আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কথা না বলার না বলা কথাগুলো

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!!

আমার নাম মিশু। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফিফথ ইয়ারে পড়ি।

প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে প্রেমে পড়ে। কেউ প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায়, আনাড়ি সাঁতারুরা নিমিষেই তলিয়ে যায়, অভিজ্ঞরা ঠিকই ভেসে থাকে অনেকক্ষণ। আমি ছিলাম প্রথমদের দলে, সুতরাং নিয়ম মেনে কলেজপড়ুয়া তরুণ কিশোর এই আমি একদিন আবিষ্কার করলাম আমি একজনের নাম শুনলে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছি না, আমার নাক গরম এবং কান লাল হয়ে যাচ্ছে, আমার হৃদয় ধুমধাম বুকের খাঁচার সাথে বাড়ি খাচ্ছে।

আমি কয়েকদিন একজন ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারলাম না, একজনের হাসি আমার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে লাগল, একজনের স্মৃতি আমার মানসপট থেকে অন্য সবকিছু যত্ন সহকারে ধুয়েমুছে সাফ করে দিল, একজনকে এক মুহূর্ত দেখতে পেয়ে আমি নিজেকে সারা পৃথিবীর অধীশ্বর টাইপ কিছু একটা মনে করতে থাকলাম এবং করতেই থাকলাম।

যার প্রেমে আমি পড়লাম তার নাম এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, ধরে নেয়া যাক তার নাম ঝর্ণা। কারণ ঝর্ণার মতই প্রগলভা সে, ঝর্ণার মতই কলকলে তার হাসি। সমস্যা হচ্ছে একইভাবে নদী, সাগর, আকাশ, ফুল সবকিছুর সাথেই তার তুলনা করা যেত, এবং তুলনা করা হলে সে নয়, সম্ভবত প্রাণ থাকলে নদী আকাশ সাগর ফুল নিজেই ধন্য হয়ে যেত। সুতরাং তার নাম নিয়ে আমরা এখানে তর্ক বিতর্ক করব না।



আমি প্রথম যখন তাকে দেখি তখন সে ক্লাস ইলেভেনে। আমাদের কলেজে পড়ে, আমরা একই স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি প্রাইভেট পড়ি। কেমিস্ট্রি প্রাইভেট পড়তে পড়তে কখন যে আমাদের মধ্যে অদ্ভুত এক কেমিস্ট্রি গড়ে উঠল আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি নি। আমি এক পর্যায়ে আবিষ্কার করলাম স্যারের কাছে আমি পড়া না পারলে তার মন খারাপ হয়ে যায়, আমি পড়তে না আসলে সে আমার বন্ধুদের কাছে খোঁজখবর নেয়। আমি মনে মনে খুশি হই।

প্রচণ্ড খুশি। কিন্তু কি করব বুঝতে পারি না।

কি করব? বলব ওকে আমার ভালো লাগে? নাকি মিথ্যা করে বলব ভালোবাসি? মিথ্যা কেন, সত্যিই তো! আমি কি ওকে ভালোবাসি না? অবশ্যই বাসি!

আচ্ছা, ভালোবাসি বললে কি হবে? আমাদের বন্ধুত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে না তো? কত কাহিনীই তো দেখলাম এমন, ছেলে মেয়ে পরস্পরের অনেক ভালো বন্ধু, কিন্তু কোন এক মনিষী বলেছিলেন, দুটো ছেলেমেয়ে শুধুমাত্র পরস্পরের বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না, তাদের কারো মধ্যে এক পর্যায়ে প্রেম আসবেই, এটা প্রতিদিন সকালে উদিত সূর্যের মতই অবশ্যম্ভাবী, ধ্রুব, সুতরাং ছেলেটা হয়তো একদিন সাহস করে বলেই ফেলল – “তোকে আমি বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু ভাবি!” আর তারপরই পৃথিবীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে হাজার হাজার মেয়ের বলা চিরন্তন উত্তর – “ছি তুই এত খারাপ! আমি অন্তত তোকে এমন ভাবি নি!” এমন হবে না তো? হয়তো আমার প্রতি ওর এই সামান্য টান শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে। হয়তো এটা শুধুই শুধুই শুধুই শুধুই এবং শুধুই বন্ধুত্ব। হয়তো এর মধ্যে আর কিছু নেই।

না, আছে। না, নেই। আছে। নেই। আছে।

নেই।

আশা ও নৈরাশ্যের মাঝখানে পেন্ডুলামের কাঁটার মত দোদুল্যমান আমি। কি করব? বলে দেব? না বলে যে থাকতে পারি না! আমার যে আর সহ্য হয় না!

