আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৫৪ অটো এমপি : গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ

বিনা ভোটে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বগলদাবা করে নির্বাচনকালীন সরকারের আবরণে কার্যত লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং একদম খালি মাঠে গোল দিয়ে বিজয়ী (!) এমপি-নেতারা বলছেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা ও সংবিধান রক্ষার জন্য এই ভোটারবিহীন নির্বাচনের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলনকে তারা জঙ্গিবাদের উৎপাত বলে চিত্রিত করার প্রয়াস নিচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটা বিবেচনা করতে হবে সরকার কী বলছে বা সরকারি কলেরগানে কী সুর বাজছে তা দিয়ে নয়, সরকারের কোন্ কোন্ পদক্ষেপের কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বর্তমান কঠোর আন্দোলন কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হয়েছে তার সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ দিয়ে। বাধ্য হওয়ার কথা এ জন্যই বললাম, লীগ সরকারের স্বার্থান্ধ ও একগুঁয়ে সিদ্ধান্তগুলো যদি পরপর বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া না হতো তাহলে বিরোধী দল সহনীয় কোনো পথেও হয়তো হাঁটতে পারত। কিন্তু সম্ভবত অযোগ্য, অদক্ষ পরামর্শকদের ভুল পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার সে রকম কোনো পথ বিরোধী দলের সামনে খোলা রাখেননি।

এটা এখন নির্দ্বিধায়ই বলা চলে, পূর্ব-নির্ধারিত নীলনকশা অনুযায়ী সরকারপক্ষ বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যেই তাদের সিদ্ধান্তবলী চাপিয়ে দিয়েছে একের পর এক। জঙ্গিবাদ মোকাবিলা বা উৎখাতের যেসব মুখরোচক কথা তারা বলছেন, এসব মনে হয় তাদের কথার কথা। তাদের আচরণ বলে, জঙ্গিবাদের 'জুজুর' ভয় দেখিয়ে দেশ-দুনিয়ার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের স্বার্থে এ ইস্যুটি কাজে লাগানোর জন্য তারা এসব কথা বলছেন। ঘোষিত 'ভিশন-২০২১ কে' সামনে রেখে ক্ষমতা দখলে রাখার উদ্দেশ্যে যা যা প্রয়োজন তারা তা-ই করছেন। জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য সরকার নানা ক্ষেত্রে তাদের অর্জন নিয়ে বড়াই করছে।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে সাফল্যের দাবি করছে তারা। এটা সত্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশকে পেছনে ফেলেছে। বিশ্বমন্দার মধ্যেও জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড সৃষ্টিতেও তাদের গর্বের সীমা নেই। কিন্তু এর কোনোটিই কি লীগ সরকারের এই পাঁচ বছরের অর্জন? জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার কী এই লীগ আমলে শূন্য থেকে শুরু হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে? বেগম খালেদা জিয়ার সরকার বিদায় নেওয়ার সময় প্রবৃদ্ধির হার রেখে গিয়েছিল ৬ এর ওপর। এক সময় তা ৬.৭ স্পর্শ করেছিল।

মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলেও তা ৬ এর নিচে নামেনি। শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের আমলে এবার তা ৬ এর নিচে নামল। আসলে এই অর্জন ধারাবাহিক; অতীত সরকারগুলোরও এতে অবদান আছে। রিজার্ভ বৃদ্ধি সুস্থ অর্থনীতির লক্ষণ নয়। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই, ভারি যন্ত্রপাতি আমদানি বন্ধ, শিল্প বিকাশ রুদ্ধ।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে ঠিক, কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা একদিকে অপ্রতুল, অপরদিকে এ খাতে চলছে অবাধ লুণ্ঠন। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের খপ্পরে ফেলে বিদ্যুতের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে। তিনশ টাকার বিদ্যুৎ বিল দাঁড়িয়েছে হাজার টাকায়, হাজার-বারশ টাকার বিলের জায়গার এখন গুনতে হচ্ছে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা। অপরদিকে এই লুণ্ঠন বাণিজ্য করতে দেওয়া হয়েছে শাসক লীগের বাছা বাছা লোকদের। জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে রাতারাতি তারা হয়ে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক।

