আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহামানব-গান্ধিজী, উমর (রাঃ) এবং শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া



আমি যদি কখনও রাজনীতিবিদ হতাম, তাহলে সবার আগে আমি আমার নিজের একটা দল বানাতাম। দল-লীগের রাজনীতি বড় দূষিত। ওদের পরিষ্কার করা মানব সাধ্যের বাইরে। এরচেয়ে নিজের দলকে নিজের মতই গড়ে তোলা ভাল।
আমার দলের আদর্শ থাকতো ভারতের জাতির পিতা "মহাত্মা" মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী।

ধুতি পায়ের খালি গায়ের ছোটখাটো মানুষটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, মহামানব হতে গেলে ওহী নাযিল হওয়ার অপেক্ষা করতে হয়না। একটু সাধনা থাকলেই অসাধারন হওয়া যায়। তাঁকে ভালবেসেই পুরো জাতি তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে 'বাপু' বলেই ডাকে।
গান্ধীজী আসলে একজন সাধারন মানুষই ছিলেন। তিনি তাই করে গেছেন যা একজন মানুষের করা উচিৎ।

আমরা মানুষেরাই এত অমানুষ হয়ে গেছি যে উনার মানবীয় গুনাবলিকেই অতিমানবীয় বানিয়ে ফেলেছি।
ভদ্রলোক ছিলেন একজন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। ইচ্ছে করলেই তিনি টাকা পয়সার পাহাড় গড়তে পারতেন। কাঁটাতে পারতেন একটি আরামদায়ক সুখী জীবন। তিনি তা না করে গায়ের কাপড় চোপর খুলে ফেললেন, কুড়ে ঘরে থাকতে শুরু করলেন।

নিজেই নিজের কাপড় বুনতে শুরু করলেন। এবং অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কলিজা নাড়িয়ে দিলেন। এ ঘটনাগুলো সবাই জানেন। তবু তাঁর জীবনের দুটি ঘটনা উল্লেখ করবো। ইতিহাস ঘুরে ফিরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

ইতিহাস আবার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই একই ঘটনার সামনে। শুধু এইবার আমাদের সামনে নেতা হিসেবে লাঠি হাতে খালি গায়ের সেই মহাত্মা লোকটি নেই।
গান্ধীজি খুব সুন্দরভাবে ভারতীয় নাগরিকদের বুঝিয়েছিলেন যে ইংরেজরা ভারতে ব্যবসায়িক স্বার্থেই এসেছেন। ইংরেজদের যদি সবরকম সহায়তা করা বন্ধ করে দেয়া যায়, তাহলে ওরা ভারত ছেড়ে চলে যাবে। যে কোন কর্পোরেশনই "লস প্রজেক্ট" বেশিদিন ধরে রাখেনা।


ভারতীয়রা দারুনভাবে তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল। পুরো ভারত জুড়ে ইউরোপীয় পণ্য বর্জন করা হলো। ছোটছোট বাচ্চারা স্কুল কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিল। অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলো। গান্ধীজি ওয়াদা করেছিলেন, এক বছরের মধ্যেই ভারত স্বাধীন হবে।

পুরো ভারত জুড়েই তখন স্বাধীনতার প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু গন্ডগোল না বাঁধিয়ে উপমহাদেশে আজ পর্যন্ত কোন আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে? এখানেও গোল বাঁধলো। অসহযোগকারীরা একটি থানা ঘেরাও করলো, এবং থানার ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে দিল। বেশ কিছু পুলিশ অফিসার সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন। ভারতীয়দের মনে এই দুর্ঘটনা কোন ছাপই ফেলল না।

তাদের কথা, যারা মারা গিয়েছে, তারা ইংরেজদের বেতনভোগী গোলাম। ওদের মৃত্যুতে পেরেশান হবার কি আছে?
অহিংসবাদী নেতা গান্ধীজি ভীষন মর্মাহত হলেন। তিনি মানুষের জীবনের মূল্য বোঝেন। তিনি তাঁর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন। ঘোষণা দিলেন, "ভারত বর্ষ এখনও স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত না।

"
কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? এখনও বাংলাদেশে নির্বিকারে বাস পোড়ানো হয়। বাসের যাত্রীদের বের হতেও দেয়া হয়না। জীবিত মানুষ পুড়িয়ে পৈশাচিক আনন্দে মত্ত থাকে একদল হিংস্র জানোয়ার! তখন ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রায় একশো বছর হতে চলল। আমাদের স্বভাব পাল্টায়নি।

বিএনপি আওয়ামীলীগ, কোন দলকেই আমি কখনই অহিংস আন্দোলন করতে দেখিনি। দুই দলই বাস পুড়িয়েছে। ভাংচুর করেছে সাধারন মানুষেরই সম্পদ। দুই দলই মানুষ মেরেছে। কেউই পাপমুক্ত নয়।


