হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
মনুষ্য জীবন দীর্ঘ; দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। – ইমন জুবায়ের (লালনের দোহাই)
শোকের চোটে হয়তো আমরা ভুল করছি। ইমন জুবায়ের মারা গেছেন, এই কথাটা ওনার কোন সত্যিকারের পাঠকের পক্ষে বলা সম্ভব না। ইমন জুবায়ের জন্ম মৃত্যুর মতো সময়বাচক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রীক ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। জীবন ও মৃত্যকে অতিক্রম করে নির্বান নামক অমরত্ব লাভের উপায়, গৌতম বুদ্ধের উপদেশবানী হিসাবে স্বিকৃত ধর্মপদ নিয়ে তিনি বহুবার লিখেছেন।
ধর্মপদ থেকে পাঠ: ওঠো, জেগে ওঠো, জেগে উঠে দেখ! আওয়াজ তুলেছেন। ধর্মপদ কিভাবে এখনো বাঙলায় আলো ছড়াচ্ছে তা নিয়া লিখেছেন। সহজিয়া দর্শন বুঝাতে লিখেছেন “জন্ম যেমন মরণও তেমনি। জীবিত ও মৃতে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। সহজযানের আদর্শ হল সাম্য ভাবনা এবং আকাশের মত শূন্যচিত্ত।
শরীরের মধ্যেই অশরীরীর গুপ্ত লীলা। সুতরাং বনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরে থাকারও প্রয়োজন নেই। আগম, বেদ, পুরাণ। সবই বৃথা। সহজের রূপ নিস্কলুষ এবং নিস্তরঙ্গ।
তার মধ্যে পাপপুণ্যের প্রবেশ নেই। সহজে মন নিশ্চল করে, যে সাম্য ভাবনা লাভ করেছে, সেই একমাত্র সিদ্ধ। তার জরা মরণ থাকে না । শূন্য নিরঞ্জনই মহাসুখ। সেখানে পাপ নেই,পূণ্য নেই”।
(মধ্যযুগের বাঙলার যৌন অতীন্দ্রয়তাবাদীগণ)
জন্ম মৃত্যু ও সকল প্রকার আইডেন্টিটি অতিক্রম করে নির্বান লাভ করা অথবা সুফিদের ভাষায় ইশ্বরের সাথে মিলন ছিলো ইমন জুবায়েরএর পরম সাধনা। আমি জানিনা তা উনি পেরেছিলেন কিনা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়যে তিনি তা পেরেছিলেন। অনবরত লিখে গেছেন। দুইদিন আগেও লিখেছেন।
তারপর চলে গেছেন। লালন নাকি সারা রাত গান গেয়ে ভোর সকালে শিষ্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, আসি বলে চলে গিয়েছিলেন। ইমন জুবায়ের কারো কাছে বলে বিদায় নিয়েছেন কিনা জানিনা। সর্বশেষ উনি ফেসবুকে আমাকে ওনার বেশকিছু লেখার লিংক ম্যাসেজ করেছিলেন। ওনার সাথে পরামর্শ করে সহজিয়া পাঠশালা নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলেছিলাম, আমি চালাতাম, উনিই ছিলেন একমাত্র পরামর্শক।
আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতায় পেজটি এখন স্থবির হয়ে আছে। ম্যাসেজ বক্সে ইমন জুবায়ের সর্বশেষ ১০/১২টা লেখার লিংক দিয়েছিলেন পেজএর কন্টেন্টএর ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর জন্যে। বিষয়বস্তু বৌদ্ধ দর্শনে শূন্যের ধারণা, সু্ফিবাদ, বাঙালিত্ব, বাঙালির ধর্ম ইত্যাদি। এটা আগস্ট মাসের ১৯ তারিখের কথা। আগস্টএর ১৮ তারিখে লেখা একটা কবিতার লিংকও দিয়েছিলেন।
কবিতাটা কিছুক্ষন আগে ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছি। কবিতাটার নাম 'কালো পাখি'।
শরীরে সমস্ত পৃথিবীর গান;
সূর্যাস্ত, গৌরিক রেখা কোনও এক নদীর।
শরীর থেকে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায়;
কালো পাখি,
উড়ে যায় সূর্যাস্তের দিকে ...
