আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলে গেলেন একে-৪৭ রাইফেল উদ্ভাবক মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ!!!

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

'জার্মানদের জন্যই আমার একে-৪৭ ডিজাইন করতে হয়েছিল। তা না হলে আমি কৃষি কাজে প্রয়োজনীয় এমন যন্ত্র বানাতাম। ' উক্তিটি করেছিলেন মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ। যিনি আজ ৯৪ বছরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার একে-৪৭ অস্ত্রের বিশ্ব বিখ্যাত নির্মাতা ও ডিজাইনার হলেন এই মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ।

১৯৩৮ সালে তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনিতে একজন ট্যাঙ্ক ড্রাইভার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪১ সালের অক্টোবরের Battle of Bryansk যুদ্ধে তিনি আহত হন । তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনি সহযোদ্ধাদের কাছে জানতে পারেন যে, জার্মানদের অস্ত্রগুলো বেশিমাত্রায় উন্নত হওয়ার কারণে রাশিয়ান সৈন্যরা বেশি হতাহত হচ্ছে। এছাড়া তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে, জার্মানদের ব্যবহার করা Stg. 44 রাইফেলটি অন্যসব প্রচলিত রাইফেলের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী।
তখনকার Mausar ও Mosin Nagant বোল্ট অ্যাকশান রাইফেল দিয়ে দুরের লক্ষ্যভেদ করা গেলও সেগুলি ছিল অনেকটা ধীরগতির।

এটা নিয়ে গবেষণা করেই তিনি একটি গতিসম্পন্ন সাবমেশিনগানের তখন নকশা করেন। যদিও তার করা সেই সাবমেশিনগানের নকশা সোভিয়েত বাহিনীতে গৃহীত হয়নি, কিন্তু অস্ত্র নিয়ে তার ওই দক্ষতা সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে বেশ আলোড়ন তোলে। তাই ১৯৪২ সালে তাকে Central Scientific-developmental Firing Range for Rifle Firearms of the Chief Artillery Directorate of the Red Army (RKKA) তে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি ৭.৬২x৩৯ মিমি বুলেট দ্বারা পরিচালিত একটি রাইফেলের নকশা করেন। আর সেটি তিনি ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত রাইফেল প্রতিযোগিতায় জমা দেন।

তার সেই Mikhtim নকশা রাইফেল প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি Mikhtim নকশার উপর ভিত্তি করেই নতুন এক রাইফেলের নকশা করেন। যা পরে বহুল জনপ্রিয় একে-৪৭ নামে পরিচিতি পায়। পরে তিনি বলেছিলেন যে, রাশিয়ান সাহিত্য ও বাইবেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই অতি সাধারন ও সহজ রাইফেলের নকশা তিনি করতে পেরেছিলেন।
রাশিয়ায় তাকেই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে রাশিয়ার বীর আর একসাথে দু'বার সমাজতান্ত্রিক শ্রম বীর উপাধি দেওয়া হয়।

লাদেনের হাতে একে -৪৭ দেখার পর তিনি বলেছিলেন, 'যখন বিন লাদেনের হাতে একে-৪৭ দেখি তখন আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার কি দোষ? সন্ত্রাসীরা তো আর বোকা নয়, তারাও সবচেয়ে ভাল অস্ত্র ব্যবহার করে। একে-৪৭ নিয়ে তিনি অনেক সময় আক্ষেপও করেছেন। তিনি বলতেন, 'আমি আমার উদ্ভাবন নিয়ে গর্ববোধ করলেও মাঝে মাঝে এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়, যখন দেখি সন্ত্রাসীরাও এটি ব্যবহার করছে। মানুষের কাজে বেশি লাগে এমন কোনো যন্ত্র, যেমন ঘাস কাটার মেশিন উদ্ভাবন করলে হয়তো সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতাম।

' এছাড়া তিনি দাবী করেছিলেন যে, 'আমার উদ্ভাবন এখন অনেক দেশে স্বাধীনতা আনতে কাজে লাগে। '
১৯১৯ সালের ১০ নভেম্বর মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ রাশিয়ার কুরিনস্কি জেলার কুরিয়ায় জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম টিমফি আলেক্সান্দ্রোভিচ কালাশনিকভ আর মায়ের নাম আলেকজান্দ্রা ফ্রোলভনা কালাশনিকোভা, ডাক নাম কাভেরিনা। টিমফি ও কাভেরিনার ১৯ সন্তান। যার মধ্যে ৯ জন শিশু অবস্থায় মারা যায়।