আর্থিক খাতে যা কিছু অর্জন তার সমুদয় কৃতিত্ব আমাদের দেশের বেসরকারি ব্যবসায়ীদের আর মানবসম্পদ খাতের উদ্যোক্তাদের। কোনোটিতেই সরকারের (কোনো আমলেই) কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির সূচনা বেগম জিয়ার প্রথম সরকারের আমলেই_ এটা অনস্বীকার্য। পরীক্ষায় নকল রোধে সদ্য-বিগত বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের কথা দেশের মানুষ মনে রাখবে আরও অনেক দিন। খাদ্য উৎপাদনেও কখনো কোনো সরকার বাহাদুরি করার মতো কোনো অবদান রাখে না।

এ ক্ষেত্রে সমুদয় কৃতিত্ব আমাদের কৃষক সমাজের। নারীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের সূচনা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সরকারের আমলেই_ তাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অন্যান্য ক্ষেত্রেও যা কিছু অর্জন তা পূর্ববর্তী সরকারগুলোর অর্জনেরই ধারাবাহিকতা। রাস্তাঘাট, দালানকোঠা নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ যে কোনো সরকারের রুটিন কাজ। এসব রাষ্ট্রের কাছ থেকে জনগণের প্রাপ্য।

সরকার রাষ্ট্রের 'ম্যানেজার' হিসেবে কাজগুলো সম্পাদন করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে। কারও পকেটের টাকায় উন্নয়ন হয় না। এ কাজগুলো করার জন্য জনগণ খাজনা-ট্যাঙ্ দিয়ে সরকার চালায়, মন্ত্রী-মিনিস্টার-উপদেষ্টা-এমপিদের বেতন-ভাতা দেয়, নামমাত্র দামে জমি আর প্লট দেয়, বিনা শুল্কে বিলাসী গাড়ি দেয়। লীগ সরকার এসব কাজের কৃতিত্ব নিচ্ছে। কিন্তু শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৩০ লাখ পরিবারকে পথে বসানোর, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার (অর্থমন্ত্রী এ মাল এ মুহিত বলেছেন, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না), ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, বিশ্ব ফাটানো পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির মতো বড় বড় দুর্নীতির কোনো দায় নিচ্ছে না সরকার।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊধর্্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, গুম, খুন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে বলে দাবি করছেন পর্যবেক্ষকরা। জনগণ তাই স্বাভাবিক করণেই দ্রোহী হয়ে উঠেছে এ সরকারের বিরুদ্ধে।

এ কথা আজ দিবালোকের মতো সত্য, বর্তমান লীগ সরকার কৃতকর্মের জন্য এতটাই গণবিচ্ছিন্ন যে, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন মোকাবিলা করার সাহসই হারিয়ে ফেলেছে তারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জনমত জরিপে স্পষ্ট হয়ে গেছে, শেখ হাসিনার শাসক লীগের জনসমর্থন এখন ৩০ শতাংশেরও নিচে।

অপরদিকে একা বিএনপির জনসমর্থনই ৫৫ শতাংশের ওপর। সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও নাকি একই বার্তা পেয়েছিল সরকার। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তখন থেকেই বিরোধী দলকে, বিশেষ করে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ফন্দি-ফিকির অাঁটতে থাকে সরকার। এই উদ্দেশ্যে সরকার দুটি বিষয়ে তাদের অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা, দ্বিতীয়টি নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি ছিল একটি মীমাংসিত বিষয়। সংবিধানের ৫৮ (খ) (গ) (ঘ) ও (ঙ) অনুচ্ছেদে তা সনি্নবেশিত ছিল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে লীগ সরকারের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে সংসদে দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসকলীগ সেই ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। উচ্চ আদালতের দোহাই দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনটি সরকারি দল সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে নিজেদের দলীয় স্বার্থে, দলীয় সুবিধা আদায়ের জন্য। উচ্চ আদালতের রায় সম্পর্কেও বিভ্রান্তিকর দুটি বক্তব্য প্রচার করা হয়।

(এক) উচ্চ আদালত এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের রায় দিয়েছেন, (দুই) উচ্চ আদালত এই ব্যবস্থাকে অবৈধ বলেছেন। এটা রায়ের ভগ্নাংশ। উচ্চ আদালত সংসদের অনুমতি সাপেক্ষে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তী আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে রায়ের অপরাংশে উল্লেখ করেছেন। লীগ নেতা-মন্ত্রীরা সে কথা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করছেন না। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের মৌল-চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তাকে অবৈধ বলেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে এও বলেছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তা আইনসম্মত।

