অদ্ভূত বিষয়গুলোতে বিস্ময়াভূত হওয়া একটি চমকপ্রদ ব্যাপার!! প-এ পায়েল, প-এ পায়েল
আগের পর্ব এখানে
৮।
ভার্সিটির বান্ধবীর বড় ভাইকে তদবীর করে কাজলের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে গেল পায়েল। কাজলের সাথে দেখা হওয়ার পর ভয়েহাত পা ঠান্ডা হয়ে এল ওর। রিমান্ডে রেখে কাজলের শরীরের কি হাল করেছে পুলিশ। সারা শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত ঝরে ঝরে পড়ছে।
যে শার্টটা গায়ে তাও ভিজে চুপচুপ হয়ে আছে।
পায়েলকে দেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে কাজল। কিন্তু তাতেও ওর ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়। কাজলের এ অবস্থা দেখে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না ও। কাজল সেল ধরে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন।
তারপর বলে, আপনি এসেছেন? পায়েল অস্থির হয়ে গেছে। ওর চোখ ফেটে পানি আসতে চাইছে। বলল, আপনার এমন অবস্থা করেছে! কাজল আবার একটু হাসল। রিমান্ড। তারপর হঠাত্ মনে পড়ল এভাবে বলল, আচ্ছা বলুন তো আমি কিভাবে বলব মেয়েটার আমি ক্ষতি করেছি কিনা।
পায়েল মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমি জানি। মেয়েটার কাছ থেকে সব শুনেছি। কিন্তু রসুচাচা এমন কেন করল? কি লাভ তার। কাজল বলল, আমি কারো কোন ক্ষতি করতে চাই নি। চুপচাপ বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে চেয়েছি।
আসলে ওদের মধ্যে ভয় কাজ করছিল যদি আমি আপনাকে সব বলে দেই?
পায়েল অস্থির হয়ে গেল আরো। কি বলে দিবেন? কি বলবেন বলুন আমাকে। ওরা কারা?
কাজল কথা বলতে গিয়ে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। অনেক কষ্টে বলল, কুসুমের মা যে আপনার মা নন তা জানেন আপনি?
এ কথা শুনে চমকে উঠল পায়েল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
অবিশ্বাসের সুরে বলল, কি বলছেন আপনি? আমার মা। আমার মা নন?
আপনার মা, আপনার মা। তবে তিনি আতাউর সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। আপনি তাঁর প্রথম স্ত্রীর সন্তান। আপনার মা মারা গেলে কুসুমের মাকে বিয়ে করেন তিনি।
তবে এটা সত্যি আতাউর সাহেব আপনাকে ভীষন ভালবাসেন। ভালবাসতেন আপনার মাকেও।
ধীরে ধীরে পায়েল বলল, কি হয়েছিল আমার মায়ের।
একথা বললে আপনি হয়তো জ্ঞান হারাবেন। বিশ্বাস করতে চাইবেন না।
পায়েল শক্ত করে কাজলের হাত ধরল। বলল, বলুন আমাকে। আমি জানতে চাই। প্লিজ বলুন।
কাজল বলা শুরু করল, আপনার মা ঠিক মারা যান নি।
তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর মেরেছে আপনার বাবা। এই কথা বলেই কাজল পায়েলের দিকে ভাল করে তাকালো। পায়েল চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।
পুরো কথা না শুনেই আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না প্লিজ।
আমার মনে হয় আপনার পুরোটা জানা উচিত। আপনার বাবা ভেবেছিলেন আপনার মা অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক করেছেন। লোকটি পালানোর সময় পিছন থেকে তিনি লোকটিকে দেখেও ফেলেন। কিন্তু অন্ধকারে চিনতে পারেন নি। কিন্তু আমি জানি সে লোক প্রকাশ্যে আপনাদের মাঝে ঘোরাফেরা করে, আপনাদের বাড়িতে।
পায়েল চখ মেলে। মুখ থেকে অস্ফুট সুর বের হয়, রসুচাচা ?
