mail.aronno@gmail.com
যখনই আমি কোনো সাউথ কোরিয়ান সিনেমা দেখি, তখন একটি কথা বারবারই মনে হয়, কীভাবে তারা এত অল্প সময়ে এমন দক্ষ হয়ে উঠল চলচ্চিত্রের মতো একটি শিল্পকে এভাবে বিকশিত করে তুলতে! নির্দেশনা, কাহিনী নির্মাণ, সংগীত, অভিনয় সবগুলো দিকেই তারা এতটাই দক্ষ ও পরিণত যে, মুগ্ধতা আপনা-আপনিই চলে আসে। বর্তমান সময়ে সাউথ কোরিয়ানরা বিশ্ব সিনেমায় এতটাই শক্তিশালী ঘরানা হয়ে উঠেছে যে, তারা কেবল সিনেমা বানিয়েই ক্ষ্রান্ত হয়নি, বরং বিশ্ব সিনেমায় যতগুলো জেনর আছে সবগুলো নিয়েই কাজ করেছে, এবং সিনেমা নির্মাণ বা কাহিনীর চমকপ্রদ বিকাশ ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেনা-জানা জেনরকেও ভেঙে দিয়েছে, কিংবা জেনরের মধ্যে থেকেই জেনরের স্বভাবজাত বিকাশকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছে বা নতুনতর এমন মাত্রা সংযোজন করেছে,যা জেনরের মধ্যেই নতুনতর এক জেনর তৈরী করেছে, এবং আমরা চমকে উঠেছি এভাবে ভাবতে বা দেখাতে পারার প্রয়াস দেখে, আর সেজন্য বলা যেতে পারে, বর্তমান বিশ্ব সিনেমায় সাউথ কোরিয়ান সিনেমা অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে তরুণ পরিচালকদের, এমনকী অন্যান্য পরিচালকদেরও, কেন না মাত্র আট মিনিয়ন ডলার বাজেটের এই সিনেমাটি তার বিকাশে এমনভাবে প্রকাশিত যে, ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’-এর মতো মেগা বাজেটের সিনেমাকেও যেন তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে তুলেছে।
মূলতঃ ‘ওয়েলকাম টু ডংগমাগুল’ সিনেমার অধিক চিত্রায়িত এক জীবনচিত্র, যার স্বপ্ন মানবজাতি দেখে আসছে বা দেখবে আজীবন, আর এই নির্মল ও সুন্দর স্বপ্নকে চিরকাল বিঘ্নিত করেছে যুদ্ধ নামক অনাকাঙ্খিত বর্বরতা, ফলে মানবসমাজে বারবার নেমে এসেছে অস্থিরতা, অশান্তি ও চিরস্থায়ী বিবাদ। বস্তুত, যুদ্ধ বলতেই আমাদের চোখের সামনে প্রাথমিকভাবে যেসব কাহিনী বা দৃশ্যাবলী ভেসে উঠে, তারই চিরাচরিত বর্ণনা বা রূপ ফুটে উঠেছে যুদ্ধ নিয়ে বানানো সিনেমাগুলোতে, যখন এই সিনেমাটি আমাদের চিরচেনা যুদ্ধ বাস্তবতা হতে সহস্র যোজন দূরের অবনদ্য এমন এক নির্মাণ, যেখানে যুদ্ধ ষোলআনা বর্তমান থাকলেও জীবন ও মানবিকতা প্রকাশিত অনেক বেশি, আর সিনেমাটি যখন শেষ হয়, তখন কোনোরূপ সংশয় ছাড়াই আমাদের মনে হতে বাধ্য, আমরা তেমন পৃথিবীর স্বপ্ন কখনই দেখেনি যা ডংমাগুলের বাসিন্দাদের জীবনের বিপরীত, বরং আমরা এমন একটি জীবন ও সমাজ চেয়েছিলাম, যেখানে মানুষ খুব সহজেই সুখি এবং জীবন আনন্দে মশগুল। মূলতঃ এখানেই সিনেমাটি তার সার্বিক সৌন্দর্যে বিকশিত এবং পরিচালক কাঙ-হিয়ুন পার্ক সর্বোতভাবেই সফল হয়েছেন এমন দুঃসাধ্যকর প্রয়াসে, কেন না যুদ্ধের মতো জেনরের সিনেমায় এভাবে জীবন, সমাজ ও মানবীয় দিকগুলোকে একত্রে প্রতিফলিত করা যে কোনো পরিচালকের জন্য কেবল কষ্টকর নয়, বরং রীতিমতো চ্যালেঞ্জের।
