মানুষ যখন ক্ষুব্ধ হয় তখন তার মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কথা প্রকাশ করে ফেলে। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, গোপন কথা জানার একটা ভালো উপায় হলো, মানুষকে উত্ত্যক্ত করা, উত্তেজিত করা। মনোবিজ্ঞানের গবেষণার ফলাফল এখন অপরাধ বিজ্ঞানীরা সফলভাবে প্রয়োগ করছেন। উন্নত বিশ্বে এখন অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শারীরিক বলপ্রয়োগ করা হয় না বরং তার ক্ষোভকে জাগিয়ে তোলা হয়। অপরাধ বিজ্ঞানী স্টিফেন জোন্স দেখিয়েছেন ক্ষুব্ধ মানুষ কীভাবে মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কথার পসার বসায়।
বেগম খালেদা জিয়া দুই যুগ ধরে রাজনীতি করেন। এই দুই যুগে তার রাজনৈতিক চিন্তা, দর্শন নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু একটি ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত ছিলেন, তিনি কম কথা বলেন, মৃদুভাষী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি লিখিত বক্তব্য ছাড়া পাঠ করেন না। সুলিখিত এসব বক্তব্যের বাইরে বেগম জিয়া প্রশ্ন-উত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করেন না। দুবার সংসদ নেত্রী (১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ধরলে তিনবার) এবং দুবার বিরোধী দলের নেতা হলেও সংসদেও তাকে লিখিত বক্তব্যের বাইরে কমই কথা বলতে দেখা গেছে।
এ নিয়ে আক্ষেপ করে প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত '৯১-এর সংসদে দাঁড়িয়ে আমজাদ হোসেনের বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র 'গোলাপী এখন ট্রেনে'র জনপ্রিয় উক্তি 'একটা কিছু ক' গোলাপী, একটা কিছু ক' আওড়িয়েছিলেন।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, যারা কাজে-অকাজে দুই নেত্রীর তুলনা করেন। তারা প্রায়ই খালেদা জিয়ার মৃদুভাষণ, মেপে মেপে কথা বলার প্রশংসা করেন। এসব প্রশংসা আর ইমেজে সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়া ভালোই দাগ লাগিয়ে ফেলেছেন। লিখিত বক্তব্যের বাইরে যখনই তিনি বক্তব্য রেখেছেন তখনই তার বক্তব্য এলোমেলো, বিতর্কিত।
এটা '৯১-এ ভারত থেকে ফিরে গঙ্গার পানি চুক্তি ভুলে যাওয়ার প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে ২৯ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে বের হতে না পেরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত একই রকম।
কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক টেলিআলাপে তার কথার ঝাঁঝে জাতি হতবাক হয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়েও কথা ছিল। অনেকে বলেছেন, টেলিফোন আলাপ একটি একান্ত গোপনীয় ব্যক্তিগত বিষয়। অনুমতি না নিয়ে এটা প্রকাশ করা অনৈতিক।
উচিত-অনুচিতের বিতর্কে বেগম জিয়ার শব্দচয়ন, রুদ্রমূর্তি প্রশ্রয় পায়নি।
এরপর ঘটনা ঘটল ২৯ ডিসেম্বর। বেগম জিয়া বাড়ি থেকে বেরুতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তাকে বেরুতে দেওয়া হয়নি। বেগম জিয়া ক্ষোভে-দুঃখে সাংবাদিকদের ডেকে যেসব কথাবার্তা বললেন, তাতে তার স্বল্প ভাষিণীর মুখোশটা খসেই পড়ল।
ভাগ্যিস বেগম জিয়া এখন আর ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে নেই। তাহলে তার এই রুদ্রমূর্তি জাতি দেখত না। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বেগম জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় তিন দফা পুলিশি অভিযান হয়েছিল। ওই সময়ও তিনি উত্তেজিত হয়ে অনেক কথাবার্তা বলেছেন বলে আমরা শুনেছি। কিন্তু অন্যের কাছ থেকে শোনা আর চাক্ষুষ শোনা ও দেখার পার্থক্য যোজন যোজন।
২৯ ডিসেম্বরের বেগম জিয়ার রুঢ়তা দেখে অাঁচ করতে পারি, খালেদা জিয়া ওই সময় অভিযানে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কি আচরণ করেছিলেন। বেগম জিয়ার ২৯ ডিসেম্বরের বক্তব্যকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগে তিনি সরকারের বাধা দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেন।
