বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমসাময়িক অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন গোলাম মাওলা রনি। পাঠকদের জন্য ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো:
উপাধীটি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য। কিন্তু লেখাটির বিষয়বস্তু বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য। আমার মনে হয় ইদানিংকালের কর্মকান্ডে বঙ্গবন্ধু কন্যা তার পূর্বেকার লৌহ মানবীর খেতাবটি হারিয়ে ফেলেছেন নিত্য নতুন প্রাপ্তি আর প্রক্রিয়ার কারনে। রাজনীতিতে লৌহমানবী বলতে সারা বিশ্বে দুইজন রমনীকেই বুঝায়- মার্গারেট থেচার এবং গোল্ড মায়ার।
যে কারনে তারা লৌহ মানবী খেতাব পেয়েছেন তার চেয়েও কঠিন কঠিন কাজ করার জন্য দেশবাসী শেখ হাসিনাকে বহুদিন যাবৎ লৌহ মানবী বলে আসছিলো। বাংলাদেশ গরীব দেশ। বিশ্বের নামকরা ধনী রাষ্ট্রগুলো এখনো আমাদেরকে ত্চ্ছু তাচ্ছিল্য করে এবং অনেকে আবার এমন ভাব দেখায় যে, দেশটির নাম বোধ হয় প্রথম শুনলো। তাই বঙ্গবন্ধু কন্যার লৌহ মানবী খেতাবটি আন্তর্জাতিকতা পায়নি। তাতে কি? আমরা তো বুঝেছি তিনি কে! তিনি যে সম্প্রতি তাঁর চারিত্রিক কঠোরতা আর দৃঢ়তার জন্য লোহার গুনাবলীর উপরে স্থান নিয়ে হীরকে পরিনত হয়েছেন সেটা অন্য কেহ টের না পেলেও সাধারণ ভেতো বাঙ্গালী টের পেয়েছে হাড়ে হাড়ে।
প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু কন্যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে বিএনপি নেত্রী মনে হয় একেবারেই বেখেয়াল। আর এ কারনেই আমার এই লেখার বিষয়বস্তু লিখিত হয়েছে শহীদ জায়া বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে। সম্মানীত পাঠক /পাঠিকা প্রশ্ন করতে পারেন তুমি কেহে বাপু! কি দরকার তোমার এসব করে। আমি বলি হা অবশ্যই দরকার আছে। কারন রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে প্রজারা সব মারা পড়ে।
দুই নেত্রীর যুদ্ধে আমরা যে সব মরতে বসেছি! তাই তারা যদি একে অপরকে বুঝে এবং একে অপরের শক্তি ও কৌশল অনুধাবন করে যুদ্ধে নামেন তবে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে এবং ফলাফল লাভ করা যাবে দ্রুত। আর একারনেই নাদান বান্দা নাখান্দার মতো হীরক মানবীর বৈশিষ্ট বর্ননা করছে।
হীরক মানবীর বৈশিষ্ট বলার আগে হীরক সম্পর্কে কিছু বলে নেই। হীরকের ইংরেজী প্রতিশব্দ ডায়মন্ড। এটি আবার এসেছে গ্রীক শব্দ এ্যাডামাস ও ডামাও থেকে- যার প্রতিশব্ধ যথাক্রমে- যা ভাঙ্গা যায় না এবং আমি অতিরিক্ত ক্ষমতা সম্পন্ন।
সাধারন লোহার চাইতে প্রায় একশ গুন শক্ত হীরক প্রকৃতির এক বিস্বয়কর সৃষ্টি। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ভূ অভ্যন্তরে ১৪০ কি.মি. থেকে ১৭০ কি.মি. দুরত্বে অন্যান্য গলিতও উত্তপ্ত লাভার সঙ্গে হীরকদের বসবাস। মূলত কার্বন জাতীয় পদার্থের সঙ্গেই এরা খায় খাতির করে বেশি এবং কার্বনের সঙ্গেই মিলে মিশে থাকে। ম্যাগমার মাধ্যমে ভূ-অভ্যন্তর থেকে এদেরকে টেনে আনতে হয়। হীরকরা কিন্তু বয়সেও বেশ বয়োবৃদ্ধ।
তাদের গড় বয়স একশ কোটি বছর থেকে ৩৩০ কোটি বছর পর্যন্ত।
এখন আপনি উপরের বৈশিষ্ট থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যার কিছু বৈশিষ্ট মিলিয়ে নিতে পারেন। গত পাঁচটি বছর আমরা তার যেসব কথাবার্তা শুনেছি এবং কর্মকান্ড দেখেছি তাতে বিরোধী পক্ষের জন্য কতগুলি স্পষ্ট মেসেজ ছিলো। বিরোধীরা হয় সে মেসেজ বুঝতে পারেনি নয়তো গর্বভরে অবজ্ঞা করেছেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে- এখন গালে হাত দিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে- আসলে কি করা যায়! বা আদৌ কিছু করা যাবে কি?