কোদালে-শাবলে পৃথিবী খোঁড়ার শত
আয়োজন
যেহেতু পাথরের নীচে রয়েছে সুমিষ্ট জল
পাথরের নীচে রয়েছে পাখির কঙ্কাল
কালো পাখির কঙ্কাল
পৃথিবী শুনছে সেই বেদনার্ত গান।
আমার নিজের ক্ষেত্রে তাই আমি অন্তত দাবি করতে পারি বা সান্তনা পেতে পারি যে তিনি অন্তত আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন।
২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হওয়া নিয়া সময়বাচক অজ্ঞান আর অস্থিরতা পুজি করে এই পুজিবাদী দুনিয়া যখন বানিজ্যিক মাতম করছে ইমন জুবায়ের তখন লিখেছিলেন "২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না বা পৃথিবীর বুকে নিবিরু গ্রহটি আছড়ে পড়ছে না। কাজেই অযথা আতঙ্কে না ভুগে বরং আমরা সবুজ সুন্দর এই পৃথিবীর দিকে রবীন্দ্রনাথের চোখে তাকাই, এই বাংলাদেশকে জীবনানন্দের মতো ভালোবাসি। আর পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠি। বেশি করে গাছ লাগাই, খাঁচার পাখি ছেড়ে দিই, পরিযায়ী অতিথি পাখিদের আশ্রয় দিই. পদ্মায় জাটকা নিধন বন্ধ করি ... এভাবে দূর্লভ এই মানবজীবন সার্থক করে তুলি"।
"দূর্লভ মানবজীবন" কথাটা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইমন জুবায়েরএর সিরিয়াস পাঠক না হলে অথবা বাঙলার ভাব দর্শনের অনুরাগী অনুসারী না হলে এই কোলনবদ্ধ শব্দ যুগলের অর্থ বোঝা যাবেনা।
“এমন মানব-জনম আর কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে”
লালনএর দোহাই দিয়ে এই কয়টি লাইন তিনি মোট কয়টা ব্লগে লিখেছেন সেটা একটা হিসাব করার বিষয়। এমন মানব জনম আর হবেনা, এটা উনি জানতেন। বেহেশত দোযখেও ওনার ভরসা ছিলোনা বলেই মনে হয়। দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর মানব জীবনকেই উনি সর্বেসর্বা গণ্য করেছেন।
কারন এই মানবজীবন দুর্লভ। “জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন/জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন” ইমন জুবায়েরকে স্মরণ করতে গিয়ে এই লাইন দুটি আজকে অনেকেই ফেসবুকে, ব্লগে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর আসল অর্থ হয়তো অনেকেই জানেন না। এই মানব জীবন দুর্লভ কারন তা চাঁদের আলোর মতো সাধারণ প্রাকৃতিক বিষয়কে সৌন্দর্যময় করতে পারে। জগতকে সুন্দর, নৈতিক ও অর্থময় করতে পারে।
সৌন্দর্য, নৈতিকতা আর অর্থময়তার মাওলা একমাত্র মানুষ। ইমন জুবায়ের একথা বলেছেন লালন এবং হেগেলের দোহাই পেড়ে।
"তবে মানুষ-রুপ নিরাকার নিরঞ্জনই গঠন করলেন কিনা -তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান এক অনিবার্য বিবর্তনের কথা বলে; রেডি মেড কিছু গড়ার কথা বলে না। বিশ্বজগৎ নিরঞ্জন-এর রঞ্জিত প্রকাশ বললে হাস্য করে।
তা হলে? তা হলে ম্লান আলোর নির্মল ভোর, ঝিরঝির বাতাস, শিউলি ফুলের গন্ধ, শিশিরসিক্ত ঘাস, একটা নিরব নদী, তার মৌন বিস্তারের কি মানে?