সিনেমাটি পঞ্চাশের দশকে সাউথ কোরিয়া, নর্থ কোরিয়া ও আমেরিকান সেনাবাহিনীর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এক কাহিনী যেখানে ঘটনাক্রমে তিনবাহিনীর কয়েক জন সৈন্য চারিদিকে পাহাড়ঘেরা ডংমাগুল নামের এক দূর্গম গ্রামে উপস্থিত হয়, যেখানের বাসিন্দারা বহির্বিশ্ব সম্পর্কে প্রায় সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ। এমনকী তারা জানেও না যে তাদের দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যেখানে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে হানাহানি শুরু করেছে, যা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে। এছাড়াও তারা এমন অনেক বিষয়েই অজ্ঞ, যা সৈন্যদের দ্বন্দ্বে ফেলে দিলেও, ডংগমাগুলের বাসিন্দাদের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, বরং তারা তাদের অব্যাহত জীবন ধারায় সুখি ও সহজ-সরল। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন তিন বাহিনীর সৈন্যরা একে অপরকে হত্যা করার মতো সহজাত প্রবৃত্তিতে লিপ্ত, তখন তারাই এই গ্রামে উপস্থিত হয়ে ক্রমশঃ এমন একটি সমাজ তথা জীবনের অংশে পরিণত হয়, যেখানে তারা নিজেদের সাউথ কোরিয়ান কিংবা নর্থ কোরিয়ান, এমনকী আমেরিকান হিসেবেও খুঁজে পায় না, বরং বৈরীতা ভুলে তারা সমাজে বিরাজমান স্বস্তি ও শান্তিকে বজায় রাখার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। এটাই ছিল সিনেমাটির মূল প্রতিপাদ্য, যেখানে অর্ধ-শতাব্দীর অধিক সময় ধরে নর্থ আর সাউথ কোরিয়ানরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয় যেমন কারিয়ানদের কাছে,তেমনি সুস্থ-সুন্দর পৃথিবীর জন্যও।
পরিচালকের কল্পিত ডংমাগুল গ্রামটি ও সেখানের বাসিন্দারা মূলতঃ মানুষের চিরকালীন স্বপ্নের সেই সুন্দরতম অংশ, যা আমাদের সবারই কাম্য, কেন না সেখানের বাসিন্দারা সবকিছু ভুলে বাঁচতে জানে, সুখি হতে পারে এবং ‘শত্রু’ অথবা ‘মিত্র’ এমন সংজ্ঞার উর্ধ্বে উঠে কেবলমাত্র মানুষ হিসেবে মানুষকে স্বাগত জানাতে পারে দ্বিধাহীন চিত্তে। সিনেমাটিতে মানবীয় জীবন কল্পনার দিকে যেভাবে আলোকপাত করা হয়েছে তাকে এক কথায় অনবদ্য না বলে কোনো উপায় নেই, কেননা সহজ-সরল জীবনের মানুষগুলো তো এমনই হয়।
সিনেমাটিতে অভিনয় করা প্রতিটি কলা-কুশলীই তাদের সেরাটি উপহার দিয়েছেন, এবং যেহেতু এখানে একটি সমবেত জীবনচিত্র দেখানোর প্রয়াস বর্তমান, সেহেতু সিনেমাতে সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় চরিত্র অনুপস্থিত। তারপরও সিনেমাটি দেখার সময় যে মুখটি সবসময় আমাদের সামনে ঘুরে-ফিরে আসে, তাকে ভোলা মুশকিল, এবং এই বিশেষ মুখ ও তার অভিব্যক্তি যেন পরিচালকের নিজস্ব সৃষ্টি, যা সিনেমাটিকে জেনর ভেঙে ভিন্নমাত্রায় উতরে যেতে এতটাই সহায়তা করেছে যে, যখনই আপনি চোখ বন্ধ করবেন, তখনই এই যুবতীর মুখটি আচমকা আপনার সামনে ভেসে উঠবে। আর এই খেপাটে, খেয়ালী যুবতীর চরিত্রে অভিনয় করা হে-জিয়ুঙ কাঙ-কে নতুন করে করে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই, কেন না ইতিমধ্যেই আমরা তাকে দেখেছি ‘ওল্ড বয়’-এ দূর্দান্ত অভিনয় করতে, আর এই সিনেমাটিতে তাকে এতটাই উজ্বল,উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত আর ঝলমলে মনে হয়েছে যে, এই খেয়ালী যবুতীর চরিত্রে কেবল তাকেই মানিয়ে যায়, পুরোপুরি।
