আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদ-জিহাদ ও কাশ্মীর প্রসঙ্গ

পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের প্রতি আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই!

মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদ-জিহাদ ও কাশ্মীর প্রসঙ্গ / রইসউদ্দিন গায়েন

‘মৌলবাদ’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ এবং ‘জিহাদ’ এই তিনটি শব্দ আজ বিশ্ব জুড়ে সমালোচনার বিষয়বস্তু। এমন কোনো সংবাদমাধ্যম নেই(তা’ প্রিন্ট মিডিয়া হোক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া) যেখানে প্রতিনিয়ত এই তিনটি শব্দ নিয়ে কোনো না কোনো খবর প্রচারিত বা প্রকাশিত হয় না। আর সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো এই শব্দগুলি কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য এগুলো রিপোর্টার এবং সম্পাদকমন্ডলীর লৈখিক সুনিপুণ যোগ্যতার প্রকাশ।

এখন আসা যাক এই তিনটি শব্দের অর্থ ও সঠিক প্রয়োগ-ভিত্তিক আলোচনায়।

প্রথম শব্দটি ‘মৌলবাদ’। ;তা’ থেকে ‘মৌলবাদী’। মৌলবাদী’ কাকে বলবো? এর উত্তরে বলতে হয়,মৌলবাদী এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনো একটি বিষয়ে ‘মৌলিকত্ব’-কে কঠোরভাবে মেনে চলেন। যেমন একজন ডাক্তারকে যদি ভাল ডাক্তার হতে হয়,তাঁকে চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিকত্ব সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হবে। একজন গণিতবিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

তেমনি ‘ধর্ম’ বিষয়ে মৌলিক ধারনা না থাকলে ধার্মিক হওয়া যায় না। অস্পষ্টতা না রেখে বলা ভাল যে একজন হিন্দু,মুসলিম বা খৃস্টান যদি ধর্মের মৌলিকত্ব না বোঝেন বা না অনুসরণ করেন,তিনি প্রকৃত হিন্দু,খৃস্টান বা মুসলিম হতে পারেন না। সত্য ও অহিংসার ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধী মৌলবাদী ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে শব্দটি কোনো সত্যদ্রষ্টা মানুষের চারিত্রিক গুণাবলী প্রকাশের জন্য প্রয়োগ করা হয় না। ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ধর্মীয় কার্যকলাপের ক্ষেত্রে বহুল প্রচারিত শব্দ।

প্রচারের অপব্যাখ্যায় এই ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ধর্মীয় বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচিত হয় না। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এই শব্দটি ‘সাম্প্রদায়িক শব্দ’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় শব্দটি হ’ল ‘সন্ত্রাসবাদ’। ‘সন্ত্রাসবাদ’ হচ্ছে অন্যায়ভাবে মানুষকে ভয় দেখানো। ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর একটি সমার্থক শব্দ ‘আতঙ্কবাদ’।

আর এই ‘আতঙ্কবাদ’ থেকে ‘আতঙ্কবাদী’ শব্দটি ব্যাপক প্রচারগুণে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এখন প্রশ্ন কে বা কা’রা ‘আতঙ্কবাদী’? এ প্রসঙ্গে,আগ্রহী পাঠকবন্ধুদের জন্য আমার লেখা একটি কবিতা উপস্থাপন করছিbr />
‘আতঙ্কবাদী:-রইসউদ্দীন গায়েন
চোখ রাঙিয়ে শিশুকে ভয় দেখালো কে?---মাষ্টারমশাই।
লিঙ্গভেদে ভ্রুণহত্যা করলো কে?---পতিদেব।
নিরপরাধ বধূহত্যা কেন?---অতিলোভী অজদের দোষে।
বলপূর্বক প্রেমখেলায় উন্মত্ত কা’রা?---মুখোশধারীরা।


পুলিশ কেন দুষ্কৃতির বন্ধু?---পকেট ভরার তাগিদে।
রক্ষক কেন হয় ভক্ষক?---অর্থলোভে।
বীর সুভাষ কেন নিরুদ্দেশ?---পন্ডিতের আশীর্বাদে।
ভারত-বিভাজন চক্রান্তকারী কা’রা?---ধর্মবণিকরা।
কাশ্মীর আক্রান্ত কেন?---ধর্মতান্ত্রিক চক্রান্তে।


আফগানিস্তান ধ্বংসস্তুপে পরিণত কেন?---মশা মারতে কামান দাগায়।
ইরাকে মৃত্যুলীলা কেন?---ইবলিসের উৎপাতে।
ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা কেন?---কাশ্মীর ভাগাভাগি নিয়ে।
সাদ্দাম-হুসেন কি আতঙ্কবাদী ছিলেন?---আমেরিকাই জানে।
আর জর্জ-ডব্লিউ বুশ?---ইবলিসের উপযুক্ত বংশধর।


আসলে,আমাদের বুঝতে বাকি নেই যে
টপ্ টু বটম্ আতঙ্কবাদীতে ভরা---
তাই বৃথাই প্রশ্ন করা---
‘আতঙ্কবাদী কে বা কা’রা?’