অতএব, দার্শনিক হেগেলের শরণাপন্ন হই না কেন।
হেগেল একবার বলেছিলেন, যা কিছু আছে সবই পরমের দিকে বিবর্তিত হইতেছে।
কে পরম?
লালনের সাঁই?
অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই" (হেগেলের দোহাই)
জন্ম, মৃত্যু, আইডেন্টিটি এই তিন ইমন জুবায়েরএর শত্রু। আইডিন্টিটি প্রশ্নে তিনি নমস্য। কোন আইডেন্টিটি গ্রহণ না করেই আবার প্রচলিত বিভিন্ন আইডেন্টিটির প্রতি নিজের অস্তিত্বের সম্পর্ক তৈরি করে নির্মোহভাবে সেইসব আইডেন্টিটির ভেতরকার আইডিয়ালগুলা খুড়ে বের করতে তার জুরি ছিলোনা।
ইমন জুবায়েরএর বাঙলা ব্লগ চর্চার মূল বিষয়ই এটা। এক্ষেত্রে বাঙলা ব্লগে তাকে আমি আমার গুরুর মর্যাদা দেই। কিন্তু ওনার লেখায় আইডেন্টিটি ও আইডিয়ালিজমের যে সহজ দ্বন্দ ও বন্ধুত্ব উনি ব্যাবহার করেছেন তা হয়তো অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকবে। এদেশে বেশিরভাগ গুনি মানুষের আসল কদর হয় মৃত্যুর পরে। ইমন জুবায়েরের ক্ষেত্রেও তা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এদেশে লালনএর মতো প্রচন্ড আইডেন্টিটি বিরোধী মানুষকেও মুসলমান অথবা হিন্দু বানাবার যুদ্ধ হয়েছে। ইমন জুবায়ের নিজেকে ‘অন্তজ বাঙালি’ দাবি করেছেন। সেই সুবাদে এই দেশের আইডিন্টিটি নির্ভর জাতীয়তাবাদীরা ওনাকে নিজেদের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী বানিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু ইমন জুবায়েরের বাঙালিত্ব কোন আইডেন্টিটির বিষয় ছিলনা, ছিল পুরোদস্তুর আইডিয়ালের বিষয়। এবং ‘অন্তজ’ শব্দের ব্যাবহারের কারনে তা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক রূপও লাভ করেছে।
একি সাথে ওনার দাবিকৃত ‘আতরাফ মুসলমান’ আইডিন্টিটিকে মোল্লাদের সুন্নি ইসলাম কিংবা আধুনিক বাঙালি মুসলিমদের ইসলামি আইডেন্টিটির সাথে গুলিয়ে ফেললেও ভুল হবে। আতরাফ মুসলমান একেবারেই বাঙলার বিষয়, আতরাফ মুসলমানের যে ইসলাম তার ঐতিহাসিক জাত-পাত-সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনীতি আছে। ‘বাঙালির অলিখিত সংবিধান’ বলে একটি সংবিধানের কথা তিনি লিখে গেছেন তার বিভিন্ন লেখায়, যে সংবিধান পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের উপর ভর করে লেখা হয়নাই। তার এই অলিখিত সংবিধান শুরু হয়েছে লালনের গানের চরণ দিয়ে।
ইমন জুবায়েরের বিনীত ভাষায় -
“সবিনয়ে আরও জানাতে চাই-বাঙালির অলিখিত সংবিধানটিও কিন্তু লালনের একটি হিতকারী গানের প্রারম্ভ দুটি চরণ"।
ভবে মানুষগুরু নিষ্টা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার-