আমরা দলান্ধরা নির্বিকারভাবে বলি, আমাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেনি বলে মরেছে, এতে এত আপসেট হওয়ার কি আছে?
আরে, যারা মারা যাচ্ছে, তারা সবাই খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ। একদিন কাজে না গেলে যাদের সংসারে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। তোমাদের আন্দোলনে তাদের কিছুই যেত আসতো না। তাদের অনেকেই নির্বাচনে তোমাদের দলকেই ভোট দিত। তোমরা তাদের ভোটের পুরষ্কার হিসেবে মৃত্যুদন্ড দিলে!
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার একদম ঊষালগ্নে ভারত জুড়ে দাঙ্গা লেগে গেল।

হিন্দু মুসলিম একে অপরকে কেটে একদম সাফ করে দিবে। জিন্না সাহেব দাবী করছেন মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্রের। গান্ধীজী ভীষণ মর্মাহত হলেন। তিনি জিন্না সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন, "হিন্দু-মুসলিম ভারতমাতার দুইটি নয়ন বিশেষ। একজনকে বাদ দিলেই সে অন্ধ হয়ে যাবে!"
জিন্না সাহেবের মাথায় ঢুকে আছে, হিন্দুরা কখনই মুসলমানদের আপন করে নিতে পারবে না।

তাঁর যুক্তিও খোড়া নয়। তখনকার হিন্দু সমাজ আসলেই মূর্খ ছিল। হিন্দু দোকানে মুসলমানকে ঢুকতে দেয়া হত না। মুসলমানের ছায়াও তাদের গায়ে লাগলে তারা স্নান করে পবিত্র হত। হিন্দু বাড়িতে মুসলমানের প্রবেশ? সে যে অকল্পনীয় ব্যপার! একটা কুকুরের সম্মানও যেখানে একজন মুসলমানের চেয়ে বেশি ছিল, সেই অবস্থায় হিন্দুদের হাতে রাজ ক্ষমতা গেলে কী ঘটতো সেটা সহজেই অনুমেয়।


গান্ধীজি হিন্দু - মুসলিম দাঙ্গা থামাতে আমরণ অনশনে গেলেন। ততদিনে তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। শরীর আগের তুলনায় অনেক দূর্বল। এখন আর ধকল সইতে পারেনা। কাজেই তিনি দ্রুত মৃত্যু শয্যায় চলে গেলেন।

তবু তাঁর ব্যক্তিত্ব ইস্পাত দৃঢ়। দাঙ্গা না থামলে তিনি কিছুতেই অনশন ভাঙবেন না। নেহেরু, সোহরাওয়ার্দি সহ সব নেতা ছুটে এলেন, কিন্তু জেদী বুড়ো কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না।
একজন সাধারন লোক এই সময় গান্ধীজির কাছে এলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "আমি দোযখে যাচ্ছি!"
গান্ধীজি বললেন, "বেহেশত দোযখ নির্ধারন করবেন ঈশ্বর।

"
"আমি ভিন্ন ধর্মের একটি শিশুকে হত্যা করেছি। ওর মাথা গুড়িয়ে দিয়েছি। কারণ ওরাও আমার বাচ্চাকে হত্যা করেছিল। আমার পাপ মাফ হবার নয়। আমি দোযখে যাচ্ছি!"
গান্ধীজি ধীরে ধীরে উঠে বসলেন।

তিনি বললেন, "তুমি ভিন্ন ধর্মের আরেকটি ছেলেকে খুঁজে বের কর। এমন ছেলে যার মা বাবা এই দাঙ্গায় মারা গেছেন। তারপর সেই ছেলেটিকে তুমি নিজের ছেলের মতই পেলে বড় কর। কে জানে, ঈশ্বর হয়তো তোমার পাপ ক্ষমা করেও দিতে পারেন!"
ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? দেশ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে বাস্তুহারা সংখ্যালঘুতে। কেউ কেউ হারিয়ে ফেলেছেন তাঁদের স্বজনদের।

তাদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে আমাদেরই জাতিভাই, কিছু বাঙ্গালী। জাতি হিসেবে আমরা দায় এড়াতে পারিনা। ওদের পাশে এসে না দাঁড়ালে পরম করুণাময়ও তাঁর করুণার দ্বার আমাদের জন্য বন্ধ করে দিবেন। বঞ্চিতের অভিশাপ আল্লাহর আরশ নাড়িয়ে দেয়। তাঁর গজব থেকে বাঁচতে হলেও আমাদের শুধরাতে হবে।


গান্ধীজির জন্ম খুবই সাধারন পরিবারে হয়েছিল। তিনি ছোটবেলা থেকেই মহামানবদের জীবনী পড়ে বড় হয়েছেন। তিনি নিজেও মহামানব হতে চাইতেন। সেইসব মহামানবদের একজন ছিলেন হযরত উমর(রাঃ)।
হযরত উমরের (রাঃ) একটি ঘটনা দিয়েই লেখা শেষ করি।