এবার ফিরে আসা যাক মূল আলোচনার স্রোতে। একজন চোর বা ডাকাত যদি পুলিশকে দেখে ভয় পায়,তাহলে সেই পুলিশ, চোর-ডাকাতের কাছে একজন সন্ত্রাসী। কিন্তু ডাকাতি বা চৌর্যবৃত্তির মতো অসামাজিক কার্যকলাপ দূর করার জন্য পুলিশ আমাদের কাছে একজন সমাজসেবী বন্ধু হিসেবে প্রশংসিত হয়। বীর ক্ষুদিরাম,সূর্য সেন,প্রফুল্ল চাকী,বিনয়-বাদল-দীনেশ এবং আরও অনেকের আত্ম-বলিদানের ঘটনা আমরা স্মরণ করি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজত্বে ইংরেজদের বিচারে তাঁরা ছিলেন সন্ত্রাসবাদী বা আতঙ্কবাদী।

বিপ্লবী রাসবিহারী বসু,নেতাজী সুভাষচন্দ্রও ছিলেন ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য আতঙ্কবাদী। অথচ,আমাদের দৃষ্টিতে দুঃসাহসিক দেশপ্রেমিক,অবিস্মরণীয় প্রণম্য ব্যক্তিত্ব।

শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়,বন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটছে। একই জঙ্গলে থাকে বাঘ ও হরিণ,অথচ বাঘ মহা-আতঙ্কবাদী, চির শত্রু হরিণ ও অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার এমনকি মানুষেরও। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকেই আতঙ্কবাদী আছে ও থাকবে।

স্বর্গলোক বা জান্নাত থেকে বিতাড়িত আজাজিল বা ইবলিস্ তার প্রমাণ,যিনি মানবজাতির চিরশত্রু---সৃষ্টির আদিকাল থেকে এক বিস্ময়কর আতঙ্কবাদী। দুর্গাপুজা এসেই গেল। কিন্তু কিভাবে এল এই পূজা---নিশ্চয়ই কারও অজানা নেই। অসুরের দাপটে স্বর্গলোকের দেবতারা ভীত-সন্ত্রস্ত। দেবী দুর্গা মহাকালী-চামুন্ডেরূপ ধারণ ক’রে অসুর বধ না করলে দেবতাদের স্বর্গলোকে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠত।

এখানে বিচার্য বিষয় এই যে বিপন্ন দেবতাদের কাছে অসুর ছিল মারাত্মক আতঙ্কবাদী। অপরপক্ষে মহাকালীরূপী দেবী দুর্গা ছিলেন অসুরদের সামনে কালভৈরবী মহা-আতঙ্কী। এখানে একটা ইতিবাচক বিষয় আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে। বিষয়টি হ’ল,দেবী দুর্গতিনাশিনীর জন্যই শুধু দেবতারা নন্ সমস্ত সৃষ্টকুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বসুন্ধরায় শান্তি-প্রতিষ্ঠা হ’ল।

মা ঊমার আগমনী গানে,স্তব-স্তুতিতে ভ’রে উঠল অবনী। এমনি ভাবে মহাভারতের ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র,সত্যাদর্শী যুধিষ্ঠিরের কাছে পরম মিত্র হলেও দুর্যোধন-দুঃশাসনের দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ এক ভয়ালরূপ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। রামায়ণে দশানন এক বিভীষিকা। রামভক্ত হনুমান কৌশলে রাবণপত্নী নিকষা’র কাছে রক্ষিত মৃত্যুবাণ না এনে দিলে শ্রীরামের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল রাবনবধ করা। মাইকেল মধুসুদনরচিত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যগ্রন্থে ইন্দ্রজিতের যজ্ঞগৃহে লক্ষন-প্রবেশের ঘটনায়,লক্ষণ যে সন্ত্রাসবাদীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা’ গুণী পাঠকমাত্রই জানেন।

নিরস্ত্র মেঘনাদকে লক্ষণ হত্যা করেছিল। আরএই সন্ত্রাসবাদী কর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেবতারাই ইন্ধন যুগিয়েছিলেন।

আমাদের বিচার্য বিষয় এই সন্ত্রাসবাদ যখন কোনো সমাজ বা দেশের হিতার্থে ব্যবহৃত হয়,তখন তা প্রশংসনীয় হয়,যদিও তা’ প্রশ্নসূচক(?)। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন ‘সন্ত্রাসবাদ’ যখন কোথাও নিন্দনীয় হয়,অন্য কোথাও তা’ প্রশংসনীয় হতে পারে। আবার ঠিক এর বিপরীতও হতে পারে।

সমস্ত পৃথিবীর মানুষ যেদিন এরকমই ভাবতে শিখবে,সেদিন আতঙ্কবাদ বা সন্ত্রাসবাদ শব্দটির অপপ্রয়োগ হবে না এবং মানুষের মনে নেতিবাচক ভাবনার সৃষ্টি হবে না।

তৃতীয় শব্দটি হ’ল ‘জিহাদ’। এই ‘জিহাদ’ শব্দটি এসেছে ‘জাহদাহ’ শব্দ থেকে,যার মানে হ’ল চেষ্টা করা,পরিশ্রম করা,উদ্যমী হওয়া। ইসলামিক অভিধান অনুযায়ী জিহাদের অর্থ--- কারো অসৎ প্রবৃত্তির বিরূদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করা,অন্যায় অত্যাচারের বিরূদ্ধে সংগ্রাম। উদাহরণস্বরূপ,যদি কোনো ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করার জন্য চেষ্টা করে,তাকে বলা হয় সে জেহাদ করছে।

যদি কোনো চাকুরীজীবী চেষ্টা করে,পরিশ্রম করে,তার মনিবকে খুশি করার জন্য---সে ভাল কাজ দিয়েই করুক আর খারাপ কাজ দিয়েই করুক,সেটাই জিহাদ।

