আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেকড় ভুলে থাকি

দুদশক আগে স্কুলের পরীক্ষায় বহুবার লিখেছি আমাদের গ্রাম নিয়ে। তখন আনকোরা হাতে অনেক কথাই গুছিয়ে লেখা হত না, অথচ স্মৃতির ক্যানভাসে ঝাঁ চকচকে একটা গ্রামের ছবি আঁকা থাকত সবসময়। বছরে একবার অন্তত সে ছবিতে নতুন প্রলেপ দেবার সুযোগ হত গ্রাম থেকে বেড়িয়ে এসে। এখন কলমটাকে হয়ত কিছুটা শক্ত করে ধরতে পারি কিন্তু সেই ঝকঝকে ছবিটা বড় মলিন হয়ে গেছে, সেই জেল্লা আর নেই।
শহুরে জীবনের ব্যস্ততার অজুহাতে গ্রামে যাই না কতকাল।

একটা অপরাধবোধ তাড়া করে ফেরে সবসময়। কদিন ধরে গাঁয়ের স্মৃতির মধুকোষে ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছি অবিরাম।
মনে পড়ছে টনসিলের ব্যথা উপেক্ষা করে, মায়ের বকুনিকে তোয়াক্কা না করে বাড়ির পুকুরে ক্লান্তিহীন দাপাদাপি। মাত্র ক'টাদিনের জন্য যেতাম, তাই হয়ত বাবা প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু পুকুরটাকে তার প্রাপ্য সময়টুকু দেই নি তাই সাঁতার শেখা আর হল না আমার।


আমাদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে আধঘণ্টায় সমুদ্রে যাওয়া যায়। বাবার সাথে সদলবলে দু'বার সৈকতে গিয়েছিলাম। ঝিনুক-নুড়ি কুড়িয়ে, নোনাজলে পা ডুবিয়ে হাঁটা...তারপর কনে দেখা আলোয় সূর্যদেবকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফেরা! সাগরপারের মানুষ আমি, এরপর আরো কতবার গেলাম সৈকতে। কিন্তু ওই পায়ে হেঁটে আনন্দ ভ্রমণের আমেজটাই আলাদা, এর সাথে আর কিছুর তুলনা চলে না।
হিমসকালে উঠোনে বসে অবাক চোখে দেখতাম উনুনের ধোঁয়ায় ঢাকা বাড়ির রান্নাঘরটাকে।

তারপর দাওয়ায় বসে ঠাকুমার হাতের পিঠে খাওয়া। প্রকৃতির কাছে গেলে ঘোরের মধ্যে ডুবে যাবার অভ্যাসটা আমার পুরোনো। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হা করে নতুন কোনো দৃশ্য গিলছি হয়ত, সে সুযোগে কাক বাবাজি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল হাত থেকে পিঠে! অতঃপর আর কি! প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা, তারপর হাপুস নয়নে কান্না!
বাবার সরকারি চাকরির কারণে নিজেদের শহরে কখনো থাকা হয় নি। যাযাবরের মত ঘুরে বেড়িয়েছি অচেনা শহরে। ডিসেম্বরে স্কুল ছুটি হলে গ্রামে যাব-এই আশায় থাকতাম সারা বছর।

বাবা ছুটি নিতে কিপটেমি করতেন আর আমি গাল ফুলিয়ে থাকতাম। সারা বছর অপেক্ষার পর মাত্র এক সপ্তাহের জন্য গ্রামের হাওয়া আমার মোটেও পোষাতো না। ফেরার সময় প্রতিবার কেঁদেকেটে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধাতাম।
আর ফিরে পাব না সেই দিনগুলি। খুব ব্যস্ত এখন জীবন, গাঁয়ের ছবি দেখে ভাবসমাধিতে চলে যাবার চেয়ে ঢের দরকারি কাজ আছে আমার।

এখন গ্রামে যাবার উপলক্ষ হলে বরং কী করে সেটাকে ঠেকানো যায় সেই ফন্দি আঁটতে থাকি! ঠাকুমা আজ আর নেই, পিঠে খাওয়ার জন্য বাড়ির উঠোনে গিয়ে বসবার ফুরসতও আর নেই। গাঁয়ের মধুগন্ধী হাওয়া নাকে মুখে এসে হামলে পড়ে না যখন তখন। নিজের শেকড়টাকে ভুলে থাকি অনায়াসেই।
শুধু মনের দেয়ালে ঝুলতে থাকা নিঃসঙ্গ ফ্রেমের ছবিতে ধুলো জমে যায়, মাঝেমাঝে সেটাকে ঝেড়ে মুছে নেই। এটুকু সময় এখনো পাই।

কিন্ত জানি, সেটুকু অবসরও হয়ত হারিয়ে যাবে একদিন।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।