হযরত উমর(রাঃ) ইসলামের তৃতীয় খলিফা। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জীবিত থাকা কালীন বেশ কিছু ভাগ্যবান মানুষকে জান্নাতের আগাম সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছিলেন। হজরত উমর (রাঃ) ছিলেন সেই সৌভাগ্যবানদের একজন।
তিনি যখন খলিফা হলেন, তাঁর হাতে তখন পুরো মুসলিম সাম্রাজ্যের ক্ষমতা! তিনি তারপরেও অতি সাধারণ জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন। তালি দেয়া পোশাক পড়তেন।

খুবই সাধারণ ঘরে থাকতেন। মধ্যরাতে ছদ্মবেশে বেরিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রজাদের খোঁজ নিতেন। পরবর্তীতে একাজ অনেকেই করেছেন। যারাই করেছেন, তাঁরাই ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন। আমি আশাও করিনা কোন এক মধ্যরাতে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া ম্যাডামদ্বয় বোরখা পড়ে জনৈক জনাব খালেকুজ্জামানের বাসার কড়া নেড়ে উনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলবেন, "আপনার বাড়িতে চা খেতে এসেছি।

আমাকে এক কাপ চা খাওয়াবেন? সাথে বিস্কিট না দিলেও চলবে। "
চা খেতে খেতেই সাধারন একটি পরিবার এবং তার আশেপাশের বাড়িঘর গুলোর খোঁজ খবর নিয়ে নেয়া হবে। সব সমস্যা এবং অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হবে (প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করার চেয়ে নিজে দুঃখ প্রকাশ করা অনেক বেশি কার্যকর) এবং তা সমধানের আশ্বাস দেয়া হবে।
সমস্যা সমাধানে দেরী হলে অথবা যদি সমাধান নাও হয়, ছোট পরিবারটির জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে "একটি রূপকথার রাত" উপহার দেয়াটাও কম ব্যাপার হত না! বাংলার মানুষ তখন বলতে পারতো, আমরা এমন নেতা পেয়েছি, যারা আমাদের দুঃখ ঘুচাতে পারুক কি না পারুক, অন্তত সেটা বোঝার চেষ্টা করেন! আহারে! এমনটা যদি হত! কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের ভিআইপিগণ রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে পুরো রাস্তা ঘন্টার পর ঘন্টা বন্ধ করে নিজে দ্রুতবেগে চলে যাবেন এবং "ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আপনাদের পদক্ষেপ?" জাতীয় প্রশ্ন শুনে বলবেন, "ঢাকা শহরে ট্র্যাফিক সমস্যা আছে নাকি? কোথায়?"
যাই হোক, বলছিলাম হযরত উমরের (রাঃ) কথা। তাঁর আমলেই প্রথম মুসলিম সমাজের অবস্থা এমন হয়েছিল যে যাকাত নেয়ার মত গরীব মুসলমান খুঁজে পাওয়া যেত না।

একটা সমাজের সবাই ধনী! দারুন না? এত সফল রাষ্ট্রনায়ক হবার পরেও তিনি সবসময়েই আল্লাহর ভয়ে রীতিমত তটস্থ থাকতেন। মোনাজাতে হাত তুললেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করতেন। মাফ চাইতে চাইতে মুখে ফেনা তুলে ফেলতেন।
কৌতুহলী এক সাহাবী তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি স্বয়ং রাসুলুল্লাহর (সঃ) কাছ থেকে বেহেশতে যাবার সুসংবাদ পেয়েছেন। তারপরেও আপনার এত কান্না কিসের ভয়ে?"
তিনি জবাবে বললেন, "আমি ইসলামী সমাজের খলিফা।

আমার শাসনামলে আমার এলাকায় যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজ কেয়ামতে হাশরের ময়দানে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন কেন আমি থাকতে সেই কুকুরটাকে এভাবে মরতে হলো? আমি সেদিন আল্লাহকে কী জবাব দেব?"
আমাদের সমাজে মানুষ মরে। প্রতিদিন। সপ্তাহান্তে সংখ্যাটি শ'য়ের ঘরে গিয়ে ঠেকে। আমাদের নেতৃবৃন্দ কী এব্যপারে কখনও কিছু ভাবেন?
সবসময়েই মহামানব হতে ইচ্ছে করে। অতি সাধারন মানুষ হিসেবে আমরা মহামানব হলেও মানব সম্প্রদায়ে খুব একটা ছাপ ফেলার সুযোগ আমাদের থাকেনা।

যাঁদের সে সুযোগ থাকে, আফসোস, তাঁদের মহামানব হতে ইচ্ছে করে না!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।