এখন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদন পরিবেশন করা যাক। সেই অসাধারণ ব্যক্তিটির নাম অনেকেই জানেন; তিনি ছিলেন মুম্বাই হাইকোর্টের একজন বিচারক। ১৯৯১-সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বিচারক হসবেট সুরেশ সাধারণ জীবনে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন।

তিনি অনেক আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা করেছেন। ১৯৯২-৯৩ সালে তিনি মুম্বাই সম্পর্কিত লেখা প্রতিবেদনের জন্য প্রশংসা পেয়েছেন---যার শিরোনাম ছিল ‘জনগণের বিচারক’। গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার ওপর লেখা ‘CRIME AGAINST HUMANITY’ বা মানবতার বিরূদ্ধে অপরাধ ২০০০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হবার পর বহু প্রশংসিত হয়। তাঁর প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে মুম্বাই-এর দলিত,কেরালার ছাত্র,গুজরাটের খৃস্টান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এবার শোনা যাক আজকের উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদনটি--- (এটি ছিল বিচারক হসবেট সুরেশের একটি আনুষ্ঠানিক দীর্ঘ বক্তব্যের ভাষান্তরিত কিয়দংশ):---

“বন্ধুরা, আমি শুরুতেই ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বিচারক লর্ড টার্নিগের প্রসঙ্গ উল্লেখ না ক’রে পারছি না।

তিনি একবার একটা কথা বলেছিলেন—‘বিচারকরা অভিনেতাদের মতো অন্যকে খুশি করার জন্য,উকিলদের মতো মামলায় জেতার জন্য,ঐতিহাসিকদের মতো অতীতকে জানার জন্য কথা বলে না; বরং বিচারকরা কথা বলে রায় দেওয়ার জন্য। ‌” আমি একজন ‘রিটায়ার্ড বিচারক বটে,কিন্তু টায়ার্ড নই। অবশ্য আমি এখানে কোনো রায় দেব না,শুধু কথা বলবো। আমি মানুষের বাক্-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী,তাই মানুষের অধিকার নিয়ে আগেও কথা বলেছি। আমি সব সময় চেয়েছি,বিচারকরা এসব বিষয়ে কথা বলুক।

কারণ তারা যদি এসব অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ না করে,তাহলে কে-ই বা এর প্রতিবাদ করবে? আমাদের কাছে এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে,সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জবাব দিতে গিয়ে প্রত্যেক দেশের সরকারই আরো বেশি সহিংসতার জন্ম দেয়। আর এভাবেই এটা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। এভাবে এ পদ্ধতিতে সন্ত্রাস দমন তথা এ জাতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
১৯৮৪ সালে দিল্লী ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকায় বেশ কিছু বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল যেটা করেছিল খালিস্থানীরা। সে সময় সন্ত্রসী গ্রুপ খালিস্থানীদের বিরূদ্ধে ভারতে বিদ্রোহ চলছিল,তখন আমরা ‘টাডা’ নামক একটি আইন প্রণয়ন করি যেটা ছিল খুবই কঠোর।

আপনারা জানেন যে,টাডার অনেক অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ হয়েছে। এই আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে অনেক নিরীহ মানুষকে আটক করা হয়েছে। তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। আমার মনে পড়ে পাঞ্জাব হাইকোর্টের একজন প্রবীণ বিচারক অজিত সিং বেইনস্ একটা জনসমাবেশে তৎকালীন সময়ে ভারতে চলমান অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,একদিন আমরা এই আইন থেকে মুক্তি পাব।

‌’ তাকেঁ আটক করা হ’ল এবং তাকেঁ পরানো হ’ল হাতকড়া। আইনটা এমনই ছিল যে,একজন বিচারকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হ’ল হাইকোর্টে। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারকরা জামিন দিতে পারলেন না। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টে গেলেন। সেখানেও জামিন বা মুক্তি না পেয়ে তিনি জেলখানার মধ্যে কাটালেন এক বছরেরও বেশি সময়।

আর সবশেষে দেখা গেল এটা কেস্ বা মামলা নয়। ‘টাডা’ আইনের ক্ষমতাবলে পঁচাত্তর হাজারেরও বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছিল। সবাই ছিল জেলখানায়। কাউকে জামিন দেওয়া হয়নি। এই আইনের আওতায় পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর সব নির্যাতন চালাত।

তারপর ১৯৯৫ সালে ভারত সরকার ‘টাডা’ নামক এই জঘন্য আইনটিকে বাতিল ঘোষনা করল। তখন দেখা গেল হাজার হাজার মানুষের ওপর অত্যাচার, অবিচার করা হয়েছে। বাহাত্তর হাজার বন্দীকে মুক্ত ক’রে দেওয়া হ’ল যাদের মামলা,বিচার কিছুই হ’ল না। শুধু তারা মাসের পর মাস,বছরের পর বছর জেলখানার ভেতরে অত্যাচার সহ্য করেছে। তাছাড়া এই জঘন্য আইনে আমরা দোষী সাব্যস্ত করতে পেরেছি মাত্র(১.৮%)এক দশমিক আট শতাংশ লোককে।

কিন্তু তারপরেও এক সময় এটা বলবৎ ছিল,যার ফলে পুলিশ হয়ে গিয়েছিল স্বৈরাচারী। পুলিশ যা খুশি করতে পারত অথচ কেউ কিছু বলতে পারত না। রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই আইনকে ব্যবহার করত। যে কোন লোককে আটক ক’রে জেলখানায় বন্দী রাখতে পারত এবং কোনভাবেই জামিন পাওয়া যেত না। অতঃপর সারা দেশে এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় ১৯৯৬ সালে টাডা আইন বাতিল করা হ’ল।