এ সবই আবেগের কথা।
তবে বাঙালির জীবনে ও আদর্শে শিল্পের গভীর ভূমিকা স্বীকার্য। ২১ ফেব্রুয়ারির ভোরে ছেলেবেলায় দেখেছি পাড়ার এক দুধর্ষ মাস্তানকে কালো পিচ রাস্তার ওপর সাদা রঙের আলপনা আঁকতে। আপনারাও জানেন যে- এমনতরো বিচিত্র দৃশ্য অনত্র বিরল। তাই বলছিলাম-বাঙালির জীবনে ও আদর্শে শিল্পের গভীর ভূমিকা স্বীকার্য।
'মাধুর্যভজন' অর্থ শিল্পের সাধনা। নিৎসে একবার বলেছিলেন-Art is the proper task of life. লালন নিৎসে এঁরা হচ্ছেন সমগোত্রী। আর আমরা তাদের নাবালক শিষ্যমাত্র। আমরা কেবল এই মহাজনদের মন জানার চেষ্টা করতে পারি”। (লালনের দোহাই)
‘ভবে মানুষগুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার’ বাঙলার অলিখিত সংবিধানের প্রথম এই দুই লাইন মাথায় করে ইমন জুবায়েরকে বাঙলা ব্লগে নিজের গুরু হিসাবেই গণ্য করেছি, করি।
সেই সুবাদে আমার নিজের লেখাও পালটে গেছে অনেক। আস্তিক, নাস্তিক, মুসলিম, হিন্দু এজাতীয় আইডিন্টিটির উর্ধে উঠে বিভিন্ন শোষিত আইডিন্টিটির পক্ষে দাঁড়ানোর মূলমন্ত্র লাভ করতে বাঙলা ব্লগে ইমন জুবায়েরই একমাত্র আলোক প্রদিপ। বাংলার অলিখিত সংবিধান পাঠ করে, বুঝে ও সেই অনুযায়ী সাধনা করেই আমি মুক্তি পেতে চাই।
বাঙলার অলিখিত সংবিধান কেউ চোখে দেখে নাই। এই সংবিধান চোখে দেখার বিষয় না, অনুভবের বিষয়।
চক্ষু বন্ধ করেই তার রূপ দর্শন করতে হয়। ইমন জুবায়েরএর ভাষায় “মানবসভ্যতার প্রত্যেক জাতিরই হয়তো-বা মূল সংবিধানের পাশাপাশি একটি করে অলিখিত সংবিধানও রয়েছে। যে অলিখিত সংবিধানে সেই জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপ প্রতিফলিত। বাংলাদেশ তথা বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয় । বাংলার অলিখিত সংবিধান গড়ে উঠেছে বাংলার সাধকগণের গভীর চিন্তাসমৃদ্ধ বাণীতে।
যেমন চতুর্দশ শতকের কবি চন্ডীদাস- এর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ’ কিংবা সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম- এর ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ’ তদ্রুপ বাংলার মরমীকূল শিরোমনি লালন- এর অনেক বাণীই বাংলার অলিখিত সংবিধানে হীরকদূত্যিসম বিরাজমান”। (এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন/তাই তো মানুষ-রূপ গঠলেন নিরঞ্জন)
বাঙালি হওয়া তাই ইমন জুবায়েরএর কাছে বাঙালি মায়ের পেটে জন্ম নেয়া নয়। মুসলমানের পেটে জন্ম নিয়ে মুসলমান হওয়া, আর বাঙালির পেটে জন্ম নিয়ে বাঙালি হওয়ায় বিশেষ ফারাক নাই।