কাজল বহু কষ্ট স্বত্বেও বলতে শুরু করে কেননা এরপর হয়তো আর সে সময় পাবেনা পায়েলকে বলার।
হ্যা রসুচাচাই। তবে আরো ভয়ানক কথা হচ্ছে আপনার মা ইচ্ছে করে সম্পর্ক করেনি বরং তাকে রেপ করা হয়েছে। রসুচাচা বাড়ি ফাঁকা পেয়ে রেপ করেছে আপনার মাকে।
আপনি হয়তো ভাবছেন এ কথা আমি জানলাম কি করে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? বিয়ের আগে রসুচাচা তাঁর বউকেও রেপ করেছিল। পারিবারিক কলংক থেকে রক্ষা পেতে মেয়েটির মা-বাবা রসু চাচার সাথে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেয়। তা না হলে আপনার মনে কি কখনো প্রশ্ন আসে নি, কি দেখে তারা রসু চাচার কাছে বিয়ে দিল। চালচুলো হীন অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা বয়স্ক লোকটির কাছে এত ছোট একটি মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় কোন বাপ মা? সে যাই হোক, আপনার মায়ের খুন হওয়ার ঘটনাটি আমি শুনতে পাই আপনার বাবারই মুখ থেকে।
তিনি রসুমিয়ার সাথে কথা বলছিলেন পুকুর পাড়ে। রসুমিয়া সব জানে। শুধু আপনার বোকা বাবা মুখোশধারী এ লোকটিকে চিনতে পারেনি। আমি সব শুনে ফেলি আর সেটা দেখেও ফেলে তারা।
আপনি কি করে জানলেন রসুচাচাই...!
মুখের কথা কেড়ে নেয় কাজল।
এত আহত থাকা সত্বেও ওর মধ্যে আজ ভর করেছে অসীম বল। সবকিছু পায়েলকে না বলে ক্ষান্ত হবে না সে। কাজল বলে, নরপিশাচটা প্রায় রাতেই মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। আমি একজন পুরুষ মানুষ। তাঁর ঠিক পাশের ঘরেই থাকি, সেটা সে একবারও গা করেনি।
লজ্জায় আমি কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। বেশ কিছুদিন যাবৎ-ই ভেবেছিলাম ও বাড়ি ছেঁড়ে চলে আসব। কিন্তু এর মাঝেই শুনে ফেলি আপনার মায়ের খুনের ভয়াবহ ঘটনা। এত কিছুর স্বাক্ষী হয়ে আমি আর থাকতে পারছিলাম না। এভাবে বাড়ি ছেঁড়ে চলে যাব শুনে ভয় পেয়ে যায় ওরা।
কারণ জানে এ বাড়িতে থাকা অবস্থায় আপনার সাথে আমি কথা বলতে পারব না। কিন্তু বাড়ির বাইরে চলে গেলে আমি যেকোন সময় আপনার সাথে দেখা করে সব বলে দিতে পারি। তাই তারা এ উপায় করল। লজ্জাজনক অপরাধের অপরাধী করল আমাকে। এ বলে মাথা নিচু করে ফেলল কাজল।
পায়েল আবারও জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করে জানলেন রসুচাচাই মাকে...!
কাজল বলে, ঐ যে বললাম মেয়েটাকে প্রায়-ই রাতেই...ছোট্ট মেয়েটা আর্তনাদ করত। আর রসু মিয়া প্রায়ই একটা কথা বলত।
কথাটা বলতে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে কাজল। লজ্জায় যেন ও মাটির সাথে মিশে যেতে চাইছে, জমিদারের বউও আমার কাছ থেকে বাঁচেনি আর তুই ফকিরের ঝি... আমার ধারণা জমিদারের বউ বলতে সে আপনার মায়ের কথাই বলেছে।
অসাড় হয়ে আসে পায়েলের শরীর।
সেলের গ্রীল ধরে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে ও। ওপর পাশ থেকে কাজলও বসে পড়ে। খুব আস্তে আস্তে বলে, খেয়াল করেছেন? রসুমিয়ার বউয়ের পায়ে একটা পায়েল । একটা পায়েল কেন পায়ে? আরেকটা কোথায়? সোনা খচিত জরোয়া এই পায়েল রসুমিয়া পাবে কোথায়? যদিনা সেটা আপনার মায়ের কাছ থেকে সে ছিনিয়ে নেয়। আপনার মা সবসময় পায়ে পায়েল পড়ত বলে শুনেছি সেদিন।
আপনার মা আপনার বাবার আক্রমনে মৃত্যুর আগে বারবার পায়েলের নাম নিচ্ছিল। আমার মনে হয় সে পায়েল আপনি নন। কেননা সেদিন আপনি বাড়ি ছিলেন না, সুতরাং তিনি আপনার নাম ধরে ডাকেন নি। তিনি নিশ্চই পায়ের পায়েলের কথাই বলেছেন, যেটা রসু মিয়া নিয়ে গেছে। তিনি হয়তো মৃত্যুর আগে রসুমিয়ার কথা বলতে চেয়েছিলেন।
এত দিনে রসুমিয়া এটা বিক্রয় করে দিতে পারত, ধরা পড়ে যাবে কেন ভেবে করে নি। আপনার বাবা নামীদামী লোক, তাঁর বাড়ি থেকে একটা সোনার জিনিস বিক্রি হচ্ছে, এটা অবশ্যই কানে যেত আতাউর সাহেবের। বেশ নিশ্চয়তার সাথে কথা বলছে কাজল।
খানিক থামে ও। তারপর আবার বলতে শুরু করে, আপনার বাড়ির পুকুরটা ব্যবহার করা হয়না অথচ পরিস্কার রাখা হয় কেন? একবারও ভেবে দেখেছেন?