আমরা এর সবাই প্রতিবাদ করছি;এটা একটা নিষ্ঠুর আইন। এ ধরনের কোনো আইন আমরা চাই না। এ ধরনের আইন দিয়ে সন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে না;আরও বাড়বে।
এরপর এল ‘পোটা আইনের প্রহসন’। এ সময় নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ঘটে গেল এক প্রলয়ঙ্কারী ঘটনা।

মি.বুশ তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ ঘোষণা করলো সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে এবং বললো, ‘যারা আমাদের সাথে নেই তারা আমাদের শত্রু। তখন আমরা আমেরিকা তথা বুশের পক্ষ অবলম্বন করলাম এবং ‘পোটা’ আইন প্রনয়ণ করলাম। এই আইনেও সেই একই ঘটনা ঘটল। পোটা বহুমুখী একটা আইন। এর আওতায় যে কোনো মানুকে আটক করা যাব।

টাডা আইনের মতো এখানেও অনেক মানুষের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে,সন্ত্রাসী হোক বা না হোক। এ ধরনের আইন শুধু আতঙ্ক ছড়ায়। তাই মানুষ এখন পোটার মতো আইন চায় না। ‌২০০৬ সালে বোম্বে ট্রেনের বোমা বিস্ফোরণ এবং তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনা প্রত্যক্ষ ক’রে উপলব্ধি করেছে যে,কঠিন কোনো আইন ছাড়া সন্ত্রাস দমন করা যাবে না। কিন্তু আমি বলি,কঠিন কোনো আইন দিয়ে সন্ত্রাস থামানো যায় না।

এদেশ কেন?পৃথিবীর কোথাও এর নজীর নেই। সংসদে পোটা আইনের বিতর্কিত এক পর্যায়ে ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদে আক্রমণ করা হ’ল। এভাবে ২০০২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর অক‌শর্ধাম মন্দিরে,২০০২-এর ২৪ শে নভেম্বর রঘুনাথ মন্দিরে,২০০৩-এর ২৫ শে অগাস্ট গেট অফ ইন্ডিয়ায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই ‘পোটা’ আইন থাকা সত্ত্বেও এভাবে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ২০০২ সালে তৎকালীন ভারতের এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন,সে বছর জম্মু ও কাশ্মীরে সব মিলিয়ে (৪০৩৮) চার হাজার আটত্রিশটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছিল যদিও সেখানে আর্মি,নিরাপত্তা রক্ষী এবং এই আইনটা বলবৎ ছিল।

সে সময়েই সেখানে ১০০৭ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে,যাদের মধ্যে ৫০৮ জন অন্য দেশের নাগরিক। কাশ্মীরে গত সতের বছরে এ পর্যন্ত মারা গেছে আশি সহস্রাধিক মানুষ,হারিয়েও গেছে অনেকে। অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে পাঞ্জাবে। সে সময় পাঞ্জাবে খালিস্থানীদের বিদ্রোহ চলছিল। হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে।

কেউ জানে না তাদের কী হয়েছে!এমন কি কয়েক বছর আগেও ‘বিয়াস’ নদীর তীরে অনেক লাশ,কঙ্কাল ও মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে। আমি একবার একটা তদন্ত করতে গিয়েছিলাম। সেখানে ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম সেখানের বেশিরভাগ বাড়িতে বয়স্ক লোকজন,শিশু বাচ্চারা আছে;কিন্তু কোনো তরুণ বা যুবক নেই। তাদের কী হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। তারা শুধু এতটুকু জানে যে, গভীর রাতে তাদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল,তারপর তারা আর ফিরে আসেনি।

এ ঘটনার আট-দশ দিন পর বিভিন্ন জায়গায় তাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

এমনই ছিল সেই আইন,যেখানে সহিংসতা ছিল একটি অবিরাম প্রক্রিয়া এবং খুনের পরিবর্তে খুন সেখানে অহরহ ঘটত। মনিপুর,ছত্তিশগড়,তেলেঙ্গানা এরকম আরও অনেক জায়গায় খুনোখুনি,হত্যাযজ্ঞ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বললেন---আমাদের একটা সন্ত্রাস বিরোধী অধ্যাদেশ প্রয়োজন।

অনেকদিন আগে কাশ্মীরে আমরা একটা পরীক্ষা করেছিলাম।

তাদেরকে জেলখানার ভিতর আটকে রেখেছিলাম বছরের পর বছর। এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেল। সরকার তাদের মগজ ধোলাই করে বললো— তোমরা ফিরে গিয়ে তোমাদের লোকদেরকে বোঝাও,এভাবে যুদ্ধ করতে নিষেধ করো এবং ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব বদলানোর ব্যাপারে সহায়তা করো। তখন তারা বললো---আমরা ফিরে গেলেই আমাদেরকে মেরে ফেলা হবে। তারপর আমাদের সরকার বললো---আমরা অস্ত্র দেব।

অবশেষে তারা অস্ত্র হাতে ফিরে গেল।

আমার মনে আছে,একবার নির্বাচনের সময় পাঞ্জাবে ‘ডেমোক্রেটিক রাইটস্ অর্গানাইজেশন্’(গণতান্ত্রিক অধিকার সংস্থা) একটা প্রতিবেদন ছাপালো। সেখানে বলা হল যে,পাঞ্জাবে ভোট নেওয়া হচ্ছে বন্দুকের মুখে,সেখানে সশস্ত্র সেনাবাহিনীসহ আরো অনেক মানুষের দল বা গোষ্ঠির কাছে ব্যাপক অস্ত্র রয়েছে। এক কথায় ভারতের মানুষ এখন বন্দুকের মুখে,সহিংসতার জবাব সহিংসতা দিয়েই হচ্ছে। এভাবে কি সমস্যার সমাধান সম্ভব?