আদতে এইভাবে জন্ম নিয়ে বাঙালি অথবা মুসলমান হওয়া যায়না। একজন অতি উৎসাহি ব্লগার একদা ব্লগের নাস্তিকদের একটি লিস্ট করেছিলো, তাতে ইমন জুবায়েরএর নাম ছিলো। আমরা অনেকে এতে ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম, তার মতো একজন ব্লগারকে এধরণের একটি লিস্টে অনেক গাঁধাসম (এখনো মানুষ হয়ে উঠেনাই) নাস্তিকদের লিস্টে দেখে আমরা অনেকেই হতাশ হয়েছিলাম। মনে আছে, বিষয়টা ফেসবুকে ম্যাসেজ করে আমাকে জানিয়েছিলেন হাসান মাহবুব। নাম প্রকাশ না করেও বলতে চাই কয়েকজন নাস্তিক এতে খুশি হয়েছিলেন ইমন জুবায়ের নাস্তিক হলে তাতে নাস্তিকদের মান সম্মান ক্ষমতা বারে।
কিন্তু এইসব লিস্ট নিয়া ইমন জুবায়েরের কোন মাথা ব্যাথা বলে কিছু ছিলনা। নাস্তিক অথবা আস্তিক আইডেন্টিটিতে ইমন জুবায়েরকে বাধা যাবেনা। তিনি মানুষে ইশ্বরে ফারাক করতেন না। এই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন বাঙলার ভাব দর্শন থেকে, এই শিক্ষা এদেশের বৌদ্ধ সহজিয়া, হিন্দু বৈষ্ণব, মুসলিম সুফি প্রত্যেকের শিক্ষা, এই শিক্ষা বাঙলার শিক্ষা। এই শিক্ষা সহজ মানুষ স্বরূপ ইশ্বরের ইবাদত করে।
আর সেই ইবাদত সম্ভব হয় মানুষ রূপে মানুষের চরণ ভজে। ইমন জুবায়ের সহজ ভাষায় লিখেছেনঃ
“সহজ মানুষ মানে ভিতরের মানুষ। অন্তরে যে মানুষটা বাস করেন। সেই মানুষকেই বাউলরা জীবনভর খোঁজে। লালন বলছেন, দিব্যজ্ঞানে সহজ মানুষকে ভজতে।
পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে। সহজ কথায় সহজ মানুষ হচ্ছেন ঈশ্বর। যিনি মানুষের ভিতরে বাস করেন। বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শন ও ইসলামী সূফিবাদ মিলে বাউল মতের উদ্ভব। কাজেই ঈশ্বর এখানে কিতাবের ঈশ্বর নয়, সে ঈশ্বর লীলাময়, অপার রহস্যে ঘেরা।
মাঝে মাঝে কথাও বলে ওঠেন। তখন লালন বলেন, কে কথা কয় রে দেখা দেয় না। ঈশ্বর যে মানুষের ভিতরে বাস করেন-এ ধারণাটা প্রাচ্যের। পশ্চিম মনে করে প্রকৃতি জগৎ ঈশ্বরের প্রকাশ। কাজেই ওদের উন্নতিটা হয়েছে বাহ্যিক আমাদের ভিতরের জগতে।
বরীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকল খানে ...আছে সে নয়ন তারায়। পশ্চিম যে ভিতরের মানুষকে ধরতে পারেনি তা ঠিক নয়। ফ্রয়েড যে নির্জ্ঞানমনের কথা বলেছেন- সেই লালনের সহজ মানুষ। শরীরের ভিতরে এই সহজ মানুষের উপস্থিতি বাউলদের মানবতাবাদী করেছে। কেননা, ঈশ্বরের দুনিয়ায় কিছুই অকারণ নয়।
এমন কী দুঃখও।
পশ্চিম নির্জ্ঞানমন নিয়ে আজও কৌতূহলী বটে। তবে সে বাউলদের মতন কোনও কার্যকরী সিদ্ধান্তে আজও পৌঁছতে পারেনি। এখানেই পশ্চিমের সীমাবদ্ধতা আর আমাদের মহত্ত্ব। পশ্চিম বলতে শেখেনি-
"ভজ মানুষের চরণ দুটি/ নিত্যবস্তু হবে খাঁটি।
