২০১৪ ইংরেজি সালের নববর্ষ শুরুই হয়েছে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে চলছে সংসদীয় বিরোধী দল নেতা খালেদা জিয়াকে একরকম গৃহবন্দী করে রেখে রাস্তায় নির্বাচন কমিশনের আজ্ঞায় আহূত সামরিক প্রহরা এবং মহল্লায় মহল্লায় সরকারদলীয় মস্তান ও র্যাব-পুলিশ-বিজিবির যৌথবাহিনী পরিচালিত দমন অভিযান। একই সঙ্গে চলছে কেতাবি নির্বাচন প্রস্তুতি। অবশ্য ইতোমধ্যে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের উদ্যোগে আবারও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুইপক্ষের মধ্যে একটা রাজনৈতিক মীমাংসার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। সম্ভবত এই কূটনৈতিক উদ্যোক্তাদের তাগিদে আর আশ্বাসেই চলমান অবরোধে পুলিশের গুলি বা প্রতিরোধের ককটেলবাজি অনেকটা কমেছে।
তবে কোথাও না কোথাও রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণনাশ ঘটে চলেছে প্রায় প্রতিদিন। কূটনৈতিক এ উদ্যোগের অনুমিত একটা শর্ত_ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মুলতবি করে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। সংশয়বাদীরা মনে করেন, এই শর্ত পূরণে সরকারপক্ষ একেবারেই নারাজ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিগত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে এক সমাবেশে বলেছেন, 'কয়েক দিন ধরে বিরোধী দলের সহিংসতা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে বিরোধী দল যদি সহিংসতা করে, তাহলে যেখানেই আঘাত, সেখানেই পাল্টা আঘাত করা হবে।
' একই দিনে বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'বিরোধী দল ও জামায়াত-শিবির যেভাবে নাশকতা চালাচ্ছে তাতে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হবে সরকার। ' টেলিভিশনে টকশো বুদ্ধিজীবীরা কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তার নাম হবে গৃহযুদ্ধ। আল-জাজিরা টেলিভিশনসহ একাধিক বিশ্বমাধ্যমে বাংলাদেশে চলমান সহিংস অস্থিরতাকে ইতোমধ্যে গৃহযুদ্ধাবস্থা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পত্র-পত্রিকায় পাঠক মন্তব্যের জরিপ থেকে দেখা যায়, দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর অনড় অবস্থানের কারণেই দেশের রাজনৈতিক-সাংবিধানিক সংকট ক্রমেই রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ে পরিণত হচ্ছে। একটি পত্রিকার পাঠক প্রতিক্রিয়া জরিপে সাবেক মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলামের বিশ্লেষণ উদ্ধৃত করে প্রশ্ন করা হয়_ বাংলাদেশ একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে কি? এ আশঙ্কায় সায় দিয়েছেন মন্তব্য প্রদানকারীদের ৬০ ভাগ।
জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর মিশন সফল হবে না বলে আগেভাগেই আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে ৮২ ভাগ পাঠক মন্তব্যে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেই দেশে অস্থিরতা-সহিংসতা, হরতাল-অবরোধের সংকট সঙ্গে সঙ্গে মিটে যাবে বলে ১৮ দলীয় বিরোধী জোটের তরফ থেকে যে বক্তব্য এসেছিল, অধিকাংশ পাঠক এমনকি জাতিসংঘ দূত তারানকো পর্যন্ত এমনই ধারণা গ্রহণ করেছেন বলে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে সংবাদভাষ্যে এসেছে।
একটি সাপ্তাহিকের সংবাদভাষ্যে মন্তব্য_ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর জামায়াত-শিবিরের শপথধারী কর্মীদের মধ্যে সরকারের বিঘোষিত যৌথ দমনাভিযান প্রতিরোধের সংকল্প কয়েকগুণ বেড়েছে। ফাঁসির আগে কাদের মোল্লা বলে গেছেন, তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর যেন কেউ উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না করেন। বরং বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শনিষ্ঠা কায়েম করে যেন তার রক্তের বদলা নেওয়া হয়।
ওই ভাষ্যকারের অভিমত, কাদের মোল্লার ওই অন্তিম ইচ্ছার কারণে ফাঁসির পরদিন কিছুটা শান্ত ছিল জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকার বাইরে রাস্তাঘাট অচল করে দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কোথাও কোথাও আবেগপ্রবণ কর্মীরা। তারপর দলীয় কর্মসূচিতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করেছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা।
কার্যত ১৬ ডিসেম্বর থেকেই যৌথ অভিযানের স্টিম রোলার বিএনপিসহ জামায়াত-শিবির কর্মীদের বিরুদ্ধে দমনাভিযানে শুরু করেছিল। সরকারদলীয় বাহিনী নির্দেশিত হয়ে শনাক্তকৃত ব্যক্তিদের নিবর্তনমূলকভাবে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে গিয়ে বিভিন্ন মফস্বল এলাকায় গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিযুক্ত র্যাব-পুলিশ বাহিনী।
বিজয় দিবসেই সাতক্ষীরায় এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে এবং র্যাব-পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে সরকারি হিসাবে পাঁচজন। তারপর থেকে অবরোধ-ভাঙচুর আগুন ককটেল বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতি, আহত-নিহতের সংখ্যাবৃদ্ধি সমানে চলেছে। আর তারই মধ্যে শেখ হাসিনা তার বাধ্য নির্বাচন কমিশন ও অনুগত প্রশাসনের সহযোগিতায় একতরফা নির্বাচনের কেতাবি প্রক্রিয়া নির্বিকারভাবে ক্রমান্বয়ে সম্পন্ন করে চলেছেন।