কিন্তু বলে দিলে যদি বন্ধুত্ব ধ্বংস হয়ে যায়? যদি যায়? তখন যদি আর দেখা না হয়? মেয়েটা যদি আমাকে এড়িয়ে চলার জন্য প্রাইভেট বাদ দেয়? যদি আমার সাথে আর কথা না বলে? যদি আমার জন্য তার সব টান পরিবর্তিত হয়ে ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়? কি হবে? আমি কি তা সহ্য করতে পারব? পারব? পারব?

না। না। না।



নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এইচএসসি দিয়ে ফেললাম। এ প্লাস পেলাম। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেলাম। সে আমার পরের মেডিকেলে চান্স পেল।

এইসময় একটা ঘটনা ঘটল।

একবার ছুটিতে বাসায় যাবার পর ঢাকায় আসার সময় মেয়েটা ট্রেনে আমার আর তার টিকিট একসাথে কাটতে বলল। এতে যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল তা আমার বোকা মস্তিষ্ক বুঝতে পারল না। আমি তাকে তার মেয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে যেতে বললাম। সে আমার কথায় মন খারাপ করল। আমি পাত্তা দিলাম না।

কেন দিলাম না নিজেও জানি না।

আচ্ছা, আসলেই কি এটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল? মেয়েরা কি এমনই? সরাসরি কিছু বলা কি তাদের ধাঁতে সয় না? তারা যা করে সবই কি এভাবে আকারে ইঙ্গিতে করে? যা বলতে চায় সবই কি সাংকেতিক ভাষায় বলে? জানি না। কিচ্ছু জানি না আমি।

আমরা ঢাকা গেলাম একই ট্রেনে, আলাদা বগিতে। কমলাপুর পৌঁছাবার পর মেয়েটা এবার আমাকে বলল সিএনজিতে করে তাকে তার মেডিকেলে নামিয়ে দিয়ে আসতে।

শুধু সে আর আমি। আমি আর সে।

আমার বুকের মধ্যে কেমন ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। জীবনে কোন মেয়ের সাথে এক রিকশায় বসি নি। মেয়েটা স্কার্ফ পরত।

ফ্রেন্ডদের কাছে শুনতাম সে নিয়মিত নামাজ পড়ে। সুতরাং আমার কাছে মনে হল এটা একটা ফাঁদ। যদি আমি মেয়ের সাথে এক সিএনজিতে যেতে রাজি হই তাহলে মেয়ে আমাকে দুশ্চরিত্র ভাববে। চরম পর্যায়ের লোফার ভাববে। অবশ্যই ভাববে।

সম্ভবত ভাববে। অবশ্যই ভাববে। না, ভাববে না। না, অবশ্যই ভাববে। না, ভাববে না।



আমি সবসময় খারাপটা চিন্তা করে বড় হওয়া মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই আমি এই প্রস্তাবে রাজি হলাম না। মেয়ে রাগে অপমানে চোখ লাল করে তার ফ্রেন্ডদের সাথে চলে গেল। আমি হাসলাম। এটা নিশ্চয়ই অভিনয়।

নিশ্চয়ই অভিনয়। নিশ্চয়ই মেয়েটা মনে মনে আমার সচ্চরিত্রের জন্য খুশি হয়েছে। নিশ্চয়ই হয়েছে। না, হয় নি। না, হয়েছে।

না, হয় নি।

এক মাস পরে শুনলাম মেয়েকে তার মেডিকেলের এক ছেলের সাথে হেসে হেসে আইসক্রিম খেতে দেখা গেছে। তার কিছুদিন পর শুনলাম তাদের এক রিকশায় ঘুরতে দেখা গেছে। ছেলে তেমন আহামরি কিছু না। চেহারা সুরত ফ্যামিলিতে কিছুতেই আমার ধারেকাছে আসতে পারবে না।



বুঝলাম, এটা ছিল জেদ। মেয়েটা জেদের বশে আমাকে দেখানোর জন্য এমন একটা কাজ করেছে। বা, করে ফেলেছে। ঐ ছেলে স্রেফ তার জেদের বলি। গিনিপিগ অফ হার এক্সপেরিমেন্ট।

এখন আমিই পারি সবকিছু আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। হ্যাঁ, পারি। না, পারি না।

আসবে? সবকিছু আগের জায়গায় ফিরে আসবে? আমি যদি এখন ওর সামনে গিয়ে বলি “ভালোবাসি”, কি হবে তবে? ও কি ঐ ছেলেটাকে ছেড়ে দিবে? এত সহজ ছেড়ে দেয়া? কি হয়েছে ওদের মধ্যে? প্রপোজ করেছে কে? ওরা কতদূর এগিয়েছে? হাত ধরাধরি? চুমু? কতদূর?

আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে আরেকজনের রিলেশন ভাঙ্গার? আমি ভালোবাসি, কিন্তু সেটা তো ওদের রিলেশন হবার আগের কথা। এখন কি বাসি? আদৌ বাসি? বাসি।

অনেক বাসি। অনেক বেশি বাসি। অবশ্যই আমার ঠ্যাকা পড়েছে। আমার পড়বে না তো কার পড়বে?

অন্য কেউ হলে কি করত জানি না, তবে আমি বরাবরই খামখেয়ালী মানুষ। সুতরাং বেশ কিছুটা সময় চিন্তাভাবনা করে আমি পুরো ব্যাপারটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম।

আগামী এক বছরে যদি আমি একবারও মেয়েটার নাম শুনি, তাকে জড়িয়ে একটা কথা শুনি, তার ছবি কোথাও দেখি, তার কণ্ঠ কোনভাবে শুনি, তার একটা মেসেজও যদি আমার ফোনে আসে, আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। আর এক বছরের মধ্যে একটাও না হলে, আই অ্যাম আনলাকি। তাকে ভুলে যাব। সব মেমোরি সব দুঃখ ডিলিট করে ফেলব। হুম।

এটাই। ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম আমি পুরো ব্যাপার। ভাগ্যে থাকলে হবে। নাহলে হবে না। হবে না।

হবে। হবে না। হবে।

পরদিন থেকেই আমার বছর গোণা শুরু হল। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে আর ওর নামে কিছু বলে না, ওকে নিয়ে আর কোন কাহিনী ভেসে ভেসে আমার কানে আসে না, ফেসবুকেও ভুল করে ওর কোন স্ট্যাটাস আমার চোখে ভাসে না, কোন কমেন্ট আমার চোখে ধরা পড়ে না, আমার ইনবক্সে ভুল করে তার মেসেজ চলে আসে না, হয়তো সে আমাকে ব্লক করেছে কিন্তু সেটা তো আমি নিজে নিজে চেক করে দেখতে পারি না তাই না? আমার মোবাইলে কল বা মেসেজ আসার সম্ভাবনা তো বাদই দিলাম।



ভেবেছিলাম দুয়েকদিনের মধ্যেই ওর নাম কোনভাবে চোখে ভাসবে বা কানে আসবে, এল না। সপ্তাহ কেটে গেল, পক্ষ কেটে গেল, মাস কেটে গেল, এল না। এক দুই তিন করতে করতে এভাবে এগার মাস ঊনত্রিশ দিন চলে গেল। আজকে এগার মাস ত্রিশতম দিন। আর মিনিট দশেক পরে বছর শেষ হচ্ছে।

ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন তো দূরের কথা, নিউট্রালও হয় নি। ওর নাম একবারও দেখি নি, ওর কথা একবারও শুনি না, আমাদের মধ্যে কোনভাবেই যোগাযোগ হয় নি। আর মিনিট দশেক পরেই শেষ হচ্ছে আমার অপেক্ষা। আগামী দশ মিনিট যদি গত এগার মাস ঊনত্রিশ দিন তেইশ ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটের মত হয় তাহলে আমি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে সঞ্চিত সমস্ত স্মৃতি হতে ওকে টুক করে সরিয়ে ফেলব। আমি আর কারো কথা ভেবে কষ্ট পাব না।

অবসরে কেউ হুট করে এসে আমার স্মৃতিগুলো এলোমেলো করে দিবে না। অন্য মেয়ের দিকে তাকালে আমি নিজেকে প্রতারক ভাবব না। কালকে থেকে আমি মুগ্ধ, স্বাধীন। একদম। একদম স্বাধীন।

হ্যাঁ মিশু, মিনিট দশেক পর থেকে তুমি সত্যিই স্বাধীন। কি হবে বাঁধনে জড়িয়ে? কি হবে?