ছত্তিশগড়ে অনেক মাওবাদীরা ও নকশালপন্থীরা আছে।

তাদেরকে শেষ করার জন্য প্রায় ৫০০০ আদিবাসী নিয়ে ‘সালওয় জুলুম’ নামে একটা বাহিনী তৈরি করা হল। এর ফলাফল হিসেবে আদিবাসীরা সব মারা গেল এবং নকশালপন্থীরা এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের একটু ভাবতে হবে,এখনও পর্যন্ত এদেশে কোনো সন্ত্রাসীর প্রকাশ্যে বিচার হয়নি,শুধু হত্যা করা হয়েছে। যেমন,মুম্বাইতে ১৯৯৩ সালে একটা বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল। এর আসল অপরাধী কা’রা আমরা এখনো তা বের করতে পারিনি।

এর পাশাপাশি অনেক লোকজন জেলখানায় বন্দী হয়ে আছে বছরের পর বছর। কবেইবা তাদের মামলার শুনানী হবে,বিচার হবে,তারা কিছুই বলতে পারে না। আর এটাই বাস্তবতা। এছাড়া অকশর্ধাম্ মন্দির যারা আক্রমণ করেছিল তাদের মেরে ফেলা হ’ল। সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা হলেও কাজটা আসলে কা’রা করেছিল তা’ আমরা জানি না।

এ ধরনের কাজ আমরা ক’রে যাচ্ছি। সহিংসতার জবাব দিতে গিয়ে আমরা আরো বেশি সহিংসতার সৃষ্টি করেছি। এভাবেই চলছে দেশের জীবনব্যবস্থা। এমনকি নাইন-ইলেভেনের (১১-ই সেপ্টেম্বর) পর বুশ সন্ত্রাসের অজুহাতে সারা বিশ্বের মুসলমানদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো।
আফগান হামলা ছিল সন্ত্রাসীদের বিরূদ্ধে,ওসামা বিন্ লাদেনের বিরূদ্ধে।

বুশ আফগানিস্থানে বোমা হামলা করলো,মারা গেল অসংখ্য গরীব,অসহায়,নিরীহ নারী পুরুষ। ইরাককেও একই বুশ প্রশাসন কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহ ক’রে বসলো। ইরাকে নাকি তালেবান এবং ভয়ঙ্কর সব রাসায়নিক অস্ত্র আছে,এই মিথ্যে সন্দেহের ওপর ভিত্তি ক’রেই বুশ ইরাকের বিরূদ্ধে বোমা হামলা ও যুদ্ধ শুরু করলো। অনেক নিরীহ মানুষ সেখানে মারা গেল। এ পর্যন্ত বিশ্ব বানিজ্য কেন্দ্রে যত লোক মারা গেছে তার কুড়ি গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে শুধু ইরাকে।

এখন আমরা সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করবো কাকে? আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি---বর্তমান বিশ্বে যদি কাউকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়,তাহলে সেটা হবে জর্জ ডব্লিউ বুশ। তিনি একটা অযৌক্তিক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেন,সকল আইন লঙ্ঘন করলো,এমনকি আন্তর্জাতিক আইনেরও তোয়াক্কা করা হয়নি।
হিন্দু,খ্রিস্টান,মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের যে কেউ এ যুদ্ধের প্রতিবাদ করতে পারে,সে অধিকার আমাদের আছে। কারণ শুধু নিন্দা ও প্রতিবাদ করলেই আমরাও সন্ত্রাসী হয়ে যাব না। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো---সন্ত্রাসকে সজ্ঞায়িত করা তথা বিশ্বের মাঝে সন্ত্রাসের পরিচিতি তুলে ধরা।

আর কিভাবে আপনি সন্ত্রাসের সজ্ঞা দেবেন? ‘টাডা’, ‘পোটা’ ইত্যাদি তথাকথিত আইনেও সন্ত্রাসের সজ্ঞা দেওয়া হয়নি। শুধু সন্ত্রাসী কাজের সজ্ঞা দেওয়া আছে। আর এরকম কাজের কথা যেমন নরহত্যা,খুন,ডাকাতি,অস্ত্রবাজি এসব ভারতের পেনাল কোডে আছে,কিছু সাধারণ আইনের আওতাভূক্ত রয়েছে;কিন্তু তারপরও পুলিশ তার নিজের সুবিধামতো এসব কাজকে সন্ত্রাসী কাজ ব’লে অভিহিত করছে। যদি আপনারা সবাই মেনে নেন যে ইচ্ছাকৃতভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যা করাই সন্ত্রাসী কাজ,যেটা বেশিরভাগ সজ্ঞার মূল কথা,তাহলে আমি বলবো গত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হ’ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এবার একটা অদ্ভুত খবর শোনা যাক।