দ্বিতীয় ভাগে তিনি কর্মসূচির কথা বলেন।
তৃতীয় ভাগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার এলাকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতা-নেত্রীদের গ্রেফতার, সমাবেশে যোগদানে বাধা প্রাপ্তি এসব স্বাভাবিক বিষয়। বিশ্বে এবং বাংলাদেশেও এর অনেক উদাহরণ আছে।
'৮৭ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেগম জিয়া 'সচিবালয় ঘেরাও' কর্মসূচি পালন করতে পূর্বাণী হোটেলে গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মহাখালী বাসভবনে এভাবে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে হেঁটে তিনি মহাখালী থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে যাত্রা করেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা পর্বে, যখন বেগম জিয়ার রাজনৈতিক পর্বের সূচনা হয়নি, তখন ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসেন। পরে শেখ হাসিনা, বেগম সাজেদা চৌধুরীসহ নেতাদের ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসা থেকে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে শেখ হাসিনাকে আটকে রেখে পুলিশ আওয়ামী লীগের অফিসে ঢুকে নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটান। শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ড. হুমায়ুন আজাদকে দেখতে যেতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। তখন তিনি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে সিএমএইচের উদ্দেশে যান।
শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম বাধা প্রদানের ঘটনা রাজনৈতিক বাস্তবতা। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মোরারজি দেশাই সরকার নিরাপত্তার কথা বলে ১৯৭৯ সালে ইন্দিরা গান্ধীর স্বাভাবিক চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জবাব দিয়েছিলেন নির্বাচনে।
মিয়ানমারের অবিসংবাদিত নেত্রী অং সান সু চিকে সেই দেশের সামরিক সরকার ১৯৮৯ সালের ২০ জুলাই থেকে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন। তিনি তার প্রতিবাদ করেছিলেন সামরিক সরকারের সমালোচনা করে।
নিরাপত্তা কর্মীদের বকে নয়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ দেশে এবং বিদেশে যারাই এরকম সরকারি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন, তারা এর জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন। সরকারি নির্দেশ পালনকারী আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে দায়ী করেননি।
অনেকে এর প্রতিবাদে আইন অমান্য করেছেন। অং সান সু চি এর প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন।
আমি মনে করি, ২৪ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে যখন চূড়ান্ত কর্মসূচি দিলেন, তখনই তো তার রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করা উচিত ছিল। যেমন '৮৭ সালে বেগম জিয়া সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে তাতে অংশগ্রহণের জন্য পূর্বাণী হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর কর্মসূচিতে সরকার বাধা দেবেই এটা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার হয় না। আন্দোলন-সংগ্রামের কৌশল থাকে। বেগম জিয়া যদি 'গণতন্ত্র অভিযাত্রা' কর্মসূচিতে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত না থাকতে পারেন, তাহলে কে কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেবেন, কোন পয়েন্ট থেকে কে আসবেন।
নেতাদের আসতে দেওয়া না হলে, কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে ইত্যাদি কর্মপরিকল্পনা রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিএনপি ও ১৮ দল সত্যিকারের আন্দোলন করতে চাইলে এসব রূপপরিকল্পনা আগেই ঠিক করে নিত।
২০০৬ সালের আন্দোলন দমনের জন্যও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত একই কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু সে সময় আওয়ামী লীগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঢাকার রাজপথ দখল করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা গ্রেফতারের ভয়ে আত্দগোপনে থাকেননি।
