অত্যাচারীর মন কি সর্বদাই অত্যাচারী ? ক্রুর বা নিষ্ঠুর হবার ফর্মুলা কি ? একজন নির্বিরোধ সাদাসিধে ভাল মানুষও
কোন তাড়নায় অত্যাচারী বনে যায় ? নাকি নিষ্ঠুর ওহন্তারক ব্যক্তি বংশ পরম্পরায় এ বৈশিষ্ট ধারণ করে । নাকি এটি
মানুষের গোপন সত্ত্বায় লুকিয়ে থাকা সহজাত বৈশিষ্ট যা উপযুক্ত পরিবেশে পেখম মেলে ?
আজকের বাংলাদেশে যে হানাহানি হত্যা ধংসের মহোৎসব চলছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে কয়জন সচেতন আছি ।
আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা , পিটিয়ে মেরে ফেলা, বা ঘরে ঢুকে ঠাণ্ডা মাথায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্করেঞ্জে বুকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে
গুলি করে মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া , গুম করে দেয়া , লুটপাট করা , বাড়ীঘর বুলডোজার দিয়ে ভুমিতে মিশিয়ে দেয়া – একাজ গুলো ক্ষমতাসীন দল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে এই বর্বরতা চালাচ্ছে । ভয়ংকর ব্যাপার হল যারা
এসব করছে তারা এদেশের এসমাজেরই মানুষ । হিটলার একা ৬০ লাখ ইহুদী নিধন করেনি।
স্ট্যালিন , কালিগুলা , নিরো
তারাও অত্যাচার নির্যাতন করেছে সঙ্গীসাথিদের সাথে যুথবদ্ধ হয়েই ।
ক্ষমতাচর্চায় অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে বলেই, সুরক্ষা আছে জেনেই আজ নিজ দেশের লোককে ব্যক্তিগত শত্রুতাহীন লোক
গুলোর উপর এমন বল্গাহীন অত্যাচার চালাচ্ছে দ্বিধাহীনচিত্তে । কেন ? যে নিষ্ঠুরতা অমানবিকতা বিবেক হীনতা আজ
আমরা প্রত্যক্ষ করছি সে সবই ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখে চলেছে বা অতীতে দেখেছে । যেমন
আমরা দেখেছি ধর্মীয় বা জাতিগত দাঙ্গায় , স্বাধীনতাযুদ্ধে , বা নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় । এভাবেই সমগ্র পৃথিবী জুড়ে মানুষই মানুষকে নিপীড়ন করছে হত্যা করছে ।
এই সুলুকসাধনে সাইকোলজির প্রফেসর ফিলিপ জিম্বারডো আজ ১৯৭১ সালে অদ্ভুতভাবে এই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেই
২৪ জন ছাত্র নিয়ে এক এক্সপেরিমেন্টকরেন । স্ট্যানফোর্ড সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টটাকে সত্যিকারের জেলখানার আদলে সাজানো হয়। দৈবচয়নের ভিত্তিতে তাদেরকে গার্ড ও প্রিজনার করা হয় । বন্দীদের উপর কোন অবস্থাতেই শারীরিক নির্যাতন নারকরতে গার্ডদের নির্দেশ দেয়া হয়। বরং বন্দীদের মনে বিষণ্ণতা ও পরবাসী নিঃসঙ্গতা বোধ তৈরি করার অনুমতি ছিল ।
বলে নেয়া ভাল এই ২৪ জনের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিলনা, তারা মানসিক ও শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল ।
জেল খানার কাঠামোয় বন্দীদের ৬ফুট বাই ৯ ফুট কামড়ায় তিনটি ছোট খাটে থাকার ব্যবস্থা করা হয় । বন্দীদের
সত্যিকারের জেলখানার মত ২৪ ঘণ্টা বন্দী রাখা হয় । নির্জনকক্ষের ব্যবস্থা ও হাটাচলার জন্যে একটি রুম বরাদ্দ
দেয়া হয় । গার্ডদের রুম ছিল বন্দীদের বিপরীতে , ৮ ঘন্টার শিফটে এবং কাজ শেষে নিজ নিজ ঘরে থাকতে হত
পরবর্তী ডিউটির আগ পর্যন্ত।