খবরটির হেডলাইন দেওয়া যাক এই ব’লে---‘সন্ত্রাসী নোবেল পুরস্কার পেল’:- ‘১৯৪৬ সালের ২২ শে জুলাই কিং ডেভিড হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। মেনাফেম বেগেন-এর নেতৃত্বে ইরগুন(সন্ত্রাসী দল) কর্তৃক এই বিস্ফোরণটা ঘটে। সেখানে ৯১ জন নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছিল; তন্মধ্যে ২৮ জন বৃটিশ,৪১ জন আরব,১৭ জন ইহুদী এবং অন্য আরও পাঁচজন। এই ইরগুন গ্রুপ, আরবদের মতো পোষাক পরিধান করেছিল,যাতে লোকজন মনে করে আরবরা-ই এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আর এ ছিল বৃটিশ ম্যানডেটের বিরূদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আক্রমণ।

সেই সময়ে মেনাফেম বেগানকে বৃটিশ সরকার এক নম্বর সন্ত্রাসী ব’লে অভিহিত করেছিল। কিন্তু দেখা গেল,কয়েক বছর পর তিনিই হলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং আরো কিছুদিন পর তিনি ‘শান্তি’-তে নোবেল পুরস্কার পেলেন। চিন্তা করার বিষয়,যে মানুষটা খুন করেছে হাজার হাজার মানুষকে,সেই প্রধানমন্ত্রী হয় ইসরাইলের। কিছুদিন পর শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারও পায়। আর তখন ইরগুন,হ্যাগানা,স্টার্নগ্যাং এইসব সন্ত্রসী দল ও তাদের নেতারা যেমন আইজেক রবীন,মেনাফেম বেগান,এরিয়েল শ্যারন,এঁরা সবাই পরবর্তীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী অথবা উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা হয়েছিলেন।

এরা সবাই যুদ্ধ করেছিল ইহুদী রাষ্ট্রের জন্য। একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর মানচিত্রে ১৯৪৫ সালের আগে ইসরাইল নামে কোনো দেশ-ই ছিল না। এই ইহুদী দলগুলো,খোদ ব্রিটিশরা যাদেরকে সন্ত্রাসী ব’লে ডাকতো,এরা একটা নতুন ইহুদী রাষ্ট্র গড়ার জন্য লড়েছিল। পরে তারা শক্তি দিয়ে ইসরাইল দখল ক’রে প্যালেস্টাইনদের তাড়িয়ে দেয়। এখন এই লোকগুলোই নির্লজ্জভাবে প্যালেস্টাইনের লোকদের বলছে সন্ত্রাসী(যাঁরা তাঁদের হারানো প্রিয় স্বদেশ ফিরে পেতে চাইছে)।

‌’

এই রিপোর্টের সঙ্গে সংযোজন করে যদি বলা হয় বর্তমান ‘কাশ্মীর’ তার স্বাধীনতা ফিরে পেতে চাইছে,তবে অনেকেই হয়তো বক্তার প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য প্রকাশ করবেন। কিন্তু যা সত্য,তা একদিন অনির্বাণ আলোক শিখার মতো উঠে আসবেই। কাশ্মীর ছিল একটি স্বাধীন দেশ। কাশ্মীরের মাটিতে জন্ম নেওয়া মানুষদের মুখে সর্বপ্রথম যে কথাটি উঠে আসে তা হ’ল তাঁরা ‘কাশ্মীরী’--- না ভারতীয় না পাকিস্তানী। আর সে জন্যেই ওরা আমাদের বলে ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানের মানুষদের বলে পাকিস্তানী।

কাশ্মীরিদের ভাবনায় ধরা পড়ে দু’দেশের সন্ত্রাসী-প্রতিচ্ছবি। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশই জবরদখলদার। ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার কালে জম্মু ও কাশ্মীর আর দশটা অঙ্গরাজ্য’-র মতো ছিল না। এটি ছিল ১৪০টি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন করদ রাজ্যের অন্যতম। ফলে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে এই রাজ্যগুলি স্বাধীন থাকবে, নাকি ভারত পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে তা নির্ধারণের স্বাধীনতা ছিল ঐ রাজ্যগুলিরই।

জম্মু-কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীন থাকার ইচ্ছাই পোষণ করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির চাপে প’ড়ে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন ভারতের সাহায্য গ্রহণ করতে;সে আর এক ইতিহাস। ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে পুঞ্চ অঞ্চলের অধিবাসীরা জম্মু-কাশ্মীরের সরকারের বিরূদ্ধে একটি অভ্যুত্থান সংগঠিত করে। কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পার্বত্য অধিবাসীরা জম্মু-কাশ্মীরের উপর আক্রমণ চালায়। এ সবের পেছনে পাকিস্তানের মদদও ছিল।

এরকম একটা পরিস্থিতিতেই ১৯৪৭-র ২৬শে অক্টোবর ভারত এবং জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যে একটি ‘অন্তর্ভূক্তি সংক্রান্ত দলিল’(Instrument of Accession) স্বাক্ষরিত হয়। শর্ত ছিল,ভারত কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে,অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নয় এবং কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে কাশ্মীর ভারতের সাথে থাকবে নাকি স্বাধীন থাকবে। সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে চুক্তির ৮ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল: ‘Nothing in this Instrument affects the continuance of my sovereignty in and over this state,or save as provided by or under this Instrument, the exercise of any powers, authority and rights now enjoyed by me or ruler of this state or the validity of any law at present in force in this state.’ অর্থাৎ হরি সিং পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন,এই প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি মানে এই না যে জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতা তিনি ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শুধু তাই না,তিনি ভারতের কোনো সংবিধান মেনে চলার কোনো নিশ্চয়তা দেননি। চুক্তির ৭ ধারায় বলা আছে:- ‘Nothing in this Instrument shall be deemed to comment in any way to acceptance of any future constitution of India or to fetter my discretion to enter into agreement with the Govt. of India under any such future Constitution.
তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ঐ চুক্তি স্বাক্ষরের ৬ দিন পর ঘোষণা করেন:- ‘We have declared that the fate of Kashmir is ultimately to be decided by the people of Kashmir. That pledge we have given and the Maharaja has supported it, not only to the people of Kashmir but to the world. We will not and cannot back out of it. We are prepared when peace and law and order have been established to have a referendum held under international auspices like the United Nations. We want it to be a fair and just reference to the people and we shall accept their verdict. I can imagine no fairer and juster offer.’[সূত্র:Instrument of Accession of Jammu and Kashmir State 26 october,1947,Legal Document No.113]