ভোট ছাড়াই মহাজোটের সঙ্গী দলগুলোর সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে দশম সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের কাগুজে প্রক্রিয়া শেষ করেছেন, তথা দেশের অর্ধেকের বেশি ভোটদাতার ভোটের অধিকার বঞ্চিত করেছেন বিরোধী বয়কট আর সহযোগী সমঝোতার কলমের খোঁচায়। এরশাদের জাতীয় পার্টি বেঁকে বসেছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে বাধ্য করা হবে নির্বাচনে আসতে। তা-ই তিনি করেছেন এরশাদকে আটক করে মিলিটারি হাসপাতলে চিকিৎসাধীন রেখে রওশন এরশাদকে দিয়ে দল ভাঙিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এ কথাও বলেছেন, বিএনপি সমঝোতায় এলে তাদেরও সিট ছেড়ে দেওয়া যেত। শেখ হাসিনার এসব কথা থেকেই স্পষ্ট যে, তিনি সাধারণ ভোটারের পছন্দ-অপছন্দ মতামতের ধার ধারেন না; ক্ষমতার দখল ভাগাভাগি করে রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে বহুদলীয় গলাবাজির ছদ্মাবরণে একনায়কত্বনির্ভর নয়া বাকশালী গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই তার লক্ষ্য। আর এসবই তিনি করে চলেছেন রাজধানীতে অবরুদ্ধ এলিট সমাজকে নিয়ে সংযোগবিচ্ছিন্ন সারা দেশকে উপেক্ষা করে।
ঢাকার বাইরে প্রায় সর্বত্র বিরোধী জোটের প্রতিরোধ বেড়েই চলেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতিশ্রুত 'পাল্টা আঘাত' কোথাও কোথাও এসেছে চোরাগোপ্তাভাবে কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথবাহিনীর ছত্রছায়ায়। আদপে আওয়ামী লীগ কিংবা তার সহযোগী নেতা-কর্মীরা ঢাকার বাইরে মাঠে কোথাও দাঁড়াতে পারছে না। নির্বাচনপ্রার্থীরাও অধিকাংশ নির্বাচনী এলাকায় প্রচারাভিযান শুরু করার সাহস পাচ্ছে না। ঘরে বসে বা পোস্টার লিফলেট বিবৃতি দিয়ে জনসংযোগের লোকদেখানো চেষ্টা করছে, কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীকে বসিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রলোভনের টোপ ফেলছে, নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশের ধান্ধা খুঁজছে।
এভাবে চলছে নির্বাচনের প্রহসন, আর অস্থিরতা-কাতর দেশবাসীর নিরাপত্তাহীনতা এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার দুর্ভোগ।
বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলায় প্রাণঘাতী বা বাড়াবাড়ি রকমের শক্তি প্রয়োগ এড়ানোর জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রকাশ্যে নির্দেশ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা ও সহিংসতা নিয়ে অবিলম্বে কার্যকর ও পক্ষপাতহীন তদন্ত পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওই সংগঠন।
প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, 'নিরাপত্তা বাহিনী ও বিরোধীদলীয় কর্মীরা মারাত্দক সংঘর্ষে মেতে রয়েছে। আসন্ন নির্বাচন এবং যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে গত দুই মাসে সংঘর্ষে শতাধিক নিহত এবং শত শত লোক আহত হয়েছে।
১৪ ডিসেম্বর র্যাব সদস্যরা লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াত নেতা ফয়েজ আহমেদের বাসায় প্রবেশ করে। তার স্ত্রী মার্জিয়া বেগম জানান, র্যাব সদস্যরা ফয়েজকে বাসার ছাদে নিয়ে গিয়ে তার মাথায় গুলি করে। তারপর তারা তার লাশ মাটিতে ফেলে দেয়। র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ফয়েজ পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। র্যাব অনেকবারই বলেছে, তাদের হাতে আটক লোক পালানোর সময় বা ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছে।
বাংলাদেশ সরকার বিক্ষোভকারীদের সহিংসতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যায় শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে পক্ষপাতমুক্ত তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের বা এসব কাজ করতে যারা নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিচার করতে বাধ্য। সরকার বিক্ষোভকালে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারবিষয়ক জাতিসংঘ মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করার জন্য সরকারের প্রকাশ্যে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া উচিত। জাতিসংঘের ওই বিধানে বলা হয়েছে, 'শক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আগে নিরাপত্তা বাহিনীকে অহিংস পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আর যদি অনিবার্যভাবে শক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেই হয়, তবে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তা করতে হবে।
'
পর পর দুটি নিবন্ধে বাংলাদেশের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে কড়া মন্তব্য করেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক সাময়িকী দ্য ইকনোমিস্ট। ২০ ডিসেম্বর পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে 'পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ : দ্য হ্যাংম্যান হ্যাজ স্পোকেন' (বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট : জল্লাদ আওয়াজ তুলেছে) এই শিরোনামে বলা হয়েছে (সংক্ষেপিত) : কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পথে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বিলীন হয়ে গেল। স্বাধীনতার প্রায় ৪২ বছর পর বাংলাদেশ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য প্রথম ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করল। তিনি একটি পরিবারের ছয়জনকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগের ঘটনার সাক্ষী ছিল মাত্র একজন।
