নজিরবিহীন অশান্তির মধ্যে ভোট পর্ব সাঙ্গ হলো ঠিকই, কিন্তু নয়াদিল্লি মনে করছে, শেষ নয়, বাংলাদেশের আসল লড়াইটা কিন্তু এবার শুরু হলো। পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া দীর্ঘ সীমান্ত নিরাপত্তার প্রশ্নটিও যে বাংলাদেশের ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাবে— এমনটা আদৌ মনে করছে না সাউথ ব্লক। বরং দুশ্চিন্তা গাঢ়তর হচ্ছে।
নয়াদিল্লির অনুমান, ‘এই নির্বাচনের ঠিক পরেই পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর প্রবল চাপ তৈরি হবে হাসিনা সরকারের ওপর। এই ভোট অগণতান্ত্রিক— এমন আখ্যা দিয়ে ঢাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এই প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করার জন্য মুজিব-কন্যার পাশেই থাকতে চাইছে নয়াদিল্লি। ভোট ঘোষণা হওয়ার সময় থেকেই আমেরিকার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে দৌত্য চালিয়ে আসছে নয়াদিল্লি। কিন্তু জামায়াতকে মূল স্রোতে আনার পক্ষেই সওয়াল চালিয়ে গিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পাশাপাশি বিএনপি-ঘেঁষা অবস্থানই বরাবর নিয়ে এসেছে তারা। সে ক্ষেত্রে ভারতের পাল্টা যুক্তি, জামায়াতকে সমর্থন করলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র জলাঞ্জলি যাবে।
শুধু ঢাকাই নয় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা একটি বড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে পড়বে। এমনিতেই এই বছর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে গোটা অঞ্চল। তার ওপর বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র উগ্রপন্থার হাতে চলে গেলে সর্বনাশের শেষ থাকবে না— এটাই পশ্চিম বিশ্বকে বোঝাত চাইছে নয়াদিল্লি। সাউথ ব্লকের নিজস্ব আশঙ্কা, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সে দেশ থেকে শুধু হিন্দুই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ঢল নামবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারটিকে আপাতত স্থিতিশীল রাখার জন্য সক্রিয়তা আগামী দিনে চলবে।
কূটনৈতিক দৌত্যের প্রক্রিয়াও কাল থেকে আরও বাড়ানো হবে। আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি কমনওয়েলথের মঞ্চকে কাজে লাগিয়েও হাসিনা সরকারের পক্ষে স্বর তুলতে চায় ভারত। এই মুহূর্তে ‘কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিরিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ’-এর সদস্য ভারত। বর্তমান নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে কোনো কমনওয়েলথভুক্ত দেশ যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর্থিক বা অন্যকোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা ভাবে তাহলে সে ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হবে বলেই স্থির করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের জমানায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে যথেষ্ট এগিয়েছে এ কথা বারবার স্বীকার করেছে বিদেশ মন্ত্রণালয়।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করা— সব কিছুতেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে হাসিনা সরকার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মাফিক তিস্তা চুক্তি অথবা স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারত সম্পন্ন করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু নানাভাবে হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই অবস্থান হাসিনার পরের মেয়াদের জন্যও অটুট। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কোমর বেঁধে দাঁড়ানোর প্রশ্নে একটা বড় সমস্যাও রয়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিবিদরা। কেননা ভারত নিজেই লোকসভা নির্বাচনের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।
দুদিন আগেই লোকসভার পর প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। অথচ এই মনমোহনের সঙ্গেই গত পাঁচ বছর বাণিজ্য থেকে কৌশলগত বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে গিয়েছেন শেখ হাসিনা। সব দলই এখন ব্যস্ত ঘরোয়া রাজনৈতিক প্রচারযুদ্ধ নিয়ে। ফলে বিদেশনীতির প্রশ্নে এককাট্টা হওয়া যেমন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। (এ কারণে বিজেপির সমর্থনের অভাবে ঝুলে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি) তেমনই এই মুহূর্তে দেশের কোনো কূটনৈতিক দৌত্যও রাজনৈতিক শক্তির অভাবে তেমন জোর পাবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যতটা সম্ভব প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া হবে। বিদেশ মন্ত্রণালয় সূত্রের বক্তব্য, হাসিনা সরকারের নেতাদের মতো সাউথ ব্লকও একটি কথা বিশ্বাস করে। সেটি হলো, তাণ্ডবের আবহে সমাপ্ত হওয়া এবারের নির্বাচনের মুখ্য বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যালট-যুদ্ধই ছিল না। ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের লড়াই। নির্বাচনের পরও যে লড়াইটা জারি থাকবে বলেই মনে করছে ভারত।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।