অর্থাৎ ‘আমরা ঘোষণা করেছি যে কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরের জনগণই নির্ধারণ করবে।

শুধু কাশ্মীরের জনগণই নয়, সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এই প্রতিজ্ঞা করেছি আর মহারাজা আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। এর অন্যথা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। আমরা প্রস্তুত আছি,যে মুহুর্তে কাশ্মীরে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে,সে মুহুর্তেই জাতিসঙ্ঘের মতো কোন আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের অধীনে গণভোটের আয়োজন করা হবে। আমরা চাই এ নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে,জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে এবং আমরা এই জনরায় মেনেও নেব। এর চেয়ে ভালো এবং ন্যায়বিচারমূলক কোনো প্রস্তাব তো আর আমার মাথায় আসছে না।

‌’
কিন্তু কোথায় সেই ন্যায়ের প্রতিফলন? নেহেরুর প্রতিশ্রুতির পর দীর্ঘ ৬৩ বছর পার হয়ে গেল,কাশ্মীরে শান্তি-শৃঙ্খলা আর ফিরে এল না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ,ইরাক দখলের সময় ১৬৬ জন ইরাকীর জন্য একজন ক’রে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু অবাক হতে হয়, কাশ্মীরে কুড়িজন নাগরিকের জন্য একজন ভারতীয় সেনা বা অর্ধসেনা নিযুক্ত আছে। কাশ্মীরে মোট জনসংখ্যা ১ কোটির কিছু বেশি। আর এই ছোট্ট দেশের জন্য সেনা নিযুক্ত করা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার রাষ্ট্রীয় রাইফেল সেনা ও এক লক্ষ ৩০ হাজার সি আর পি এফ জোয়ান।

এছাড়াও আছে রাজ্যের লাখ খানেক পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী। আর এই সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে দেওয়া হয়েছে মানুষ খুন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। ১৯৯০ সালের ৫ই জুলাই কাশ্মীরে সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন(আর্মড্ ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট) জারি ক’রে তাদের হাতে এই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। এই আইনের ৪(এ) ধারায় বলা হয়েছে যে,সশস্ত্র সামরিক বাহিনী যে কোনো সন্দেহভাজন নাগরিককে হত্যা করতে পারবে। [সূত্র: স্যোসালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়ার বাংলা মুখপত্র ‘গণদাবী’-র ৬-১২ অগাস্ট সংখ্যা।

ওয়েবসাইট: http//www.ganadabi.in/isues 2010/gd080610.pdf] এই বিশেষ ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে হত্যা,ধর্ষণ,লুন্ঠন ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু ঘটনা তুলে ধরা যাক:--
বলা বাহুল্য,এই ঘটনাগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে কাশ্মীরী জনগণের বিক্ষোভের যথার্থ কারণ:--
৮-ই জানুয়ারি ,২০১০,১৬ বছর বয়স ইনায়েত খান বিকেলে কোটিং সেরে বাড়ি ফিরছিল। শ্রীনগরের বাদশা চকে প্রতিবাদ-সভা চলছিল। পুলিশ প্রতিবাদীদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ ইনায়েতের আর বাড়ি ফেরা হলনা,কবর-স্থান হ’ল তার শেষ ঠিকানা।



৩১ শে জানুয়ারি,১৩ বছরের ওমর ফারুক শ্রীনগরের গণি মেমরিয়াল স্টেডিয়ামে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিল। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে সেদিন তার সব খেলা সাঙ্গ হয়ে যায়। ৫ই ফেব্রুয়ারি কাশ্মীর যেদিন ওয়ামিকের শোকপালনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল,সেদিন ১৪ বছরের আর এক বালক জাহিদ বি এস এফ-এর গুলিতে প্রাণ হারায়।

১৩ এপ্রিল,সোপুরের সরকারি স্কুলে একাদশ শ্রেণির ছাত্র ১৭ বছর বয়সী জুবের আহমেদ ভাট,ঝিলাম নদীর পাড়ে বসেছিল। বিক্ষোভরত কিছু মানুষ পুলিশের তাড়া খেয়ে সেখানে চলে আসে।

পুলিশ নির্বিচারে সবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়,পুলিশ জুবেরসহ প্রত্যেককে নদীতে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে। অন্যরা সাঁতরে পাড়ে উঠতে সক্ষম হলেও ,জুবের তলিয়ে যেতে থাকে। মাঝিরা বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়তে থাকায়,তারা জুবেরের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়।

জুবের প্রাণ হারায়।

১১-ই জুন,রাজৌরির তোফায়েল আহমেদ মাত্তু তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান;দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। টিউশানি শেষে সে বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফিরছিল। কাঁধে ছিল স্কুলব্যাগ। কাছেই কোথাও হয়তো বিক্ষোভ চলছিল,তোফায়েল জানত না।