হলের মামার দোকানে পিঠা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দুঃখগুলো ঝড় হয়ে আমার হৃদয়টা তছনছ করে দিতে লাগল। হঠাৎ করেই অনেক দুঃখ হতে লাগল আমার। ভাগ্যটা এত খারাপ কেন আমার? একবারও কেন ওর নাম কানে এল না আমার? একবারও কেন ওকে নিয়ে কিছু শুনলাম না আমি? ভুল করে হলেও আমার ইনবক্সে ওর মেসেজ এল না কেন? কেন? কেন? কেন? পৃথিবী, জবাব দাও।

কেন? কেন? কেন?

পিঠা খাবার পর মামা আমার দিকে হাত মোছার জন্য একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। আমি কাগজটায় ভালোমত হাত মুছে কাগজটা দলা মোচড়া পাকিয়ে তিন চার পাঁচটা ফুটো করে ভর্তা বানিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিলাম। ড্রেনে ফেলার পর মামাকে টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম, কাগজগুলো একটা কোচিং এর প্রসপেক্টাস থেকে কাটা। মেডিকেল কোচিং। যেটায় আমি আর ও কোচিং একসাথে করেছিলাম।



আমি উপর থেকে কয়েকটা কাগজ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। সিরিয়াল ধরে সলিমুল্লাহ মেডিকেলের চান্সপ্রাপ্তদের নাম, তার নিচেরগুলোতে এর পরের মেডিকেলে চান্সপ্রাপ্তদের নাম, তারপরে তার পরের মেডিকেলে চান্সপ্রাপ্তদের নাম ইত্যাদি। মানে কাগজ কেটে পেজ নাম্বার অনুসারেই সাজানো ছিল ওখানে।

সবচেয়ে উপরের কাগজটা নির্দেশ করছে জাতীয় মেধায় “n” তম, “n+2” তম, “n+3” তম, “n+9” তম ইত্যাদির নাম ও ছবি। তার মানে আমি যে কাগজটায় হাত দিয়েছি মেধা তালিকায় এর জাস্ট আগের ছেলেমেয়েদের নাম ও ছবি ছিল।

আমি স্মৃতি হাতড়ে টের পেলাম, ও ছিল মেধা তালিকায় “n-2” তম। সুতরাং আমি যে কাগজে হাত মুছেছি তাতে তার নাম ও ছবি থাকার সম্ভাবনা প্রবল।

আর আট মিনিট আছে। আমি ড্রেনের প্রবহমান পানির সাথে দৌড়াতে লাগলাম। ড্রেনের উপর একটু পরপরই ইট সিমেন্ট দিয়ে বানানো আস্তরণ থাকার ফলে আমার পক্ষে কাগজটাকে এত সহজে ধরা সম্ভব হল না।

দুই তিনবার দেখলাম, কিন্তু হাত বাড়ানোর আগেই কাগজটা আবার ভ্যানিশ হয়ে গেল।

আমি দৌড়ে বেশ খানিকটা সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে রইলাম। কিচ্ছু এল না। মানে মাঝখানে আটকে গেছে। আমি কাগজটাকে শেষ যে আস্তরণের নিচে দেখেছি তার নিচে হাত ঢুকিয়ে দিলাম।

হাতে গা ঘিনঘিনে ময়লা উঠে এল। আমি কেয়ার করলাম না। আমি ময়লা ঘাটতে লাগলাম। আমার হাঁটু ছড়ে গেল, কাপড় ময়লা হয়ে গেল। আমি দলা মোচড়া পাকানো একটা ভেজা কাগজ উদ্ধার করে খুললাম।



কাগজের চার পাঁচ জায়গায় ফুটো। আমার করা। একটা নাম শুধু বোঝা যায়। দুটো চেহারা শুধু বোঝা যায়। কাগজের বাকি অংশ হয় নেই নাহলে বোঝা যায় না।

নেই। ও নেই। সম্ভবত আমি নিজের হাতে ওর ছবি ফুটো করেছি। অথবা ছিঁড়ে ফেলেছি।

আমি কাগজ ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।

খুব রাগ হচ্ছিল প্রথমে। তারপর ক্ষোভ। তারপর ঘৃণা। নিজের উপর। ভাগ্যের উপর।

পৃথিবীর উপর। স্রষ্টার উপর। সবার উপর।

আমি পিঠামামার দোকানের দিকে তাকালাম। হারামজাদা সালেহ মনের সুখে পিঠা খাচ্ছে।

শালার পো শালা লুইচ্চা সালেহ ভুজুং ভাজুং দিয়ে কিভাবে কিভাবে যেন এক ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েকে পটিয়ে ফেলেছে। এখনও নাম বলে নি। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, তাও বলে নি। ব্যাচের খুব বেশি মানুষ জানে না। তাদের মুখ থেকেও কিছু শুনি নি।

