আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিবার্চন:নিরপেক্ষ হলে যা হতো!

নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে।

অবাধ, সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ নিবার্চনেই জনমতের প্রকৃত অবস্থার প্রকাশ করে। তাই, সদ্যসমাপ্ত ভোটারবিহীন একতরফা সংসদ নিবার্চন নয়, আমরা বরং জনগণের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য বর্তমান সরকারের অধীনে হয়ে যাওয়া গত সিটি নিবার্চনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখব।
আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নিবার্চনেও ক্ষমতাসীন সরকারের সুস্পষ্ট ব্যবধানে পরাজয় ঘটেছিল, একে একে সমস্ত সিটি নিবার্চনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি দেখে সাচ্চা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাদ দিয়ে আম-জনতার একটা উল্লাস ধ্বনিও আমাদের সামনে পরিলক্ষিত হয়েছে। ঠিক একই চিত্র আমরা দেখেছি বিএনপির পাঁচ বছর শাসন আমলে।

এই উল্লাস-ধ্বনি থেকে আমরা অন্তত পক্ষে একটা ইতিবাচক দিককে চিহ্নিত করতে পারি, তা হলো, দুই নেত্রী কথায় কথায় যে জনতার দোহাই দেন, সেই জনতার বড় অংশটাই আদপে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির বাঁধা ভোট নয়, ভোটাধিকার হচ্ছে তাদের কাছে একটা অস্ত্র মাত্র।
এই অস্ত্র তারা প্রয়োগ করে তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং সেই স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার প্রতিশোধের অবস্থানে দাঁড়িয়ে। এটা আমরা গত ৯১ সালের নিবার্চন থেকে লক্ষ করে আসছি। এবং সদ্যসমাপ্ত নিবার্চনও যদি ঠিকঠাক মতো হতে পারতো সেখানেও আমরা নিশ্চিতভাবেই এই অভিজ্ঞতার ফলাফল প্রত্যক্ষ করতাম। অনেকেই হয়তো সিটি নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের বিশ্লেষণের বিষয়ে, দ্বিমত পোষণ করে বলতে পারেন, সিটি নির্বাচন স্রেফ স্থানীয়-সরকার নির্বাচন মাত্র।


জি, এই বিষয়ে আমাদেরও দ্বিমত নেই, তবে মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের শাসকশ্রেণির সবর্গ্রাসী রাজনীতি দলীয়করণের ভয়াবহ প্রভাব থেকে স্থানীয় সরকার পরিষদ মোটেও মুক্ত নয়। তাই যতই দলনিরপেক্ষতার কথা বলা হোক কেন, এই বলাটা আসলে পরাজিত দলের লজ্জা ঢাকার একটা ভূষণ মাত্র। প্রকৃত সত্য হচ্ছে মানুষ ব্যক্তি দেখে নয়, দল দেখে ভোট দেয়।
যদি ব্যক্তি দেখে ভোট দিত, তবে নিদেনপক্ষে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নিবার্চনে খায়রুজ্জামান লিটনের কপালে এমন ভয়াবহ পরাজয় জুটতো না। তাকে যারা ভোট দেয়নি তারাও স্বীকার করে নিয়েছে লিটনের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি আর দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা।

তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি সদ্যসমাপ্ত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের দৃশ্যমান পূর্বলক্ষণ ছিল মাত্র।
আমরা ধরে নিতে পারি, নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হলে আওয়ামী লীগের সেই অভিজ্ঞতা হতো যে অভিজ্ঞতা ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির হয়েছিল। যে নির্বাচনে আমরা দেখেছি জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি ও বিএনপির প্রশ্নাতীত ঘাঁটি বগুড়া থেকেও দলটা আসন হারাতে, যেটা পুরো রাজনীতিক মহলকে বিস্মিত করেছিল।
আমরা আমাদের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি একই বিস্ময়বোধ দশম সংসদ নিবার্চনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, কিংবা বলতে পারি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি গাজিপুর সিটি নিবার্চনে সরকারের পরাজয়ও আমাদের জন্য কম বিস্ময়কর নয়।
এখন আমাদের সামনে যে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, মাত্র পাঁচ বছর আগে যে দল এত বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল, সেই আওয়ামী লীগের এমন জন-বিচ্ছিন্নতার কারণ কি? খুব সহজেই আমরা কতগুলো কারণ বলে ফেলতে পারি যেমন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মাসেতু, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, হেফাজতের সমাবেশে হামলা, বিরোধী মত দমনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি রকমের আচরণ, সীমাহীন দুর্নীতি ইত্যাদি ইত্যাদি।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক একই কারণে কী আমরা নবম সংসদ নিবার্চনে বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করিনি? কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধেই যদি জনগণের এই রায় হয়, তবে গাজীপুরে আমরা যাকে মেয়র নিবার্চন করলাম তিনি কে? তার ইতিহাস কী জনগণের অজানা?
আমরা দেখতে পারছি জনগণের অসহায়ত্ব, নিরুপায় জনতার নীরব পরাজয়। জনগণের সামনে দুর্নীতির আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের স্পৃহা কিন্তু তার নিরুপায়, তাদের সামনে কোন বিকল্প নেই। চতুর শিয়ালের সেই গল্পের মতো, যে একটা ছানাকে বারবার দেখিয়ে কুমিরকে বোকা বানিয়েছিল। আমরা জনগণ যেন এই নষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে বোকা কুমির বনে গেলাম।
ইন্টারনেটের এই যুগে এখন আর কিনে পত্রিকা পড়তে হয় না, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন জাতীয় আর আঞ্চলিক মিলিয়ে আমার ডজন খানেকের বেশি পত্রিকা দেখা হয়।