জনগণের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ আইন। কিন্তু তা ইগনোর করেছেন সরকারি নেতারা। মূল সংকটের উদ্ভব হয়েছে এখান থেকেই। সর্বদলীয় মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানে সংযোজিত একটি মীমাংসিত বিষয়কে একদলীয় সিদ্ধান্তে বদলে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলের মতামত সরকারের জানা থাকা সত্ত্বেও সরকার তা আমলে নেয়নি।

বরং বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বাইরের রাখার কার্যকর কৌশল হিসেবেই সরকারপক্ষ তাদের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। দ্বিতীয়ত নির্বাচন কমিশনও তারা গঠন করেছে তাদের পছন্দের দলানুগত লোকদের সমন্বয়ে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সব দলের আলোচনা হয়েছিল। বিএনপিও তাতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তাদের কোনো সুপারিশের মর্যাদা দেওয়া হয়নি।

আলোচনা হয়েছে সবার সঙ্গে, কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণীয় ব্যক্তিদের নিয়ে। সার্চ কমিটি সার্চ করে শাসক লীগের লোকদের বেছে নিয়েছে। নির্বাচনী ফলাফল দলবিশেষের অনুকূলে নেওয়ার জন্য এ দুই প্রতিষ্ঠানের (সরকার ও নির্বাচন কমিশন) ভূমিকাই মুখ্য। তারা চাইলে পাঁচকে সাত, সাতকে পাঁচ বানিয়ে দিতে পারে। এ দুই প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য নিয়েই ক্ষমতাসীনরা মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারও হরণ করছে।

বর্তমানে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ধারা প্রায়ই অকার্যকর। সরকারি দলের লোক, সমর্থকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় সভা-সমাবেশ করছে, মিছিল-বিক্ষোভ করছে, কিন্তু বিরোধী দলের জন্য অলিখিতভাবে তা নিষিদ্ধ। বাইরে শাসনতান্ত্রিকভাবে কিছু করতে তো পারছেই না, রাজপথে নামলেই, এমন কি অফিসের কলাপসিবল গেট কেটে, বাসার দরজা ভেঙে গভীর রাতে (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত বিনা অনুমতিতে কারও গৃহে প্রবেশ সভ্যতা বর্জিত কাজ, বেআইনি) গ্রেফতারের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে সরকার। বিএনপি একটি নির্বাচনপন্থি দল। দীর্ঘদিন তারা ক্ষমতায় ছিল।

ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা তাদের তীব্র। নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকলে তাদের নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সব পথই সরকার সুচতুরভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্যই তারা আন্দোলন করছে। অর্থাৎ তাদের আন্দোলন নির্বাচনে যাওয়ার জন্য আন্দোলন।

জামায়াতে ইসলামীর এজেন্ডা ভিন্ন। এটা সবারই জানা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত তাদের নেতাদের বাঁচাতে চাইছে তারা। এ জন্য তারা সহিংস পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু তাদের সহিংস আন্দোলন-এজেন্ডার সঙ্গে বিএনপির নির্বাচন-এজেন্ডাকে সরকার একাকার করে জনগণকে এবং বিশ্ববাসীকে, বিশেষ করে জঙ্গিবাদ-বিরোধী লড়াইরত বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে, বিএনপিও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জঙ্গিবাদী পথ ধরেছে।

তাই তাদের যে কোনোভাবে প্রতিহত না করে উপায় নেই। জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে তারা সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের আন্দোলনকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে যেনতেনভাবে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনর্দখল করতে চাচ্ছে। বিএনপির দুর্বলতা হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ১৮ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় তাদের কর্মকাণ্ডের দায় এড়াতে পারছে না, আবার রাজনৈতিকভাবে এটা জনগণকে বোঝাতেও সক্ষম হচ্ছে না বা চাচ্ছে না, বিএনপি-জামায়াত দুটি পৃথক রাজনৈতিক দল, তাদের আদর্শ ও কর্মসূচি ভিন্ন, সত্তা ভিন্ন। জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা আর বিএনপির এজেন্ডা এক নয়। এটা যতদিন তারা পরিষ্কার করতে না পারবে ততদিন সরকার বিএনপির ঘাড়ে জঙ্গিবাদের দুর্নাম চাপিয়ে রাখার কৌশল প্রয়োগে সক্ষম হবে।