একবার মনে করুন ২০০৬ এর অক্টোবরে গুলিস্তান, প্রেসক্লাব, রাসেল স্কয়ারের দৃশ্য। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কর্মসূচি ডেকে গা-ঢাকা দেননি। বরং আমরা দেখেছি মো. নাসিম, মতিয়া চৌধুরীর মতো প্রথম সারির নেতারা কীভাবে পুলিশের লাঠিপেটা হজম করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা ভিডিও বার্তা আর বিবৃতি পাঠিয়ে কর্মসূচি সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেননি। ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি ছিল ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধের শেষ সুযোগ।
তাই এ সময় শীর্ষ স্থানীয় নেতারা কেন আত্দগোপনে থাকবেন? কেন তারা গ্রেফতারের ভয় করবেন? বিএনপির শীর্ষ নেতারা যদি কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসতেন তাহলে সরকার হয়তো নেতাদের গ্রেফতার করত, তাতে কি অবস্থা আজকের চেয়ে ভালো হতো না? ১৯৭৫ সালে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। এ সময় বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার শুরু হলে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা একযোগে গণগ্রেফতারের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এ কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে পরাজিত হন।
বাংলাদেশেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছেন।
কেউ পালিয়ে থাকেননি। 'আত্দগোপন' মূলত একটি বামধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা দলকে সংগঠিত করতে, কর্মীদের দিয়ে আন্দোলন করানোর নির্দেশনা দিতেই 'আত্দগোপন' করেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই সংস্কৃতি বিএনপির মতো একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের জন্য বেমানান ও অশোভন।
বেগম খালেদা জিয়া বাইরে যাই বলুন, নিশ্চয়ই তিনি দলের নেতাদের ওপর সন্তুষ্ট নন।
একটি নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য নেতা-কর্মীদের যে সাংগঠনিক সংহতি ও শক্তি প্রয়োজন ছিল তা দেখাতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। পাঁচ দফা অবরোধ এবং মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত ভর করেছে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ওপর।
একদিকে সরকারের বৈরী আচরণ অন্যদিকে পলায়নপর সহযোদ্ধাদের কারণে বেগম জিয়া ক্ষুব্ধ ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অক্ষমতার গ্লানি। এ জন্যই বেগম জিয়া ২৯ ডিসেম্বর ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আমি চার্চিলকে একটু স্মরণ করতে চাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চার্চিল ধরেই নিয়েছিলেন, তার বিজয় অনিবার্য। চার্চিল তার আত্দজীবনীতে এ নিয়ে নিজের ক্ষোভের কথাও জানিয়েছিলেন। চার্চিল বলেছেন, 'রাজনৈতিক জীবনে এ রকম সময় মাঝে-মধ্যেই আসবে যখন ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
কিন্তু সে সময় মেজাজটা নিয়ন্ত্রণেই রাখতে পারলেই আপনি এগিয়ে যাবেন। ' চার্চিল পেরেছিলেন, অনেক নেতাই এটা পারেননি। যেমন পারেননি বেগম খালেদা জিয়া। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি পুলিশকে গালাগাল করেছেন। এক নারী পুলিশকে 'বেয়াদপ' বলে ধমকালেন।
এটা গণতান্ত্রিক নেতার সংস্কৃতি হওয়া উচিত নয়। কারণ বেগম জিয়াই একই সময়ে বলেছেন, 'আমি বুঝি আপনাদের করার কিছু নেই। ' এটাই যদি তিনি বুঝবেন তাহলে সরকার এবং নিজের দলের নেতাদের ক্ষোভ তিনি বেচারা পুলিশের ওপর ঝাড়লেন কেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বেগম জিয়ার রাগ থাকতেই পারে। রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাগ প্রকাশ করে তাকে 'হাসিনা' বলা শোভন এবং সুরুচির পরিচয় সম্মত হয়নি।
