বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম এ নায়িকা জীবদ্দশায়ও তিন দশক অন্তরালেই ছিলেন। ১৯৭৮ সালে সুচিত্রা সেন অভিনীত শেষ ছবি 'প্রণয় পাশা'। এর পরই বাই বাই জানান চলচ্চিত্রজগৎকে। একই সঙ্গে জনসম্মুখ থেকেও নিজেকে আড়াল করে রাখেন। টেলিভিশন চ্যানেলেও তাকে আর দেখা যায়নি।
তার কোনো সাক্ষাৎকার কোনো পত্রপত্রিকায় কিংবা বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। গণমাধ্যম তার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ফ্ল্যাটেও যেতে পারেনি। তার ঘনিষ্ঠ আত্দীয়স্বজন, কন্যা-জামাতা, দুই নাতনি ও ঘনিষ্ঠ পরিচিত কিছু মানুষ ছাড়া কেউই সুচিত্রার নাগাল পায়নি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও সে খবর সংবাদমাধ্যমের কাছে পেঁৗছেছে অনেক পরে। অন্তরালের কারণেই অন্য হাসপাতালে না গিয়ে অসুস্থ হয়ে বরাবরই কলকাতার মিন্টো পার্কের বেলভিউ নার্সিং হোমেই ভর্তি হয়েছেন তিনি।
এ নিয়ে পাঁচবার এ নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিলেন মহানায়িকা। এবার ২৪ ডিসেম্বর মধ্য কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হলেও সে খবর জানাজানি হয় দুই দিন পরে।
প্রথমে ৬ তলার সুইটে থাকলেও পরে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে ৩ তলার আইটিইউ সুইটে পাঠানো হয়। সে ঘরে পরিচিত ডাক্তাররা ছাড়া বাকিদের প্রবেশাধিকারে ছিল নিষেধাজ্ঞা। তবে এবারে ব্যতিক্রম অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রী।
যদিও সুচিত্রা সেনের অন্তরালকে সম্মান জানাতে অসুস্থতার খবর পেয়ে প্রথমবারের জন্য হাসপাতালে গেলেও তার সঙ্গে দেখা করেননি মুখ্যমন্ত্রী। যদিও পরে সুচিত্রা সেন নিজেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নার্সিং হোমেই সুচিত্রা সেনের ক্যাবিনে খাওয়ার পেঁৗছে দেন গৌর ও সন্ন্যাসী নামে দুই কর্মী। এ কয়েক দিনে মহানায়িকার সঙ্গে রীতিমতো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন দুজন। পরিস্থিতি এমনই যে এ দুজন ছাড়া অন্য কেউ তার ঘরে খাওয়ার নিয়ে আসুক এটা চাননি মহানায়িকা।
মহানায়িকার আইটিইউ ক্যাবিনের ডিউটিতে ছিলেন তিনজন নার্স। আট ঘণ্টার শিফটে ছুটি বাতিল করে এ তিনজনকেই ডিউটিতে রাখা হয়। এ তিনজন ছাড়া অন্য কেউ তার ক্যাবিনে আসুক, তা পছন্দ নয় বলে নিজেই জানিয়েছিলেন মহানায়িকা। এ চেনা মুখগুলোর বাইরে কেউ ক্যাবিনে ঢুকলে দ্রুত চাদরে মুখ ঢেকে নিতেন তিনি, হাতে স্যালাইনের চ্যানেল থাকলে পাশ ফিরিয়ে শুয়ে পড়তেন। সচরাচর অপরিচিত কাউকে সুচিত্রা সেনের ক্যাবিনে পাঠাত না নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ।
সুচিত্রা সেন যাতে আর বিড়ম্বনায় না পড়েন সে কারণে ডাক্তার, নার্স কাউকেই ছুটিতে পাঠায়নি কর্তৃপক্ষ। অপরিচিত ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তার ক্যাবিনের বাইরে বাড়ানো হয়েছিল নিরাপত্তাও। এমনকি মৃত্যুর পরেও মহানায়িকার সেই নিথর দেহের কোনো ছবি সংবাদমাধ্যমকে তুলতে দেয়া হয়নি। কালো কাচে ঢাকা শববাহী গাড়িতে করে মহানায়িকার কফিনবন্দী মরদেহ হাসপাতাল থেকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বালিগঞ্জের বাড়িতে, সেখানে মিনিটদশেক থাকলেও বাড়ির ভেতর সংবাদমাধ্যম কিংবা সাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তার শববাহী গাড়িকে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। সেখানেও ছিল চূড়ান্ত গোপনীয়তা। শ্মশানের বাইরে পুরো কলকাতা ভেঙে পড়েছিল। সবাই একটিবারের জন্য তাদের প্রিয় নায়িকাকে দেখতে চায়। কিন্তু পুলিশি নিরাপত্তায় হাসপাতাল তখন দুর্গে পরিণত হয়।
দূর থেকেই বিদায় জানাতে হয় বাংলা ছবির ম্যাটিনি আইডলকে।
২৬ বছরের দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে বাংলা-হিন্দি মিলে ৬০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৫ সালে 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হলেও জনসম্মুখে আসবেন না বলে তিনি ওই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। কিন্তু ঠিক একই কারণে সে সময়ও মেয়ে মুনমুন সেন তার মায়ের হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন।
আসলে গৃহবন্দী জীবনই ছিল তার পছন্দ। যদিও তার এই অন্তরালে থাকা নিয়েও ছিল অনেক গবেষণা। কেউ বলেন উত্তমকুমারের মৃত্যুতে তিনিও ব্যথিত, তাই অন্তরালে থেকেই তার এ ভালোবাসার প্রমাণ দেবেন। কেউ আবার বলেন বার্ধক্যের চাদরের তলায় তার যে চিরলাবণ্যময়ী চেহারা ঢাকা পড়ে গেছে, সেই চেহারা জনসম্মুখে না এনে সুচিত্রা সেন পর্দার আড়ালে থেকে তার ভক্তদের মনের মন্দিরে স্মৃতিময় হয়ে থাকার জন্য এ কৌশল বেছে নিয়েছেন। আবার অনেকেই মনে করেন একটি দুর্ঘটনায় নাকি তার মুখমণ্ডলের অনেকটাই ঝলসে গেছে সেই বীভৎসতা লুকাতেই তার এমন অন্দরবাস।
কিন্তু যে যাই বলুক না কেন, সুচিত্রা সেন তো প্রায় তিন দশক ধরে অন্তরালেই ছিলেন। কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটি ছিল তার একমাত্র ঠিকানা। তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘিরে ধরেছিল নিঃসঙ্গতা নামক এক অক্টোপাস। মেয়ে মুনমুন বা তার নাতনি রিয়া, রাইমা সব সময় নিজেদের ব্যস্ততার কারণে দেখা করতে পারতেন না। একসময় যার মৃদু হাসির ঝলক দেখতে হলগুলোয় ভিড় উপচে পড়ত, সেই সুচিত্রা সেন আজ আর নেই।
এটা ভেবেই দুঃখে-শোকে ভেঙে পড়েছে আপামর বাঙালি। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই নার্সিং হোমের সামনে অপেক্ষমাণ অনেকের চোখেই তখন পানি ঠিকরে পড়ছে। কেউ বা আবার মুখে রুমাল দিয়েই ভেতরে ভেতরেই গুমরে কেঁদেছেন। বাড়ির টেলিভিশন সেটের সামনে যারা ছিলেন তারাও প্রিয় নায়িকার মৃত্যু সংবাদ শুনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।