চমকে তাকায় পায়েল।
কাজল বড় করে শ্বাস নেয়। বলে, পুকুরটার নিচেই কবর দেওয়া হয়েছে আপনার মাকে। এজন্যই পুকুরটা অব্যাহৃত কিন্তু যত্নে আছে। তবে এটা বোঝা যায়, আপনার বাবা বেশ ভালবাসতেন আপনার মাকে। একথা বলে বিষাদমাখা এক হাসি হাসে কাজল।
৯।
পায়েলের ঘরের আলমারিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পায়েল। কখনো খুলে দেখা হয়নি। আলমারির চাবি আনতে রেহানার ঘরে যায় পায়েল। মাকে জিজ্ঞেস করে,
আমার ঘরের ঐ আলমারির চাবিটা কোথায়?
রেহানা বেশ অবাক হয়।
বলে, ঐ চাবি দিতে তুই কি করবি?
ওটা কোথায় সেটা তুমি বলো। মেয়ের গলা শুনে ভয় পেয়ে যায় রেহানা। বলেন,
তোর বাবা জানে।
বাবা কোথায়?
বাড়িতে নেই।
শাবল আনো।
আমি তালা ভাঙ্গব।
রেহানা চোখ বের হয়ে আসতে চায়। ওমা! তালা ভাঙ্গবি কেন?
কথার জবাব দেয় না ও। দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। নিচে নেমে যায়।
উঠানের একপাশে শাবল কোদাল এসব রাখা। শাবলটা তুলে নেয় অখান থেকে। দৌড়ে নিজের ঘরে আসে। পায়েলের এরকম কান্ড কারখানা দেখে রেহানা, কুসুম ও রবি সবাই ওর পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে পায়েলের ঘরে আসে। আজ শরীরে ভয়াবহ শক্তি এসে ভর করেছে ওর।
শাবল দিয়ে ক্রমাগত বারি মারে পায়েল। অনেক পুরানো তালা বেশ কয়েকটা আঘাতেই খুলে যায়। দ্রুত হাতে কপাট খুলে পায়েল। আলমারিতে বেশ কিছু কাগজপত্র, দলিল আর একটা কাপরের গোছা রাখা। পায়েল কাপড়ের গোছাটা টেনে বের করে।
কোনমতে ভাজ করা কয়েকটি শাড়ি একসাথে রাখা। পায়েল শাড়িগুলো হাতরে বের করে একটা পায়েল। একদৃষ্টিতে পায়েলটার দিকে তাকিয়ে থাকে ও। রেহানার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, মা পায়েলটা তোমার?
রেহানা মাথা নাড়ে।
তাহলে কার?
রেহানা চুপ করে থাকে।
পায়েলের চোখ চক চক করছে। ধীরে ধীরে পায়েল বলে, এগুলো আমার মায়ের শাড়ি। এটা আমার মায়ের পায়েল। তুমি আমার মা নও, মা। রেহানা পায়েলের দিকে তাকায়।
তাঁর চোখে মুখে আতঙ্ক। পায়েলটা বুকে জরিয়ে ধরে হঠৎ-ই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে পায়েল।
১০।
আতাউর সাহেব নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছেন। তাঁর নিজের মেয়েই যখন সব জেনে গেছে, মেয়ের কাছে ঘৃণা পাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।
আতাউর সাহেব ডাবল খুনের আসামী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রসুমিয়া পালিয়েছে। রসুমিয়াকে পুলিশ তাঁকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। রসুর বউয়ের সাক্ষীতে মুক্তি পেয়েছে কাজল। গ্রামে চলে যাওয়ার সীদ্ধান্ত সে পাল্টায় নি। তবে পায়েলকে সাথে নেওয়ার সীদ্ধান্ত নতুন করে যোগ হল।
কিন্তু ব্যাপারটা মুশকিলের পর্যায়ে ফেলে দিল রবি ও কুসুম। তারা তাদের বুবুকে যেতে দিতে চাইছে না। রীতিমত কান্নাকাটির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে বাড়িতে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন রেহানা। কুসুম ও রবি মাকে নিজেদের দলে পেয়ে মহা খুশি।
কুসুম ভাবল এবার বুঝি মা সত্যি-ই বুবুর সাথে ভাল মানুষ হইয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।
। । শেষ। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।