আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশ বিচ্ছেদের ৫০ বছর (১৯৬৪- ২০১৪)



জন্মভূমির সঙ্গে আমার বিচ্ছেদের ৫০ বছর পুর্তি হবে আর ৩/৪মাস পরে । এই খবরটা শুধু আমিই জানি । কারণ এটা শুধু আমার কাছেই খবর । এটা এমন নয় যে দশ বিশজন মানুষ জানে বা জানবে । এটা এমন নয় যে সাধারণ ভাবে এটা মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ ।

বিগত ১০০ বছর যাবৎ কোন কোন বাঙালির ভবিতব্য এমনই ।

তখন তার নাম ছিল পূর্বপাকিস্তান । রাতের আঁধারে সীমান্ত অতিক্রমের পর 'রিফিউজি ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান' হিসেবে আসামের (বর্তমান মেঘালয়) এক সীমান্তে আমাদের নাম নথিভুক্ত হয়েছিল । মানে আমাদের পরিবারের একটা অংশের । বাকি পরিবার তখনও পূর্বপাকিস্তানে ।

তারপর আরো কেউ কেউ এলেও একটা অংশ আসেনি বা আসতে পারেনি । তো সেই থেকে আমাদের পরিবার দুই দেশ জুড়ে রয়ে গেছে । আমার মত এমন আরো মানুষ এই ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে বসবাস করেন যাদের অবস্থা আমার মতই। এদেরকে 'বাঙাল' বলা হয় । বাঙালের 'গোঁ' ছাড়া আর কোন গুন এদের আছে বলে ভাবা হয়না ।

তবে এসবও এখন পুরণো জীর্ণ হয়ে গেছে । আমাদের এই প্রদেশের রিফিউজি কলোনী গুলো দেখলেই বোঝা যায় উদ্ববাস্তুদের প্রথম প্রজন্মের মানুষ আর তেমন বেঁচে নেই । তাদের সন্তান সন্ততিরা উত্তরাধিকার সুত্রে এখন আর নিজেদের 'বাঙাল' ভাবতে রাজি নয় । অন্যরাও ভাবেনা । 'গোঁ' ছাড়া বাঙালরা এখন অনেক মূল স্রোতের অনেক কৃতিত্বের অধিকারী ।



এর মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক । দেশছাড়ার সময় সদ্য কিশোর আমি এখন অন্য অনেকের মতই প্রৌঢ়ত্বের দ্বারে দন্ডায়মান । দীর্ঘ এই পঞ্চাশ বছর সেই দেশ, যা বর্তমান বাংলাদেশ, আমার সঙ্গে সঙ্গেই আছে । বেশি করে বললে বলা যায়,একটুকরো বাংলাদেশ আমার সঙ্গে এখনো নিরুদ্দেশে যায় । কিন্তু হায়! সে এখনও সেই কিশোরই রয়ে গেল ।

তার কি আর বয়স হবেনা? একসময় খবরাখবর খুব কমে গিয়েছিল । বিগত দুই দশক যাবৎ যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল উন্নতির কারণে এখন প্রায় প্রতিদিন সেই দেশের খবর পাই । একসময় ভরসা ছিল চিঠি । তা দিন পনেরর আগে হাতে পৌঁছোত না । তাও আবার যুদ্ধ টুদ্ধ লাগলে বন্ধ হয়ে থাকতো ।

অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে একসময় মনে হয়েছিল পরিবারের দুই অংশের মধ্যে বুঝি চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল । কিন্তু না, তা ঘটেনি । বরং এখন যাতায়াতও হয় । শেষ আমি জন্মভূমি দর্শনে গিয়েছিলাম ২০০৯এ। দেশছাড়ার সময় যে সদ্যজাতকে দেখে এসেছিলাম বা দেশছাড়ার পর যাদের জন্ম হয়েছিল তাদের তখন অনেক বড় দেখে এসেছি ।

কাকা জেঠার মতো ভারভারিক্কি চেহারা হয়েছে তাদের । তবু সেই প্রজন্ম সকাশে একটা কথা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তখন বলে এসেছিলাম যে 'তোরা ভাগ্যবান--যে তোদের আর দেশ ছাড়তে হয়নি---এখন এটা পূর্ব পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ । দেশান্তরী উদ্বাস্তুদের সীমাহীন কষ্টের জীবন তোদের দেখতে হয়নি । '

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আত্মবিশ্বাস অনেকটা কচুপাতায় আটকে থাকা জলবিন্দুর মতো । এই আছে এই নেই ।

সেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করে আসা উক্তিটি( এখন এটা পূর্ব পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ)কি আজ এই ২০১৪ সালে ফিরিয়ে নিতে হবে? না, যত পিছল কচু পাতা হোক না কেন আমি জলবিন্দু তাতে ধরে রাখবো । আমাকে স্বার্থপর বললেও আমি ধরে রাখবো । যদিও সারা বাংলাদেশ জুড়ে কোথাও কোথাও নির্বাচনোত্তর নির্যাতন চলছে নির্বাচনী উপসংহারের মত, ধর্মে হিন্দু বাংলাদেশের বাঙালিদের উপর আগের মতই । অসহায় আবেগের ফলে কি পূর্বপাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যেকার পার্থক্যকে জিইয়ে রাখবো, না মুছে ফেলবো---সাধারণ মানুষ সবসময় বুঝে উঠতে পারেনা কখন কী করা উচিত । আমার মতো দ্বিখন্ডিত পরিবারের মানুষদের তাই প্রতিবারই এই সংকট তৈরি হয় ।

চিন্তার সংকট । চিন্তার সংকটে কোন দৃশ্য ভাবা নিরাপদ জানিনা--তবু খালি দুঃশ্চিন্তাই ধেয়ে আসে খবরের লেজ ধরে ।

আমার খুব সৌভাগ্য এবং গর্ব যে, দেশ ছেড়ে আসার ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এই ৪৩ বছর আমার জন্মগ্রাম বা তার খুব কাছাকছি কোথাও সাম্প্রদায়িক সুস্থিতির অভাব হয়নি । এতে আমার যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, ভয় হয় সেটা কোনদিন ভেঙ্গে যাবেনাতো? সেটা যদি কোনদিন ভেঙ্গে যায় তাহলে প্রথমে ভেঙ্গে যাব আমি নিজেই । আমি খুব গর্ব করে আমাদের জায়গাটার কথা বলি যে এটা বাংলাদেশের মধ্যে একটা অন্যতম সাম্প্রদায়িক সুস্থিতির নিদর্শন হিসেবে থাকতে পারে।

কিন্তু আজ খুব দুঃখের সঙ্গে আমার গ্রামীণ জনপদের নামটা আমি এখানে লিখতে পারছিনা । কারণ কেউ যদি ভেবে বসে যে উদ্বাস্তু মালাউনের ঐ গর্বের বেলুনটা চুপসে দেওয়া কী আর এমন কঠিন কাজ--আজকাল এত ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা !


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।