ষাটের ছাত্ররাজনীতিতে মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের কাছে মতিয়া চৌধুরী ছিলেন অগি্নকন্যা। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের অনেকেও তাকে ভালোবেসে অগ্নিকন্যা বলেই ডাকতেন। স্বাধীনতা-পূর্বকালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তার বাগ্মিতা, সংগ্রাম ও তেজস্বিতা নামের আগে এই উপাধি তুলে দিয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কঠিন পরিস্থিতির যখন মুখোমুখি তখনো এই মতিয়া চৌধুরী তার বক্তৃতার ভাষার কোনো রদবদল করেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ঢোল আর হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর মতো অশালীন উন্মাসিক বক্তৃতা দিয়ে রোমান্টিক হটকারী স্লোগাননির্ভর উগ্রপন্থি জাসদ নেতাদের বক্তৃতার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিলেন।
সেই কঠিন সময়ে মস্কোপন্থি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধু ও তার আওয়ামী লীগের পাশে এসে দাঁড়ালেও মতিয়া চৌধুরীর মুখের ভাষার পরিবর্তন হয়নি। '৭৫-উত্তরকালে '৭৯ সালে যখন মরহুম আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের মধ্যমণি তিনি তখন তার সতীর্থদের নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে মতিয়া চৌধুরীকে মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ রশিকতার ছলে বলেছিলেন, ''আমাদের এখানে এলে তো 'পানিকন্যা' হয়ে যাবে। '' পানিকন্যা হোন বা না হোন আওয়ামী লীগে ৩৩ বছর কেটে গেলেও মানুষ তাকে ন্যাপের মতিয়া চৌধুরী বলেই ডাকে। তার দিকে তাকিয়ে বিশ্লেষকরা এমন মন্তব্যও করেন, আওয়ামী লীগে নাকি আওয়ামী লীগ হয়ে জন্ম নিতে হয়।
বাহির থেকে এসে আওয়ামী লীগ হওয়া যায় না। দলের অভ্যন্তরে পর্দার বাইরে-ভেতরে বরাবর তিনি আওয়ামী বিদ্বেষী বলেই চিহ্নিত হয়েছেন। বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা কোনো দিন তাকে আওয়ামী লীগের মঞ্চে বা বাইরে অগি্নকন্যা বলে সম্বোধন দূরে থাক, তেলকন্যা বলে কটাক্ষ করেছিলেন। রাজনীতিতে বারবার জেল খাটা মতিয়া অতি সাধারণ জীবনযাপনে যতটা অভ্যস্ত, সততার তকমা পায়ে পায়ে যতই হেঁটেছেন তার ছায়াসঙ্গী হয়ে তেমনি দলের পোড় খাওয়া নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য তার চেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে এবার তার।
সারা দেশে কোথাও যখন ভোটযুদ্ধের প্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না, ঠিক তখন শেরপুর-২ আসনের ভোটের লড়াই জমে উঠেছে। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও নালিতাবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদশাহ এবার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। বাদশার ভোটযুদ্ধে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই নন, বঙ্গবন্ধুর সহচর প্রবীণ আওয়ামী লীগার '৭০-এর জাতীয় পরিষদ সদস্য মিজানুর রহমানও মাঠে নেমেছেন। কাল ৫ জানুয়ারি সেই অগি্নকন্যা মতিয়ার অগি্নপরীক্ষার দিন। নৌকা প্রতীক নিয়ে এ আসন থেকে তিনি তিনবার বিজয়ী হয়েছিলেন।
একবার বাদশাহর বিরোধিতার কারণে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার ভোটের ময়দানে বাদশাহ জনসমর্থন নিয়ে এককালের কুঁড়েঘরের কন্যা মতিয়ার নৌকাকে এক ডুবন্ত তরীতে পরিণত করেছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এ আসনে সরকারি কোনো তেলেসমাতিতে যদি অঘটন না ঘটে তাহলে বাদশাহর কাছে একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী নেত্রী মতিয়ার পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।
২. আওয়ামী লীগের তারকা রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের বাসভবনে একবার মজলিসি আড্ডায় দলের নেতা মরহুম আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেক নেতাই ছিলেন। আড্ডার ছলে তোফায়েল আহমেদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বলেছিলেন, 'দাদা, আপনি ভাগ্যবান।
আমাদের নেত্রীর কাছে (শেখ হাসিনা) আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। নেত্রী আপনাকে দলে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা করেছিলেন। এমনকি হবিগঞ্জের শূন্য আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী করে এনেছিলেন। ' তার অগ্রজ আবদুর রাজ্জাককে দেখিয়ে তোফায়েল সুরঞ্জিতকে আরও বলেছিলেন, 'যদি আপনার বন্ধুর হাতে আওয়ামী লীগে যোগদান করতেন তাহলে দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পেতে অনেক পথ হাঁটতে হতো।
' রাজ্জাক ভাইয়ের হাতে যোগ দিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে ঠাঁই পেতে কত পথ হাঁটতে হয় তা মতিয়া চৌধুরী জানেন। উল্লেখ্য, '৭৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া মতিয়া চৌধুরী '৮১ সালের দলীয় কাউন্সিলেও ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পাননি। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা বহুবার বহু অনুষ্ঠানে বলেছেন, ছাত্রজীবনে তারা ছিলেন মতিয়া চৌধুরীর ভক্ত। '৬০-এর ছাত্রলীগের প্রভাবশালী সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি তাদের ছাত্রলীগে টেনে রাখতেন। মধ্য আশিতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শেখ হাসিনা মতিয়া চৌধুরীকে দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই দেন।
ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য থেকে কৃষি সম্পাদিকা এবং সর্বশেষ প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই পান। ওয়ান-ইলেভেনে দলের বাঘা বাঘা নেতারা, পোড় খাওয়া কর্মীরা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মতিয়া চৌধুরী মুজিবকন্যার ওপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, পরবর্তীতে দল ক্ষমতায় এলে দলের প্রবীণ নেতারা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। এমনকি দলীয় কাউন্সিলের ১৫ দিন পর ঘোষিত প্রেসিডিয়ামসহ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে কর্মী অন্তপ্রাণ নেতারা বাদ পড়ার নেপথ্যে নাকি মতিয়া চৌধুরীর প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, দলের দুর্দিনের কাণ্ডারি মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ঠেকাতে পারেননি। একবার এক আড্ডায় আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছিলেন, '৮১ সালের কাউন্সিলে যখন সারা দেশের নেতা-কর্মীদের তুমুল করতালি আর আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে দলের সভানেত্রী পদে ঐক্যের প্রতীক শেখ হাসিনার নাম ঘোষণা হলো তখন ইডেনের এক কোনায় মুখ কালো করে মতিয়া চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন। দলের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমনের পর মতিয়া চৌধুরী ছিলেন রাজ্জাক গ্রুপের সক্রিয় নেত্রী।
আবদুর রাজ্জাক ও দলের পোড় খাওয়া নেতাদের বাইরে ঠেলে দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগে থেকে গিয়েছিলেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ওয়ান-ইলেভেনের সময় যাদের সংস্কারবাদী হিসেবে কোণঠাসা করা হয় তারা দলের ভাঙন চাননি। চেয়েছিলেন মতিয়া চৌধুরী। সেদিন দলের ভাঙন এলে আর ওয়ান-ইলেভেন সফল হলে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের মতিয়াকেই ক্ষমতার মসনদ টানত। কারণ ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের সঙ্গে যেসব সুশীলের রাতের শখ্য ছিল তাদের পছন্দের শীর্ষে ছিলেন মতিয়া।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মতিয়া চৌধুরী সেই ভাগ্যের বরকন্যা, যিনি মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার দুই সরকারের ফুলটার্ম মন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো নেতার ভাগ্যে এমনটি ঘটেনি। এমনকি ১৪ দলের নেতাদের ক্ষমতার ভাগ্যও তিনি নির্ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের মন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। আর শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের মতিয়া চৌধুরীই একমাত্র ভাগ্যবতী যে তার নেত্রীর দ্বিতীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন।
তার ইশারায় অনেকে মন্ত্রী-নেতা হয়েছেন। কিন্তু রাজনীতির নিয়তি বোধহয় এমন যে, যেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রধান বিরোধী দলসহ অনেক রাজনৈতিক দলের বর্জনের মুখে অনুষ্ঠেয় কালকের একতরফা নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বদিউজ্জামান বাদশাহর কাছেই তার ক্ষমতার রাজনীতির সূর্যাস্ত ঘটতে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেরপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের দুর্গখ্যাত নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৭৪ ভোট রয়েছে। অন্যদিকে নকলা উপজেলায় ভোটার হচ্ছেন ১ লাখ ৩২ হাজার ৩২৯ জন। নালিতাবাড়ীতে জনমতে ও ভোটের জোয়ারে বাদশাহ অনেক এগিয়ে রয়েছেন।
নকলায়ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। মতিয়া চৌধুরী ভোটের ময়দানে এবার প্রথম ভোটারদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। তবুও হালে পানি পাচ্ছেন না। শেখ হাসিনা সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী ও এরশাদের ভাষায় তার সরকারের গুডমিনিস্টার আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এক আড্ডায় গল্পের ছলে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের আগের শাসনামলে যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে তিনি শেরপুর গিয়েছিলেন। তার বড় বোনতুল্য মতিয়া চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তার কাছে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা চাইছিলেন।
তিনি প্রকৌশলীদের তাদের দেখাশোনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পর মতিয়া চৌধুরী তার কাছে এসে ধন্যবাদ না জানিয়ে উল্টো বলেছিলেন, ওদের কাজ দিতে গেলেন কেন? ওদের পকেটে টাকা এলে রাজনীতি করবে না। ওরা রাজনীতি করবে। ওদের কেন টাকা হবে? দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেই নয়, এলাকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে না পারার বেদনা দীর্ঘদিন সইতে সইতে নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা এবার রীতিমতো ভোটের ময়দানে বিদ্রোহের সুর তুলেছে। সেখানে স্লোগান উঠেছে, 'মতিয়া চৌধুরী কর্কশ, আনারস, আনারস।
' আওয়ামী লীগ রাজনীতির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক নেতা-কর্মী মনে করেন, মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগকে আদর্শচ্যুত নষ্টভ্রষ্ট বামদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিলেন। এতে তাদেরকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দূরে ঠেলেছেন। দলকে দুর্বল করেছেন। সেই তারাও বাদশাহর সঙ্গে পর্দার অন্তরালে যোগাযোগ রেখে মানসিক সমর্থন দিচ্ছেন। এখন অপেক্ষার প্রহর।
কাল ভোট। কাল সন্ধ্যার পর জানা যাবে মতিয়ার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।