সিনেমাটিতে মানবীয় গুণাবলীর সবদিকেই দারুণভাবে আলোকপাত করা হয়েছে, আর সেই সাথে যে রসবোধ বা বিদ্রুপ পরিচালক আমাদের দেখিয়েছেন, তাতে সিনেমাটি এমনিতেই তার মূল জেনর ভেঙে ভিন্ন এক জেনরে ঢুকে পড়েছে। এছাড়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যবলী, সংগীত ও অসাধারণ এডিটিং সবকিছুতেই পরিচালক তার যথাযথ যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন, এবং বলতে দ্বিধা নেই, সিনেমাটি আজ অব্দি আমার দেখা যুদ্ধ জেনরের সেরা সিনেমা।
আই..এম.ডি.বি-র রিভিউ সেকশনে এক দর্শক লিখেছেন, সিনেমাটি আমেরিকানদের দেখানো উচিত ছিল বেশি করে, অথচ সিনেমাটি আমেরিকায় নাকি দেখানো হয়নি সেভাবে। হয়ত তা ঘটলে তারা জানতে পারত, সেভিং প্রাইভেট রায়ান-এর মতো নিতান্তই আমেরিকান সেনাবাহিনীর দাপট, অহংকার ও শক্তি প্রদর্শনের মতো একটি সিনেমা দিয়ে কমছে কম দশটি ওয়েলকাম টু ডংমাগুল বানানো যেত অনায়াসেই, আর তারা হয়ত ভালভাবেই উপলব্ধি করত, সিনেমা বানাতে কেবল কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢাললেই হয় না, বরং মেধা ও মনন লাগে, যা কোরিয়ান পরিচালকরা খুব ভালভাবেই অর্জন করেছেন, আর সে কারণেই টাইটানিকের মতো সিনেমা মানব সভ্যতা তথা মানুষের চিরাচরিত জীবন বিকাশে যে বোধ বা উপলব্ধি সংযোজন করতে ব্যর্থ, তা ওয়েলকাম টু ডংমাগুল খুব ভালভাবেই করতে সক্ষম এবং ভবিষতেও সফল হবে, একইভাবে।
আমি আগেও উল্লেখ করেছি, কোরিয়ান কলা-কুশলীদের অভিনয় দক্ষতা এক কথায় অসাধারণ, এবং পর্দায় তারা এতটাই সাবলীল যে,মনেই হয় না তারা অভিনয় করছে।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কেবল বয়স্ক বা তরুণরাই নয়, কোরিয়ান শিশু শিল্পীদেরও অভিনয় ততটাই অনবদ্য যা আপনাকে কোনো অংশে কম বিমুগ্ধ করবে না। সিনেমাটি সকল সিনেমাপ্রেমীদেরই দেখা উচিত, কেন না যুদ্ধ নিয়ে এত ভাল সিনেমা খুব বেশী তৈরী হয়েছে বলে মনে হয় না, আর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই সিনেমাটি এতটাই জরুরী যে, কেবল দর্শক হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও আমাদের উচিত এমন একটি জীবনবোধে পূর্ণ হওয়া, যা ডংমাগুল গ্রামের বাসিন্দাদের নিজস্ব যেমন, তেমন মানবজাতীরও চিরকালীন। ধন্যবাদ পরিচালক কাঙ-হিয়ুন পার্ককে, এমন একটি অসাধারণ সিনেমা আমাদের উপহার দেবার জন্য, যেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ আমাদের মাথার উপর ছেয়ে রয়েছে প্রতিনিয়ত আর তার মাঝে বসেই আমরা আচ্ছন্ন হই, আশান্বিত হই, স্বপ্ন দেখি এবং নিজেদের বলি, ‘ডংমাগুল-এমনই তো হওয়া মানুষের প্রকৃত জীবন চিত্র’।
অরণ্য
ঢাকা, বাংলাদেশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।