ওই সময়ে সেই সাক্ষীর বয়স ছিল ১৩ বছর। তিনি একটি বিছানার নিচে অবস্থান করে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলে দাবি করেছেন। এ ঘটনার অন্য কোনো প্রমাণ ছিল না। ট্রাইব্যুনাল প্রথমে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। আদালতকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বলা হলেও এটা স্রেফ স্থানীয় আদালত।
আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পর তাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য বিক্ষোভ হয়েছিল। ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। এর পর নির্বাচন কমিশন নভেম্বরে আমলে নেয় যে, আদালত আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ করেছেন। 'সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলে এই ট্রাইব্যুনাল টিকবে না। চারজন প্রসিকিউটর ও আদালতের তদন্ত সংস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে আবেদন করেছেন, যদিও তারা তাদের বর্তমান দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন।
'
১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশে এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেন। তারা জানতেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি আরও রক্তপাত ঘটাবে। ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতায় পরবর্তী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার যে আশাটুকু ছিল, সেটাও গুঁড়িয়ে দেয়। তবু শেখ হাসিনা আপস করবেন না। বিরোধী দলের বয়কট সত্ত্বেও সরকার ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বিএনপি ও অপর ১৭টি দল একটি মনোনয়নপত্রও দাখিল করেনি। এই দুর্বল সরকার তামাশায় পরিণত হতে যাওয়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পুরস্কার হিসেবে সাবেক সামরিক শাসক জাতীয় পার্টি নেতা এইচ এম এরশাদকে ৬০টি আসন দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এরশাদ নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ১২ ডিসেম্বর নিরাপত্তা বাহিনী তাকে তার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নেয়।
সর্বোপরি কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে নিয়োজিত জাতিসংঘ ও এর উদ্যোগের প্রতি চপেটাঘাত। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিল, 'বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যদি ওই ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, তবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে তাদের বাদ দেওয়া হতে পারে।
এই হুমকিতে সঙ্গে সঙ্গেই কাজ হয়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সূর্য ওঠার আগেই বাংলাদেশের জেনারেলরা ওই সময়ের রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, নির্বাচন বাতিল এবং সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বাধ্য করেন। '
একই দিনে আরেকটি প্রতিবেদনে দি ইকনোমিস্ট বলেছে (সংক্ষেপিত) : 'প্রধান বিরোধী দলের বয়কটের মধ্য দিয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের বৈধতা দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনকে সামনে রেখে গত কয়েক দিনের সহিংসতায় সর্বশেষ মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে গত ১২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর।
শেখ হাসিনার অজনপ্রিয় সরকার ইতোমধ্যে দেশের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
শেখ হাসিনার প্রধান শত্রু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়া একের পর এক সাধারণ ধর্মঘট ডাকছেন। এর মাধ্যমে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ও অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বিএনপির প্রধান শরিক জামায়াত একেবারেই বাঁচার লড়াই শুরু করেছে। দলটির গুণ্ডারা এখন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। আর নিরাপত্তা বাহিনীও এর জবাব দিচ্ছে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে।
আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এটা হবে একটি সুস্পষ্ট লজ্জাজনক ঘটনা। যেখানে ৩০০ সদস্যের মধ্যে ১৫৪ জনই হবেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। বিএনপি ও তার জোটের ছোট ১৭টি দল নির্বাচন বয়কট করছে। আর তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির প্রধান ও সাবেক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সরকার হাসপাতালে আটকে রেখেছে। বাংলাদেশের পরবর্তী বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এর ফলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবেই। বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ ভারতই আওয়ামী লীগ সরকারকে নির্বাচন এগিয়ে নিতে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টও গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। তবে একটি জরিপে জানা গেছে, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ চায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিক।
আর দেশের মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ চাচ্ছে 'দুই বেগম'কে তাদের 'দুঃশাসনের কারণে' রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হোক। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।