পোশাকের ক্ষেত্রে বাঙালির রুচির পরিবর্তন হয়েছে। উৎসব ছাড়া এ দেশের মানুষ পোশাকে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করত খুব কমই। তবে ২০১৩ সালে পুরোটাই বাহারি রংয়ের পোশাকের কদর ছিল।
তবে ব্যবসা হয়েছে ম্লান। কমেছে বিক্রি-বাট্টা।
আড়ংয়ের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা তাসনিন হোসেন বলেন, “এ বছরটা আমাদের খুব একটা ভালো যায়নি। হরতাল, অবরোধে আমাদের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো খোলা থাকলেও ক্রেতা সমাগম খুবই কম ছিল। আবার রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেক সময় আড়ংয়ের অনেক বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধও রাখতে হয়েছে। ”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় আমাদের কারিগর রয়েছে। অবরোধ, হরতালে পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি ঠিক মতো।
ফলে তাদের মাথায় হাত। আবার আমাদের প্রত্যাশিত বিক্রির পরিমাণ কম হওয়াতে আয় কম হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে আমাদের খরচের খাতের উপর। ”
একই রকম মন্তব্য করলেন নগরদোলার চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ আলী আফজাল। তিনি বলেন, “২০১৩ সালের শুরুটা ভালোই ছিল।
বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে মন্দার দিকে গিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাই এর কারণ। আমার মনে হয় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুধু নগরদোলাই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কমপক্ষে দুটি উৎসবে ঠিক মতো ব্যবসা করতে হবে। ”
একই রকম মন্তব্য করলেন আড়ংয়ের তাসনিন। তার ভাষায়, “আমরা এখন সার্ভাইবাল স্টেইজে আছি।
এখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমারা তাকিয়ে আছি ঈদের দিকে। সেই সঙ্গে পহেলা বৈশাখটাও আমাদের টার্গেট। ”
আফজাল বলেন, “সামনে অবরোধ এই কারণে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। এখন থেকেই একুশ, বসন্ত, পহেলা বৈশাখ— এসব নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। ”
দেশের এরকম পরিস্থিতিতেও সারা বছরই পোশাক বিক্রি হয়েছে।
মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এবার দেশীয় তৈরি পোশাক বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলো পশ্চিমা ধাঁচের মিশ্রণে পোশাক তৈরি করেছে। পোশাকে উজ্জ্বল রংয়ের ব্যবহার কয়েক বছর আগ থেকে শুরু হলেও এই বছর সেটার প্রভাব ছিল বেশি।
রঙয়ের বিপ্লব সাহা বলেন, “আমারা সবসময়ই রং নিয়ে খেলে থাকি। তবে এবার গাঢ় রংয়ের পাশাপাশি হালকা রংয়ের পোশাকও করেছি আমারা। তরুণরা উজ্জ্বল রংয়ের পোশাক পরেছে উৎসবে।
আবার তারাই সাধারণ ব্যবহারের জন্য হালকা রংয়ের পোশাকের দিকেও ঝুঁকেছে। ”
তবে এই বছর লম্বা কামিজ ও পাঞ্জাবি বেশি চলেছে।
আফজাল বলেন, “কামিজ লং ছিল হাঁটু পর্যন্ত। সেটা এ বছর চলে গেছে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত। গলার কাটিংয়েও এসেছে পরিবর্তন।
গোলগলা ছাড়াও বিভিন্ন আকারের ডিজাইন এবার চলেছে বেশি। ওদিকে ছেলেদের পাঞ্জাবিও হয়েছে লম্বা। ”
আফজাল আরও বলেন, “এবার কামিজের গলার সামনের এক রং, পেছনে প্রিন্টেড নকশার জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ”
তাসনিনও একই কথা বলেন। “এবার ক্রেতারা নানান রংয়ের পোশাকের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।
উজ্জ্বল রংয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে মানুষের। আড়ংয়ের ‘তাগা’ পোশাক এবারও চলেছে বেশ। ”
“পাঞ্জাবি যেমন একটু লং পরেছে ছেলেরা শার্টের ক্ষেত্রে সেমি-লং হাফ-ফুল, দুই রকমের শার্টেরই চাহিদা ছিল। কামিজও হয়েছে লম্বা। তবে গলার কাটিংয়ে ওভাল শেইপের পাশাপাশি ‘হাফ মুন’, ‘জিগজ্যাগ’সহ নানান কাটিংয়ের চাহিদা দেখা গেছে বেশি।
” বললেন তাসনিন।