তবে এটা সহজবোধ্য যে, বিএনপি নির্বাচনে 'ঢুকে যাক' শাসক লীগ তা চায়নি। তাই সংলাপে তাদের কখনো আন্তরিক কোনো আগ্রহ ছিল না। ফোনালাপ ও পরবর্তী সবই নাটক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র ও শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের চাপে সংলাপ-নাটকও লোকদেখানো বলে মন্তব্য করছেন বিশিষ্টজনরা। ধারণা এখন অনেকটাই বদ্ধমূল যে, জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকোর ব্যর্থ মিশনের পর প্রধান দুই দলের 'সমঝোতা সংলাপ' আর একবার হলেও সেই বৈঠকটিই শেষ বৈঠক।

আর বোধহয় কোনো সম্ভাবনা নেই সংলাপের। নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহের মতোই কাজ করছে বলে বিরোধী দলের অভিযোগ এখন জনগণও বিশ্বাস করছে।

ইতোমধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে পাতানো ও নজিরবিহীন নির্বাচনের মূল পর্বটি সম্পন্ন হয়ে গেছে। সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত তারিখ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অনেক আগেই। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ জাতি জেনে গেছে, ৩০০ সংসদীয় আসনের ১৫৪টিতেই শাসক দল আওয়ামী লীগের এবং মহাজোটভুক্ত অন্যান্য দলকে দান করা প্রার্থীরা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী নেই।

ভোটার ও ভোটহীন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এদের বিজয়ী ঘোষণা করাটাই বাকি। এরা পরীক্ষা ছাড়া অটো পাসের মতো ভোট ছাড়াই অটো এমপি। এ যেন গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ। নির্বাচনের মূল পর্ব বললাম এই কারণে যে, সব গণতান্ত্রিক দেশেই নিজ নিজ দেশের সংবিধান বা কনভেনশন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে (প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভোটে) নির্বাচিত দল বা জোট সরকার গঠন করে। সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীরাই সরকার গঠন করে পরবর্তী মেয়াদের জন্য।

এখন আমাদের বাকি ১৪৬ আসনে ভোটগ্রহণ করা হোক বা না হোক, যাক বা না যাক, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্ব হাতছাড়া হওয়ার সব আশঙ্কাই কেটে গেল। ভোটার ও ভোট ছাড়া ৩০০ আসনের ১৫৪টিতেই জিতে যাওয়ার এই নজিরবিহীন নির্বাচন গিনেস বুকে স্থান পাওয়ার কথা। সংশ্লিষ্টরা তাদের বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টিকারী এই সুমহান গৌরবগাথা বিশ্ব রেকর্ডের অন্তর্গত করার জন্য গিনেস বুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'সর্বদলীয় সরকারের' শরিকদের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে একক প্রার্থী দেওয়ার ফলেই এত বেশিসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। বিএনপি সর্বদলীয় এই সরকারে থাকলে তাদেরও সমঝোতার মাধ্যমে এভাবে কিছু আসন ছাড়া হতো।

তার বক্তব্যটা হুবহু এমন না হলেও মূল কথা এটাই। তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে কেন এত নির্বাচনী আয়োজন, কেন আর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা? পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আওয়ামী লীগের এই গণতন্ত্রের মডেল অনুসরণ করে বিভিন্ন দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে ভোটার ও ভোট ছাড়াই ক্ষমতা দখল বা ভাগাভাগি করে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। তাতে লোকবল, অর্থবল, কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই, সম্মানিত ভোটারদের ভোট দিতে যাওয়ার কষ্টও লাঘব হয়।

বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. শাহদীন মালিক প্রমুখ বিনা ভোটে ১৫৪ জনের নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় (আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাই বাকি) দশম সংসদ নির্বাচনের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মত দিয়েছেন। সবাই বলছেন, এটা নজিরবিহীন।

আমাদের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, "একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার (সংরক্ষিত মহিলা আসন) কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন। " প্রশ্ন উঠতেই তো পারে, ১৫৪ আসনে তো নির্বাচনই হলো না। অথচ প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে অর্থাৎ সব দলের মধ্যে বা নিবন্ধিত অধিকাংশ দলের মধ্যে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত হওয়ার কথাই বলা আছে সংবিধানে। আপসে বা সমঝোতার মাধ্যমে জনগণকে তাদের পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল :kazi.shiraz@yahoo.com 

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।