এরপর তিনি গোপালগঞ্জের ওপর ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বললেন 'দেশ কোথায়? গোপালী। গোপালগঞ্জ নাম পাল্টে দেব। গোপালগঞ্জ নাম থাকবে না। '
গোপালগঞ্জ কেবল একটা জেলা নয়, বাঙালির আবেগময় এক স্থান।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই মাটিতেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। মধুমতি তীরে ছোট সুন্দর এই শাশ্বত গ্রামীণ জনপদটিতে এখন জাতির পিতা শেষ শয্যায় শুয়ে আছেন। গোপালগঞ্জ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এক সূত্রে গ্রথিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মিশে আছে এই গোপালগঞ্জের নাম। আদমশুমারি এবং অর্থনৈতিক শুমারির জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এখনো গোপালগঞ্জ পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর একটি।
ঢাকার খুব কাছে থাকলেও জেলাটির অবস্থা প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো। জেলাটি যুগের পর যুগ বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে '৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এই এলাকাটি একটি উন্নয়নবঞ্চিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়। গোপালগঞ্জ বাড়ি হলে সরকারি চাকরি পাওয়া দুরূহ ছিল। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, কেবল '৭৫-এর পরবর্তী সময় নয়, '৭১-এ মার্চের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক যেসব এলাকায় অগি্নসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে গোপালগঞ্জ ছিল অন্যতম।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জাতির পিতার বাড়ি সে সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রাগের কারণ আমরা জানতাম। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেজন্যই তারা জাতির পিতার বাড়ি, তার গ্রাম ও জেলার ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েছিল। কিন্তু বেগম জিয়া কেন গোপালগঞ্জের ওপর এত ক্ষুব্ধ হলেন? বিএনপির এক সময়ের নেতা এবং জাঁদরেল আইনজীবী খন্দকার মাহবুবউদ্দিন তো গোপালগঞ্জের সন্তান। গোপালগঞ্জেও তো বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থক আছে।
গোপালগঞ্জ তো বাংলাদেশেরই অংশ। গোপালগঞ্জের নাম পাল্টে ফেলার অর্থ কি? এ প্রসঙ্গে আবার ১৯৭১ প্রসঙ্গে আসতে হয়। ১৯৭১ এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় এজেন্ট রাজাকার আল-বদররা মিলে বাঙালিয়ানা নাম পরিবর্তন শুরু করেছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া (ব্রাহ্মণ হিন্দু শব্দ এ কারণে) নাম পাল্টে তারা রহমতপুর রেখেছিল। গোপালগঞ্জ নাম পরিবর্তনটা কি সেই পাকিস্তানি ভূতেরই ইন্ধন কিনা জানা দরকার।
তাহলে তো এই ধারায় একদিন বাংলাদেশের নাম, পতাকা, জাতীয় সংগীতও পাল্টে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে।
বেগম জিয়া সব সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। লিখিত বক্তব্যগুলো যারা লেখেন তারা সুলেখক। এখানে তাদের রুচি ও ইচ্ছার একটি প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু স্টিফেন জোন্সের তত্ত্ব অনুসরণ করে যদি আমরা সম্মানিত বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব বেগম জিয়ার রুচি এবং ইচ্ছার প্রতিফলন এতে ঘটেছে।
যে বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নূ্যনতম সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের চাকর-বাকর মনে করার স্পষ্ট মানসিকতা বিদ্যমান এবং প্রতিহিংসার আগুনে একটি জেলাকে পুড়িয়ে ফেলার জিঘাংসা দৃশ্যমান।
বেগম জিয়া কিছু দিন আগে সুলিখিত একটি বক্তব্যে বলেছিলেন তিনি প্রতিশোধ নেবেন না। যারা তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়িয়েছে অপমানিত করেছে তাদের তিনি ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু সে ক্ষমা ঘোষণা আর এ ক্ষুব্ধ ঘোষণার মধ্যে আসলটা কি তা বুঝতে কি পণ্ডিত হতে হবে?
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।