আমাদের দেশটা বেশিরভাগ সময় গরম আর বৃষ্টি থাকে বলে ভারি ও মোটা কাপড়ের প্রচলন এবার দেখা গেছে কম।
এ ব্যাপারে বিপ্লব সাহা বলেন, “এবার দু্টি ঈদ আর পুজা— প্রধান উৎসবগুলো হয়েছে গরমের মধ্যে। আবহাওয়ার দিকে লক্ষ রেখে আমাদেরকে তাই আরামদায়ক কাপড়ে পোশাক তৈরি করতে হয়েছে। ”
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশীয় পোশাকের বুটিকগুলোর ‘কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যাওয়ার’র মতো অবস্থা হলেও দেশের পর্যটন শিল্পের মাথায় ‘বাজ পড়েছে’।
বাংলাদেশে শীত মৌসুমে মানুষ বেশি বেড়ায়। বিভিন্ন পর্যটন স্পট আর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো সেভাবেই নিজেদের প্রস্তুত রাখে।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
সারা বছর টুকটাক পর্যটক গেলেও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার এলাকা পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকে। তবে ২০১৩ সালের নভেম্বরের আগ থেকেই পর্যটক শূণ্য হয়ে গেছে কক্সবাজার।
এনশিয়েন্ট প্যারাডাইস ট্যুরস এন্ড ট্রাভলসের সিইও মুস্তাফা মোবাশ্বের সাদেকের কথায়, “কক্সবাজারে এখন অফ সিজন বলতে কিছু নেই। সারা বছরই এখানে পর্যটক আসে। তবে এবার সত্যিই অবস্থা খারাপ। রাজনৈতিক অস্থিরতায় মানুষ এখন বেড়াতে আসতে ভয় পায়। আর এই অবস্থা চলছে ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে।
”
তিনি আরও বলেন, “পাঁচ বছর আগেও এই পরিস্থিতি ছিল না। অথচ এই বছর আমাদের ব্যবসা হয়নি বললেই চলে। এমনিতে ১ মাস ব্যবসা বন্ধ থাকলে মোটামুটি সার্ভাইভ করা যায়। এখন যা অবস্থা হয়েছে তাতে কমপক্ষে ৪ মাস লাগবে ঘুরে দাঁড়াতে। ”
কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিনসহ আশপাশের যত পযর্টন স্পটে যত হোটেল আছে সব জায়গা থেকে কর্মচারী ছাটাই পক্রিয়া চলছে।
একমাত্র কারণ, খরচে কুলাচ্ছে না।
এই ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অফ কক্সবাজার-এর এই সাবেক সভাপতি বলেন, “সাধারণত গরমের সময় পর্যটক কম আসে। তখন কিছু কর্মচারী কমানো হত। শীতে পর্যটক বাড়লে আবার তাদের কাজে নেওয়া হত। তবে এবার ‘ফুল সিজন’ বলতে যা বুঝায়, এই শীতেও আমাদের অনেক হোটেল কর্তৃপক্ষ কমচারীর সংখ্যা কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে আবার তাদের কাজে নেওয়া হবে। ”
কক্সবাজারের চাইতেও বাজে অবস্থা সিলেটে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে পর্যটন ব্যবসায়।
নাজিম গড় রিসোর্টের ব্যবস্থাপক হাসান মোরশেদ বলেন, “গত ২/৩ বছরে সিলেটে পর্যটনের চমৎকার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আর এটা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এখন মুখ ধুবড়ে পড়ছে এই পরিবেশ। ”
তিনি আরও বলেন, “এই ক্ষতি পোষাতে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এখানে বেশি পর্যটক আসে শীতের সময়। এই মৌসুম চলে গেলে, আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমাদের ভরাডুবি হবে। ”
“আমাদের এই ব্যবসার সঙ্গে অনেক ছোটখাটো ব্যবসা, যেমন হোটেলের সঙ্গে গাড়ি ভাড়া, নৌকায় ঘোরার জন্য নৌকা ভাড়া— এগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কারণ পর্যটক আসলে শুধু হোটেলে থাকে না, তারা ঘুরে বেড়ায়। খাবার হোটেল থেকে শুরু করে পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায়ী এখন হাত গুটিয়ে বসে আছেন। ” যোগ করলেন মোরশেদ।
২০১৩ সালের প্রভাব যে ২০১৪ সালেও কাটবে কিনা সন্দেহ। তাই পোশাকের বুটিকগুলো উৎসব সামনে রেখে কাজ করে গেলেও পর্যটন শিল্পের সংশ্লিষ্টারা আছেন শঙ্কায়।
‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বললেও, আসলেই ‘হ্যাপি’ হতে যেন খুব কম দিনই অপেক্ষা করতে হয়— নতুন বছর ২০১৪ সালে এটাই পর্যটন ও তৈরি পোশাক শিল্পের সংশ্লিষ্টদের একমাত্র প্রার্থনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।