আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দীন মোহাম্মদের সফরনামা: ইংরেজি ভাষায় ভারতীয়দের প্রথম বই



২০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে দীন মোহাম্মদের সফরনামা সবার অলক্ষ্যে থেকে গেছে: কিছুটা অবহেলায়, আর কিছুটা অসচেতনতায়। দীন মোহাম্মদ (১৭৫৯-১৮৫১) এর সফরনামা-ই কোন ভারতীয়র ইংরেজি ভাষায় লিখিত প্রথম বই। বইটির প্রকাশকাল ১৭৯৩-’৯৪, প্রকাশস্থল আয়ারল্যান্ড। এই সফরনামার ইংরেজি শিরনাম হলো The Travels of Dean Mahomet, A Native of Patna in Bengal, Through Several Parts of India, While in the Service of The Honourable The East India Company Written by Himself, In a Series of Letters to a Friend এবং এটি ইউরোপীয় সাহিত্যের পত্রোপন্যাস ধারায় বন্ধুর কাছে লেখা চিঠির আকারে বই হিসাবে প্রকাশ করা হয়। উত্তর ভারতের পাটনায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া দীন মোহাম্মদের এই আত্মজীবনীমূলক সফরনামার বিবরণ শুরু হয় ১৭৬৯ সালে, শৈশবে বাবাকে হারানোর পর মায়ের কাছ থেকে তার বিচ্ছেদের ঘটনার মধ্য দিয়ে।

সফর বর্ণনা শেষ হয় ১৭৮৪ সালে ঔপনিবেশিক আয়ারল্যান্ডে দেশান্তরি হওয়ার মাধ্যমে। এই সফরনামায় আমরা দেখি, দীন মোহাম্মদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক চাকুরিতে থাকাকালীন নিজ দেশে কোম্পানির বিজয় অভিযানের অংশিদার হয়ে পশ্চিমে দিল্লি আর পূর্বে ঢাকা পর্যন্ত ঘোরাফিরার সুযোগ পেয়েছেন। এসব অভিযানের সময় সাক্ষাত হওয়া মানুষ আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায় তার সফরনামায়।

দীন মোহাম্মদ অষ্টাদশ শতাব্দির টালমাটাল ভারতে ২৫ বছর পার করেন, তারপর আয়ারল্যান্ডে পাড়ি জমান। একদিকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সাংস্কৃতিক ছোঁয়া, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরির প্রতি আনুগত্য, এই দুইয়ে মিলে দীন মোহাম্মদ নিজেই ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে পড়েছেন।

বাবার অকাল মৃত্যুতে দীন মোহাম্মদ মাত্র ১১ বছর বয়সে নিজ ভবিষ্যত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। ১৭৬৯ সালে তিনি গডফ্রে ইভান বেকার নামের এক প্রোটেস্ট্যান্ট অ্যাংলো অফিসারের ক্যাম্প ফলোয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৮ বছর পরে বেকারের মৃত্যু পর্যন্ত এই দু’ব্যক্তি সর্বত্র একসঙ্গে চলে ফিরেছেন। ১৭৬৯ - ৮৩ সময়কালে বেকার সাধারণ ক্যাডেট থেকে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় উন্নীত হন, সেসঙ্গে দীন মোহাম্মদও সাবঅলটার্ন অফিসারের পদে উন্নীত হন। এই পুরোটা সময় দীন মোহাম্মদ তার আত্মীয় স্বজনের মাঝে সম্মানী অতিথি হিসেবে মর্যাদা পেলেও ইংরেজদের সামরিক বাহিনীতে চাকুরি করার কারণে আত্মীয়দের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠেনি।

এমনকি কখনো কোন ভারতীয় তাকে অপমান করেছে, আবার অন্য কোন ভারতীয় তাকে রক্ষা করেছে।

সেসময়ের ইংরেজভাষী ইউরোপীয়দের পক্ষে একথা মেনে নেয়া কঠিন ছিল যে ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে থাকা একজন ভারতীয়র পক্ষে এমন একটি বই ইংরেজিতে লেখা সম্ভব। এই সফরনামা-র চেয়ে বেশ নিম্নমানের বইপুস্তকও তখন আয়ারল্যান্ডে বিভিন্ন পর্যালোচকদের সুদৃষ্টি পেত। হয়ত এ কারণেই বইটি প্রায় দুশ বছর তেমন কোন আলোচনা সমালোচনা ছাড়াই চাপা পড়ে ছিল। তবে ভারতীয়দের জন্য দীন মোহাম্মদ যে একজন বীর সে কথা বলাটা বিতর্কের সূত্রপাত ঘটায়।

তিনি যেমন ভারতীয়দের ভাল দিক দেখিয়েছেন, অসংস্কৃত দিকও তুলে ধরেছেন, তেমনি ইংরেজ ও ইউরোপীয়দের প্রতি আনুগত্যও অস্বীকার করেননি। বইটি তিনি বেঙ্গল আর্মির ইংরেজ কোম্পানির কর্ণেল, উইলিয়ম এ. বেইলিকে উৎসর্গ করেন। আয়ারল্যান্ডে গিয়ে মুসলিম পরিবারের দীন মোহাম্মদ বিয়ে করেন খ্রিস্টান নারী। পরবর্তী জীবনকালে দীন মোহাম্মদ তার নিজ সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মর কতটুকু নিজ পরিবারে অব্যাহত রেখেছিলেন, সে বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে।

মাইকেল এইচ. ফিশার এর সম্পাদনায় ক্যালিফোর্ণিয়া ইউভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত The Travels of Dean Mahomet- An Eighteenth-Century Journey through India এবং সে বইয়েরই বর্ধিত সংস্করণ ১৯৯৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত Dean Mahomet: The First Indian Author in English: Dean Mahomet in India, Ireland and England একাডেমিক মহলে দীন মোহাম্মদের সফরনামাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

এই সফরনামা থেকে জানার, গবেষণার যথেষ্ট অবকাশ আছে। আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন ইউনিট সম্বন্ধে জানতে পারি, বইটিতে তাদের অবকাঠামোও তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন শহরের বর্ণনা পায় এখানে। হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মিশেল দেখতে পাই, যখন বলা হয়, মুসলমান শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠানের ৪টি ধাপের প্রথমটি সম্পন্ন করা হতো ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে। কিভাবে সম্ভ্রান্ত নবাবি মুসলিম সমাজ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এলো, দীন মোহাম্মদ সে ব্যাখ্যাও দেন।

সে সময়ের দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্রও সফরনামায় আছে। কলকাতা আর ঢাকার প্রাচুর্যের কথাও দীন মোহাম্মদ বর্ণনা করেছেন। তবে তার বর্ণনা কতটুকু সত্য, কতটুকু রঙ চড়ানো, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন গবেষকের। এরপরও মূল কথাটি হলো, দীন মোহাম্মদের সফরনামা সেই বই যেটি লেখা হয়েছে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় পাঠকের জন্য, কিন্তু এর লেখক উপনিবেশের যাঁতাকলে পিষ্ট এক ভারতীয় যাকে নিজ জীবনে নিজ ঐতিহ্য-সংস্কার ও ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে এক জটিল বোঝাপড়া করতে হয়েছে।

আগামীতে এখানে সফরনামার ৩৮টি পত্রের মধ্যে আপাতত পত্র ১, ২, ৩, ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ এর অনুবাদ তুলে ধরা হবে।

এই ক’টির অনুবাদ সোনারদেশ ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।