বাকি ৮ জন বড় রক্ষা পায়। মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ হল মা-বাবার ১৭তম সন্তান।
মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ যাকে বিয়ে করেন তার নাম একাতেরিনা ভিকটোরভনা মোইসেভা। তিনিও ছিলেন একজন প্রকৌশলী। আর স্বামীর টেকনিক্যাল ড্রয়িংগুলো তিনিই এঁকে দিতেন।

তাদের চার সন্তান। নেলী, এলেনা ও নাতালিয়া হল তিন মেয়ে। আর একমাত্র ছেলে হল ভিক্টর।
মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভের মা-বাবা ছিলেন ভীষণ গরিব। টানাপোড়নের সংসার চালাতে না পেরে ১৯৩০ সালে তাদের পরিবার সার্বিয়া চলে যায়।

সেখানে গিয়ে তার বাবা কৃষি খামার গড়ে তোলেন। মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ ভর্তি হয় স্কুলে। অন্যান্য ভাইবোনদের মত মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভও ছিল দারুণ রোগা সোকা। মাত্র ৬ বছর বয়সে সে প্রায় মরতে বসেছিল। তখন থেকেই তার ঝিমধরা স্বভাব।

রোগা শরীর নিয়ে খেলাধুলা করতে না পেরে ধীরে ধীরে সে হাতের কাছে যেসব যন্ত্রপাতি পেতো, তা নিয়েই গবেষণায় মত্ত হত। এভাবে ধীরে ধীরে সে যন্ত্রপাতি'র উপর আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এছাড়া মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। তার মোট ছয়টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অবসর জীবনেও তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন।

সার্বিয়ায় যাবার পর কৃষিখামারের মধ্যে বড় হবার সময় মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ তার বাবার রাইফেল নিয়ে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে শিকার করতে যেতেন। তার সেই শিকার করার নেশা ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ওই সময় তার বাবা মারা গেলে মা আবার বিয়ে করেন। এরপর তার স্টেপ বাবা'র অনুমতি নিয়েই মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ ক্লাস সেভেন গ্রেডের ছাত্র থাকাকালীন সার্বিয়া থেকে আবার রাশিয়ার কুরিয়াতে নিজগ্রামে ফেরত আসেন। ওই সময় একটি ট্রাকটর স্টেশানে তিনি মেকানিক হিসেবে চাকরি নেন।

সেউ সুবাদে মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ মেকানিক কাজের পাশাপাশি অস্ত্র বানানোর নেশায় ডুবে যান।
১৯৩৮ সালে তাকে বাধ্যতামূলক রাশিয়ান রেড আর্মিতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হয়। মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ লম্বায় একটু বেটে হওয়ায় আর মেকানিক্সে একটু পারদর্শী হওয়ায় তাকে ট্যাংক মেকানিকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে তিনি ট্যাংক কমান্ডারও হয়েছিলেন।
মিখাইল টিমফিয়েভিচ কালাশনিকভ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান রাশিয়ার অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত হন।

যার মধ্যে তিনবার তিনি অর্ডার অব লেনিন, অর্ডার অব অক্টোবর বিপ্লব, অর্ডার অব রেড স্টার, লেনিন প্রাইজ, স্ট্যালিন প্রাইজ, সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
আজ ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে কালশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেলের (একে-৪৭) উদ্ভাবক মিখাইল কালাশনিকভ ৯৪ বছর বয়সে মারা গেছেন বলে রুশ টেলিভিশনে জানানো হয়। গত নভেম্বরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। মিস্টার কালাশনিকভ যে অটোমেটিক রাইফেল ডিজাইন করেছিলেন তা বিশ্বের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত একটি আগ্নেয়াস্ত্র। স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিশ্বের দেশে দেশে একে-৪৭ বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

অ্যাঙ্গোলা থেকে ভিয়েতনাম, আলজিরিয়া থেকে ফিলিস্তিন বহু দেশের বিপ্লবীদের প্রিয় অস্ত্র ছিল একে-৪৭। কালাশনিকভ রাইফেলের ডিজাইন খুব সরল হওয়ায় এটি তৈরি করতে খরচও পড়ে খুব কম আর এটি রক্ষণাবেক্ষণ করাও খুব সহজ। রাইফেলটি আবিস্কারের জন্য মিস্টার কালাশনিকভ তৎকালীয় সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয় সন্মান পান। যদিও এ থেকে তিনি আর্থিকভাবে খুব বেশি লাভবান হননি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়ার পর মিখাইল কালাশনিকভ ১৯৪৭ সালে এই অটোমেটিক রাইফেলটির ডিজাইন করেন।

তিনি এটির নাম দেন আভটোমেট কালাশনিকোভা। পরে এটি অবশ্য সংক্ষেপে একে-৪৭ নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।