বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে এক উপেক্ষিত ঈশ্বরের নাম জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়!
একই সাথে গীতিকার এবং সুরকার---পঞ্চাশের দশক আর ষাটের দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসা এমন সব সঙ্গীতস্রষ্টাদের খুব সম্ভবত শেষ দীপশিখাটির নাম জটিলেশ্বর। ১৯৩৪ এর ১৩ ডিসেম্বরে তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরে। আশি পেরিয়ে আসা এই নিভৃতচারী সঙ্গীতসাধক নিজের মনেই থাকতে হয়ত পছন্দ করেন। একটু পুরনো দিনের গানের সাথে যাদের যোগাযোগ আছে, তার সকলেই এই লোকটির নাম শুনে থাকবেন--অনেকে হয়ত গুনগুন করে গেয়ে দিতে পারবেন তাঁর লেখা, সুর করা দু'একটা গানের কলিও। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেন এমন লোক আমি খুব বেশি পাইনি।
গানের সমঝদার অনেকেই বলেছেন--লোকটা কী ভীষন প্রতিভাবান ছিল! কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়---জটিল বাবু যতটা প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন--তার সিকিভাগেরও মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি।
জটিলেশ্বরের প্রথম যে গানটা আমার শোনা হয়--সেইটা অনেকেরই শোনা এবং প্রিয় গান---
গানটা শুনেই আমার প্রথম যে কথাটা মনে হয়েছিল সেটা হল, পুরনো দিনের গান শুনলে কথা ও সুরের মাঝে কেমন একটা 'পুরনো-পুরনো' গন্ধ থাকে----এঁর গানের মাঝে এই জিনিসটা নেই! কী ভীষন আধুনিক আর কী ভীষন সহজ তাঁর উচ্চারণ! ১৯৬৮ সালে বের হওয়া এই গানটি এখনো সুরে-কথায় কতটা সাম্প্রতিক, কতটা আবেদনময়--ভাবলে অবাক হতে হয়। এই এক গানই হয়ত যথেষ্ট ছিল তাঁকে তারকাখ্যাতি এনে দেবার জন্যে এবং খুব সম্ভবত বাংলা গানের জগতে অমরত্বটাও তিনি এই এক গানের জন্যেই দাবী করতে পারেন। কিন্তু জটিলেশ্বর আরো অসংখ্য গান রচনা করে গেছেন নিরলস ভাবে। আরো অনেক গান তৈরী করেছেন যা হয়ত ছাপিয়ে গেছে 'বঁধুয়া'-কেও!
জটিল বাবুর দ্বিতীয় গানটির সাথে পরিচয় হয়েছিল এক বৃষ্টির দিনে।
তখন কুমিল্লায় এক অখ্যাত গ্রামের এক কোনায় পড়ে আছি আমি। গ্রামের সরকারী এক কলেজে পড়াই। সেদিন সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়েছে। ছুটির দিন বলে বাসায় আটকা পড়ে আছি। আমরা চার শিক্ষক একটা হোস্টেলের মত জায়গায় থাকি।
ইংরেজির শিক্ষক হায়দর ভাই ভীষন সুরসিক এবং সুরেলা গায়ক। দুপুরে খাবার পরে কি মনে করে জানি আমার ঘরে আসলেন। রবীন্দ্রনাথের শাপমোচন নৃত্যনাট্যটি তার পুরোটাই মুখস্থ এবং কন্ঠস্থ! এমনি এক বৃষ্টির দিনে এক বসাতে আমাকে পুরোটা গেয়ে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই লোকটাকে গুরু বলে মানি!
হায়দর ভাই ঘরে ঢুকে কোন কিছু না বলে জানালার পাশে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। হাতে সিগারেট জ্বলছে।
চোখ তার বৃষ্টি পেরিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে---এমন সময় তিনি খুব হালকা করে গুনগুন করে উঠলেন একটা গান--ধীরে ধীরে সুরের আগুন জ্বলে উঠল চারপাশে--
হায়দর ভাইয়ের মন্দ্রিত কন্ঠে সেদিন বেজেছিল অনাদি কালের বিরহ বেদনা--
গান শেষ হবার পরও আমি অনেকখন কথা বলতে পারিনি। অনেকখন পরে কেবল বলতে পেরেছিলাম, ' হায়দর ভাই, আরেক বার গাইবেন? প্লীজ?'
হায়দর ভাইয়ের কাছ থেকে তখন জানা হল যে এই অসামান্য গানটারও সুরকার ও রচয়িতা জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। হায়দার ভাইয়ের কাছে জটিল বাবুর আরো কিছু গান ছিল ক্যাসেটে ( হায়রে ক্যাসেটের দিন!!)। সেইখান থেকে শোনা হল আরো কিছু অসামান্য গান--
এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার--
কী কখন বলে বাঁশি, রাধা না হলে কেউ বোঝে না
আঁধারে কী ধন আছে, চোখ না জ্বেলে কেউ বোঝে নাচেনা পথ কেন তবু পথ যে ভোলে, কেউ বোঝে না
ঠিকানা ঠিকই থাকে, মনই টলে, কেউ বোঝে নানিশীথে কখন সে কোন সূর্য জ্বলে কেউ বোঝে না
দু'চোখে রেখে দু'চোখ--সময় গেলেও কেউ বোঝে নাকী সুখে থেকে লোকে দুঃখ ভোলে কেউ বোঝে না
দু'চোখে সাগর আছে, জল না ঢেলে কেউ বোঝে না
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।