প্রথম পর্ব শেষ হলে গার্ড ও বন্দীদের ভূমিকা অদল বদল করা হবে এমনই পরিকল্পনা
নেয়া হয় । তাদেরকে না জানিয়ে গোপন ক্যামেরা ও সাউন্ড রেকর্ডারের সাহায্যে তাঁদের প্রতি সেকেন্ডের কর্মকাণ্ড
পর্যবেক্ষণ করা হয় । এই এক্সপেরিম্যান্টের উদ্দেশ্য, আগেই বলেছি , হল এই দুই ভুমিকায় ক্লিন কাট মানুষ গুলো
কিভাবে কখন কোন মাত্রায় বদলে যায় তার রহস্য ভেদ করা ।
১৪ দিনের পরিকল্পনা থাকলেও এই পরিস্থিতি এতই নাজুক হয়ে যায় যে স্থায়ী মানসিক বিপর্যয়ের আশংকা থেকে
এক্সপেরিমেন্ট মাত্র ৬ দিনের মাথায় সমাপ্ত করা হয় । গার্ডদের শারীরিক নির্যাতন ছাড়া যে কোন প্রকার আচরনের
অনুমতি ছিল ।
তারা যে ক্ষমতা ও আধিপত্য চর্চার সুযোগ পেল ইতিপূর্বে এরকম অভিজ্ঞতা তাদের ছিলনা । গার্ডরা
বন্দীদের উপর এগ্রেসিভ হয়ে গেল ,চরম অমানবিক মানসিক অত্যাচার করতে লাগল। অন্য দিকে বন্দীরাও ক্রমাগত
অত্যাচারে বিষণ্ণতায় ভুগতে লাগল , নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রন হারালো । ভয় ও আতংকে বন্দীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল ।
কেউ কেউ ভয়ে আতংকে কান্নাকাটি ও চিৎকার চেচামেচী করতে লাগল ।
অবস্থা সবার মনে এমন প্রভাব ফেলল যে রিসার্চারদের কেউ কেউ এই পরিস্থিতির প্রতিপাদ্য ও বাস্তবতা ভুলে গিয়ে বদলে যেতে লাগল । প্রফেসর নিজে ছিলেন
ওয়ার্ডেনের ভুমিকায় , গার্ডদের অত্যাচারী আচরণ তিনি না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান । অবশেষে এক গ্র্যাজুয়েটের
আপত্তির পর এক্সপেরিম্যান্ট বন্ধ করেন ।
পরে প্রফেসর জিম্বারডো তাঁর “ THE LUCIFER EFFECT ” বইয়ে লিখেন –
"খুব কম লোক ই ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের অবাধ সুযোগ আছে এমন পরিস্থিতিতে
নিজেকে নিবৃত করে নৈতিক ও মানবিক থাকতে পারে , আমি নিজেও পারিনি । "
এই এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল বা কনক্লুশান কি ? উত্তর হল ক্ষমতা ও আধিপত্য মানুষের আচরণ বদলে দিয়ে ভিন্ন
মানুষে পরিণত করে , সে ব্যক্তিটি আগে যে রকমই থাকুক না কেন ।
আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে রাজনীতিতে প্রতি মেয়াদের পর নির্যাতিত গোষ্ঠী নির্যাতন ও অত্যাচারের নতুন নতুন
রাস্তা চিনে নেয় । আর পুনরায় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সেটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায় । দেনাপাওনার হিসেব
চুকায় আরও অধিক মাত্রায় । আজ ক্ষমতাসীন দল গোষ্ঠী যে রকম আনকোরা ইভেন্ট বুলডোজার থেরাপি বা ঘরে
ঢুকে গুলি করে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া , গুন্ডাপান্ডা ও আইনপ্রয়গকারী সংস্থার যুথবদ্ধ হত্যা ধর্ষণ লুট ডেমোলিশান
দেখিয়ে গেল তার প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবলে গা হিম হয়ে আসে । অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের জানায় যে আগামীর
স্বদেশ অপেক্ষায় আছে আরও রক্ত আরও হত্যা আরও ধ্বংস আর আরও প্রতিশোধের ।
আর আমরা চোখ মুখ বুজে
সেই রক্তবীজের আবাদ করে যাচ্ছি ঐতিহাসিক নিস্পৃহতা নিয়ে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।