আমি গত সিটি নিবার্চনের সময় মিডিয়াতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলাম, কোথাও যদি জোট-মহাজোটের বিপরীতে বিকল্প কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়, মেয়রের কথা ছাড় দিলাম, যদি কাউন্সিলারদের মধ্যে সেইসব বামপন্থিদের কেউ থাকেন, যারা তিনজন বক্তা আর ত্রিশজন শ্রোতা নিয়ে দেশের যেকোন সংকটময় মুহূর্তে রাজপথে থাকেন, কিংবা সেইসব বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা, যারা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে এটাকে সংস্কার করতে চায়, চায় আরো বেশি জবাবদিহিতামূলক, স্বচ্ছ, জনকল্যাণকর করতে। না তাদের কোন কণ্ঠস্বর,সেই নিবার্চনে ছিল না।
আমার দৃষ্টির বাইরে দুই একজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি করেও থাকেন তারা নিশ্চয়ই মূল হিসেবের বাইরে ছিলেন। হিসেবের মধ্যে থাকলে দুই একটা মিডিয়াতে হলেও আমরা তাদের খবর জানতে পারতাম। এই যে পুরো দেশ আজ দুই দলের মোহগ্রামে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ল, এটার দায় কি জনগণের? তবে কি জনগণ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এই নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট খেলায়।


আমি আমার মাঠের রাজনীতির অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, জনগণ পরিবর্তন চায়, আর চায় এটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁরা দুই দলের কারো বাঁধা ভোট বক্স হিসেবে কাজ করছে না।
উদভ্রান্তের মতো একবার আওয়ামী লীগ একবার বিএনপির দিকে ছুটছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা বাদ দিলাম, আমি চট্টগ্রাম শহরের যে অংশে বাস করি সেই অঞ্চলের ৯৫ভাগ সাধারণ মানুষেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাতে ইসলামি ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নাম জানে না । টিভি টক শো-তে সেইসব সংস্কারপন্থি সুশীলদের কথা শুনেছে মাত্র, তাদের কোন প্রতিনিধিকে এলাকার মানুষ চোখে দেখেছে বলেও মনে হয় না।
তবে দায় কী তাদের যারা জনগণকে পরিবর্তনের কথা বলছে, অথচ জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।

আমি নিজে একদা একটা বাম রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বলতে পারি, তাদের অনেকেরই আর যায় হোক রাজনৈতিক সততা আর একাগ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। আমি অনেককেই জানি যারা জনগণের মুক্তির প্রশ্নকে সামনে রেখে অনলস সংগ্রাম করতে গিয়ে ব্যক্তিজীবন ত্যাগ করেছেন। তবে তারা কেন ব্যর্থ হচ্ছেন?
এখানে জনগণের ভূমিকা স্রেফ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দুনীতিকবার দায়িত্ব কে পাবে সেটা ঠিক করে দেওয়া। কারণ ভোট নামক এই একটা অস্ত্র ছাড়া অসংগঠিত জনতার হাতে আপাদতে আর কোন অস্ত্র নেই, নেই কোন বিকল্প।
যতদিন তাদের সামনে বিকল্প হাজির হবে না ততদিন পর্যন্ত এভাবেই জাতি একবার তপ্ত কড়াইয়ে ভাজা হবে, আরেকবার জ্বলন্ত উনুনে।

তাই যারা পাঁচ সিটি নির্বাচন ভোট অস্ত্র প্রয়োগ করে উল্লসিত হয়েছেন, কিংবা সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে ভোট অস্ত্র প্রয়োগ করতে না পেরে মনোকষ্টে ভুগছেন, তারা যেন ভুলে না যান তাদের এই বারবার নীরব পরাজয়ের কথাও


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।