"
ইমন জুবায়েরকে বাঙালি বললেও সে মানুষের চরন ভজবে, নাস্তিক বললেও তিনি তাই করবেন। আবার নিজেকে অন্তজ মুসলমান দাবি করেও তিনি তাই করেছেন। মানুষ ভজতে গিয়ে, বিশেষ করে বাঙলার মানুষকে ভজতে গিয়ে তিনি দুই হাতে লিখেছেন। এতো এতো লিখেছেন যা পুরাপুরি পাঠ করতে এবং বুঝতে বাঙলা ব্লগের পাঠকদের বছরের পর বছর সময় ব্যয় করতে হবে। কিন্তু ইমন জুবায়ের পাঠের মতো একটি জরুরি কাজ প্রত্যেক বাংলাদেশী ব্লগারের জন্যে অবশ্য করণিয়।
ইমন জুবায়েরএর বাঙলা ব্লগ বিরাট বিপূল ৫২ বাজার ও ৫৩ গোলির অন্ধকার, গোলি ঘুপচির বাঙলা ব্লগ জগতে একমাত্র আলোকিত উপাসনালয়। নানাবিধ আইডিন্টিটি নির্ভর ক্যাচালের মাঝে এই উপাসনালয়ে, এই তীর্থস্থানে ভ্রমন করেই একজন বাঙালি ব্লগার ‘বাঙলার অলিখিত সংবিধান’ পাঠ করে মুক্তির জ্ঞান ও উপায় অর্জন করতে পারেন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে।
ইমন জুবায়েরএর ব্লগ হউক সমস্ত বাঙালি ব্লগারের প্রার্থনার স্থান। যারা এখনো প্রশ্ন করবেন, কেনো? তাদের একটা গল্প শুনতে হবে। ইমন জুবায়ের অনেক ছোট গল্প লিখেছেন।
এর মধ্যে ‘প্রার্থনা’ নামে একখানি ছোট গল্প আছে। এই গল্পে ইশ্বর মানব রূপে ঘুরে বেরাতে বেরাতে অবশেষে বাঙলায় এসে হাজির হয়েছেন এবং লালনএর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। ইশ্বর চাইলেন লালন দর্শন করতে। কিন্তু তা করতে গেলে একটা নদী পাড় হতে হবে। কিন্তু ইশ্বরএর কাছে পাড় হওয়ার কড়ি নাই।
কিন্তু এক দয়াল বৃদ্ধ মাঝি বিনা পয়সায় ইশ্বরকে পাড় করে দিতে সম্মত হলেন। অসতর্ক পাঠক এই মাঝির পরিচয় জানেন না। আর ইমন জুবায়েরএর সতর্ক ও ভক্ত পাঠক হলে অবশ্যই বোঝার কথা যে এই মাঝি খোদ ইমন জুবায়ের। মাঝিরূপ ইমন জুবায়েরএর উপর খুশি হয়ে ইশ্বর তাকে বর দিতে চেয়েছিলেন। কি চেয়েছিলেন ইমন জুবায়ের? তিনি ভারতচন্দ্র রায়ের মতো করে ইশ্বরের কাছে চাইলেন “আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে”।
ইশ্বরের কাছে চাইলে তিনি অমরত্ব পেতে পারতেন। তা না চেয়ে বাঙলার সন্তানদের জন্যে দুধ ভাত, সুখ শান্তি প্রার্থনা করেছেন। ইমন জুবায়েরের বাঙলা ব্লগ যদি আমাদের প্রার্থনার স্থান না হয় তো কার ব্লগ হবে?
ইমন জুবায়েরের ‘প্রার্থনা’ গল্পের দোহাই দিয়েই তাই বলতে চাই “দয়াময় ঈশ্বর মানবরূপ ধারন করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘুরতে ঘুরতে এই বেলায় বাংলায় এসে পড়েছেন”। আর তাকে পেতে হলে ইমন মাঝির তিন তক্তার নৌকাই আমাদের ভরসা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।