সালেহ আর তার গার্লফ্রেন্ডকে নাকি আজকাল প্রায়ই রিডিং রুমে যাবার সিঁড়ির অন্ধকার চিপায় বসে হা হা হি হি করে হাসতে দেখা যায়। যদিও আমি কখনও ধরতে পারি নি।

রাগে ক্ষোভে আমার চোখ দিয়ে আগুন বের হতে লাগল। আমি কি দোষ করেছি? ও পাবে আর আমি পাব না কেন? আমি সারাজীবন লুইচ্চামি করি নি এটাই আমার দোষ? সব মেয়েকে বোন ভেবেছি এটাই আমার দোষ? আচ্ছা আমি পাব না ঠিক আছে, কিন্তু ও পাবে কেন? কেন? কেন?

নিজের অজান্তেই আমার শরীরে হরমোনের নাচানাচি শুরু হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই আমি শরীরে আসুরিক শক্তি অনুভব করতে লাগলাম।

বজ্রমুষ্টি পাকিয়ে আমি সালেহর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম।

প্লিজ সালেহ প্লিজ। আর মনে হয় মিনিট তিনেক আছে। প্লিজ বল ভাই। একবার ভুল করে হলেও মেয়েটার নাম বল।

বল শালা কুত্তার বাচ্চা। বল শালা হারামি। প্লিজ পিঠামামা, আপনি একবার মেয়েটার নাম বলেন। যারা মজা করে পিঠা খাচ্ছেন, প্লিজ বলেন। কেউ একজন বলেন।

বা দেখান। প্লিজ। প্লিজ।

কেউ একজন এদিকে এগিয়ে আসছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।

আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। আমি কিছু দেখতে পারছি না। দেখে বুঝতে পারছি না। কে আসছে? সালেহ না ওটা? আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন সে?

আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম, প্লিজ সালেহ। জীবনে অন্তত একটা ভালো কাজ কর।

প্লিজ একবার হলেও মেয়েটার নাম বল। প্লিজ। বল কুত্তার বাচ্চা জাউরার পোলা। বল।

সালেহ আমার কাছে চলে এল।

দৌড়ে। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড আছে।

আমি বললাম, প্লিজ সালেহ। প্লিজ। একবার বল প্লিজ।



সালেহ হতভম্ব হয়ে বলল, কি বলব? আর তুই কাঁদছিস কেন?

আমি বললাম, নাম বল। একবার বল। দশ সেকেন্ড আছে। প্লিজ। একবার বল ভাই।



সালেহ কি বুঝল কে জানে, কিন্তু সে গভীর একটা শ্বাস নিল। অতঃপর বলল, বলছি। তোর ব্যাপারটা আমি জানি। বলছি। আয়েশা আক্তার সুমি।



***

সালেহ বসে বসে পিঠা খাচ্ছে। মিশু দৌড়ে কই যেন যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাগু চেপেছে।

সালেহ পিঠা খেয়ে মামার দিকে টাকা বাড়িয়ে দিতে আবিষ্কার করল, মামার টেবিলের পাশে একটা কাটা কাগজ পড়ে আছে। ঠিক যেগুলো মামা হাত মোছার জন্য রাখেন।



সালেহ কি মনে করে কাগজটা তুলে নিল। মেডিকেল কোচিং এর প্রসপেক্টাস এ কয়েকটা ছেলেমেয়ের ছবি। কাউকে সে চেনে না। কাগজটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ এতে হাত মোছে নি। বাতাসে কাগজটা উড়ে নিচে পড়েছে।



সালেহ মানিব্যাগ পকেটে ঢুকাতে গিয়ে ঐ কাগজে উপস্থিত মেধা তালিকায় “n-2” তম হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটার উপর ক্রাশ খেল। মেডিকেলে চান্স পাবার পর এটা তার একশ পঁচাত্তরতম ক্রাশ। কোন কলেজে চান্স পেয়েছে? সলিমুল্লাহ! আনন্দে নেচে উঠল সালেহ। কাছেই তো! গার্লফ্রেন্ডকে ভুজুং ভাজুং অজুহাত দিয়ে কালকেই সলিমুল্লাহে একটা ঢুঁ মেরে আসতে হবে, ভাবল সালেহ। কোন এলাকার মেয়ে দেখি তো? আরে! মেয়েটা তো দেখি মিশুর কলেজের! ওকে জিজ্ঞেস করে দেখা যায়, ভাবল সালেহ।