একদল যুবক পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়াচ্ছিল। তোফায়েলদের দেখতে পেয়ে পুলিশ তাদেরও পিছু নেয়। ভয় পেয়ে কিশোর তোফায়েলরা সামনের গণি মেমোরিয়াল স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ে। পুলিশ স্টেডিয়ামে ঢুকে গুলি চালায়। তোফায়েলের আর ঘরে ফেরা হ’ল না;গুলি লেগে তোফায়েলের মস্তক চূর্ণ হয়ে যায়।



অমানবিক অত্যাচারের এই তালিকা এত দীর্ঘ যে এই সামান্য পরিসরে তা’ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ হত্যাকান্ডগুলোর ধরণ-ধারণ খতিয়ে দেখলে,অনুমান করা শক্ত নয় যে একটা জনগোষ্ঠির তরুণ অংশকে একরকম খেয়াল খুশি মতো খুন করার বিপরীত প্রতিক্রিয়া সেই জনমানসের ওপর কেমন হতে পারে। একদিকে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন,অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য,তীব্র বেকারত্ব,কৃষি-শিল্পের অনগ্রসরতা ইত্যাদি কাশ্মীরবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় দখলদার ভারতের সাথে তাদের সম্পর্কের স্বরূপ কী।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘অনীক’-এর জুলাই,২০১০ সংখ্যায় প্রণব দে লিখেছেন:- ‘১৯৪৭ থেকে কাশ্মীর, ভারত ও পাকিস্তান এই দু’পক্ষের মধ্যে পিষ্ট হচ্ছে। এটা দু’পক্ষের মর্যাদার লড়াই অথবা অন্য বিচারে কাশ্মীর দু’পক্ষেরই সেফটি ভাল্ব।

শাসক শ্রেণির সঙ্কটমোচনে সীমান্ত যুদ্ধ বেশ শক্তিশালী দাওয়াই। আর কাশ্মীরের মানুষ(আজাদ কাশ্মীরসহ)এই রাজনৈতিক পূজার্চনায় বলিপ্রদত্ত পশু। ‌’সাম্প্রতিক বিক্ষোভসহ ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠে কাশ্মরিবাসী পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে বলি’র পাঁঠা আর তাঁরা হতে চান না। তাঁরা স্বাধীন কাশ্মীরেরই স্বপ্ন দেখেন। যে জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-যুবা নির্বিশেষে পাথর হাতে রাস্তায় নেমে আসে দখলদারের বুলেট মোকাবিলা করতে,তাদের আর দাবিয়ে রাখার সাধ্য কারো নেই।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হোক কাশ্মীরীদের প্রেরণা! [তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট]

সবশেষে,রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিষয়ে প্রকাশিত একটি তথ্য:-(সংকলন প্রবীর ঘোষ,কাশ্মীরে আজাদির লড়াই,পৃ: ১০১--১০৩)
‘হ্যাঁ,আমরা কাশ্মীরের কথাই বলছি---“সশস্ত্র বাহিনী(বিশেষ ক্ষমতা)আইন,১৯৫৮(AFSPA) ভারতের নিষ্ঠুরতম আইনের একটি, যেটা ভারতীয় লোকসভার ৪৫ বছরের ইতিহাসে পাস হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী সমস্ত নিরাপত্তা বাহিনীকে লাগামহীন ও দায়ভারহীন সমস্তরকম ক্ষমতা দেওয়া আছে। একবার কোন অঞ্চলকে উপদ্রুত ঘোষণা করা হলে এমনকি বাহিনীর ক্ষুদ্রতম non-commissioned অফিসাররাও শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কাউকে হত্যা করতে পারে। এই ‘AFSPA’ আইনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে হবে। ...”[সাউথ এশিয়ান হিউম্যান রাইটস্ ডকুমেন্টেশন সেন্টার।

]সশস্ত্র বাহিনীকে ঢালাও ক্ষমতা দিয়েছে গুলি করে হত্যা করার,গ্রেপ্তার করার এবং তল্লাশি চালানোর—সবই ‘জনজীবনের সাহায্যার্থে’এই আইন প্রথম চালু করা হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম ও মণিপুরে। তারপর ১৯৭২-এ এটি অ্যামেন্ড করে সাতটি রাজ্যেই চালু হয়—অসম,মণিপুর,ত্রিপুরা,মেঘালয়,অরুণাচল,মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড---যাদের প্রচলিত নাম ‘সাত বোন’ বা Seven Sisters.এই AFSPA লাগু করার ফলে অসংখ্য অত্যাচার,ধর্ষণ,বেআইনী আটক ও লুটের ঘটনা ঘটাচ্ছে এই নিরাপত্তা রক্ষীরা। ভারত সরকারকে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে হবে...” [সাউথ ইন্ডিয়ান হিউম্যান রাইটস্ ডকুন্টেশেন সেন্টার। ]

সমস্ত অসামরিক ভারতীয় নাগরিককে আমাদের প্রশ্ন:--

১.একটি স্বাধীন দেশে AFSPA-র মতো আইন কেন প্রয়োজন?

২.কোন্ সভ্য দেশ ‘নিজের অংশ’ বলে চিহ্নিত অঞ্চলে ২০ বছর ধরে সামরিক শাসন চালায়?

৩.অবস্থা এখন এমন যে প্রতিদিন এখানে দশ-বিশ জন করে তরুণ গুলিতে মারা যাচ্ছে—কোনও সংবাদ মাধ্যম নেই যে রিপোর্ট করবে---নেই কোন যানবাহন,কোনও ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।