
এই সময়ে বরিশালে ‘মাতৃমঙ্গল’ নামক নারী কল্যাণ সংগঠনের সদস্য হলেন। কলকাতায় এসে তিনি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সানিধ্যে আসলেন। কাজী নজরূল ইসলাম তার কবিতার ভূয়ষী প্রসংসা করলেন এবং ছাপানোর বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত সওগাত পত্রিকায় ‘বাসন্তি’ নামক কবির প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবি ১৯২৯ সালে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রতিষ্ঠিত আনজুমান-ই-দাওয়াতীন-ইসলাম এ যোগদান করেন।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি যার ভূমিকা লিখেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন এবং ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি একাত্তরের ডায়েরী নামে একটি দিনলিপি রচনা করেন এবং এ সময়ে তাঁর লেখা কবিতাগুলি পরবর্তীকালে ‘মোর যাদুদের সমাধী’ নামে গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয় ।
সাহিত্য চর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরষ্কার ও সন্মাননা লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ নামক জাতীয় পুরষ্কার লাভ করেন কিন্তু পাকিস্তান সরকার বাঙালীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন।
এছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি পুরষ্কার ও পদক লাভ করেন--১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, ১৯৭৬ সালে একুশে পদক, ১৯৭৭ সালে নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, ১৯৯৬ সালে বেগম রোকেয়া পদক, ১৯৯৬ 1996 Women’s Federation for World Peace Crest, ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কার, ১৯৭০ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের Lenin Centenary Jubilee Medal এবং ১৯৮৬ সালে Czechoslovakia Medal সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করেন। সুফিয়া কামাল কবি, বুদ্ধিজীবি, সমাজনেত্রী এবং অনন্য সাধারন নারী ব্যক্তিত্ব। দেশের যে কোন মানবতাবাদী, প্রগতিবাদী ও গণমুখী কর্মসূচীতে তিনি সব সময় অগ্রভাগে ছিলেন। তাকে বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরী হিসাবেও অনেকে মনে করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।