তখন বছর শেষ হতে বাকি আছে আর মাত্র এক মিনিট।

কিন্তু মিশু কই? সালেহ চোখ তুলে দেখল, মিশু হাত মুঠো করে এদিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখে কি? পানি না? মিশু কাঁদছে?

সালেহ দৌড়ে গেল। মিশু বলল, প্লিজ সালেহ। প্লিজ।

একবার বল প্লিজ।

সালেহ হতভম্ব হয়ে বলল, কি বলব? আর তুই কাঁদছিস কেন?

আমি বললাম, নাম বল। একবার বল। দশ সেকেন্ড আছে। প্লিজ।

একবার বল ভাই।

সালেহ গভীর একটা শ্বাস নিল। কিসের দশ সেকেন্ড আছে সে জানে না, সে শুধু জানে মিশু কাঁদছে। হয়তো নামটা বললেই মিশুর মানসিক যন্ত্রণার উপশম হবে।

অনেকদিন ধরেই মিশু তার নতুন গার্লফ্রেন্ডের নাম জানতে চেয়েছে।

সালেহ বলে নি। তার ক্লোজ তিন চারজন ছাড়া আর কেউ মেয়েটার নাম জানে না। মিশুকেও এত সহজে বলার ইচ্ছা ছিল না তার। কিন্তু আজ মিশু ইমোশনাল। কোন কারণে নার্ভাস ব্রেকডাউনের স্বীকার হয়েছে সে।

সালেহ জানে, মিশু মনে মনে এক মেয়েকে পছন্দ করত। কোন কারণে সেই মেয়ে মিশুকে পল্টি মেরে নিজের মেডিকেলে একটা বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে। এইসমস্ত কারণে মিশু সবসময় নিজেকে ইনফেরিওর ভাবে। অযোগ্য ভাবে। এমনকি সালেহকে হিংসা করে সে।

সালেহ জানে এগুলো।

সুতরাং, এখন আর রাখঢাক করলে মিশুর কষ্টটা বাড়বেই। কি দরকার? নিজের গার্লফ্রেন্ডের নাম ফ্ল্যাশ হয়ে গেলে সালেহর এমন কিছু হবে না। একদিন না একদিন তো ফ্ল্যাশ করতেই হত। এটাই যে তার ট্রু লাভ।

আগেরগুলা সব ফলস। একটু ক্লোজগুলা সিউডো-ট্রু।

সুতরাং সালেহ বলল, বলছি। তোর ব্যাপারটা আমি জানি। বলছি।

আয়েশা আক্তার সুমি।

***

মিশু আর সালেহ মেইন বিল্ডিং এর দিকে ফিরে যাচ্ছে। মিশু আরও কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। বিশেষ করে গার্লফ্রেন্ডের নাম বলার পরে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অঝোর ধারায় শিশুর মত কেঁদেছে মিশু। কেন করেছে সালেহ পুরোপুরি ধরতে পারে নি।

মেয়েঘটিত ব্যাপারস্যাপার শিওর। কিন্তু আসল ব্যাপারটা মিশু এখনও বলে নি। আদৌ কোনদিন বলবে কি না সালেহ জানে না।

মিশুর মন ভালো করার জন্য সালেহ পকেট থেকে সেই কাগজটা বের করে এনে বলল, দোস্ত দ্যাখ, আমার নিউ ক্রাশ। তোর কলেজের! চিনিস নিশ্চয়ই!

মিশু হতভম্ব হয়ে হাত বাড়িয়ে কাগজটি নিল।

সালেহ আঙ্গুল দিয়ে মেধা তালিকায় "n-2" তম মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, আমি ঐ টেবিলের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছি। দ্যাখ দ্যাখ, মেয়েটা সেইরকম সুন্দর না? সিরাম হটও! সেই জমবে! তোকে তখনই বলতাম, কিন্তু তোকে কাঁদতে দেখে...

মিশু এর পরের তিন মাস সালেহর সাথে কথা বলে নি। কেন বলে নি সে নিজেও জানে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।