সাম্প্রতিক কালের যৌথ বাহিনীর অভিযান, কয়েকটি লাশ পাওয়ার ঘটনা, ইনকিলাব বন্ধ এবং বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে দেয়ার মধ্যে কোন যোগসূত্রের সন্ধান পেয়েছেন কি কেউ? আমি যতদূর জানি সরকারের সাম্প্রতিক কর্মে বিরোধী পক্ষ ভীষন ভয় পেয়ে গেছেন।
তারা এখণ যুগোপযোগী কর্মপন্থা অবলম্বনের পরিবর্তে ধর্ম কর্মে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। মুসলমানরা সকালে সুরা ইয়াসিন আর রাতে সুরা মূলক পড়ে দুনিয়া আখেরাতে ভয় থেকে বাঁচতে চাচ্ছে। তারা মনে করছে একমাত্র আসমানি সাহায্য ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই। নরম মনের মুসুল্লীরা করুন সুরে সুরায়ে ফীল পড়ে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আবাবিল পাখির খোঁজ করে।
মুসল্লীদের অবশ্য দোষও নেই।
তারা সরকারকে প্রবল পরাক্রান্ত ভাবছে। সরকারের কর্ম কৌশল কিংবা শক্তিমত্তার সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাই রনে ভঙ্গ দিয়ে তারা তাদের মাল সামানা নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে চাচ্ছে ঠিক যেভাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন মহানবী (সঃ) এর দাদা আব্দুল মোত্তালীব। এই ঘটনাতো বেশী দিনের পুরানোও না। মাত্র ১৪০০ বছর আগেকার একটি ঐতিহাসিক এবং ঐশী উপাখ্যান।
ঘটে ছিলো মক্কা নগরীতে; বায়তুল্লাহ অর্থাৎ কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে।
সবাই জানেন সেই ঘটনা, তবুও বলছি। সনটি ছিলো ৫৭০ বা ৫৬৯ খ্রীষ্টাব্দ। ইয়ামেনের শাসক ছিলেন আবরাহা। বাদশাহ আবরাহা ছিলেন আবার ইথিওপিয়ার সম্রাট আকসামের অধীন এ্কজন গভর্নর।
অন্যদিকে সম্রাট আকসাম আনুগত্য করতেন বায়জান্টাইন সম্রাটের; মানে রোমান সম্রাটের - যারা সবাই ছিলেন খ্রীষ্টান ধর্মের অনুসারী। মহান রোমান সম্রাট কন্সটাটাইন দি গ্রেট ৩০৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ শে জুলাই সিংহাসনে আরোহনের সময় রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে খ্রীষ্টবাদকে ঘোষনা করতে বাধ্য হন। এর পর থেকে রোমান সাম্রাজ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে একদম সহ্য করা হতো না।
রোমান সম্রাটের অধীন আবরাহা বিভিন্ন কারনে মক্কার কাবা শরীফকে ধ্বংশ করতে চাইলেন। এর পেছনে বানিজ্যিক কারন ছিলো কিন্তু ধর্মীয় কারনই বেশী।
৫৬৯ বা ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর আরবের ইয়ামেন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাহিনী নিয়ে আবরাহা কাবা শরীফ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে মক্কায় সৈন্য সমাবেশ করেন। এই সৈন্যদের সাথে একটি হাতিও ছিল। তাই এই বাহিনীকে বলা হয় হস্তী বাহিনী। আবরাহা যখন মক্কা আক্রমন করলেন তখন আল্লার রাসুল ছিলেন মাতৃগর্ভে। সুরা ফিলে আল্লাহ তার রাসুলকে উদ্দেশ্য করে বলেন হে নবী! আপনি কি দেখেননি, আপনার রব হস্তী বাহিনীর সাথে কি ব্যবহার করলেন?
আবরাহার প্রতিপক্ষ মক্কার কুরাইশরা ছিলো অতিশয় দরিদ্র এবং দুর্বল।
তাদের নেতা ছিলেন হুজুর (সঃ) এর দাদা বয়োবৃদ্ধ আব্দুল মোত্তালিব। তিনি আবরাহার আগমনী সংবাদে বিচলিত হয়ে মক্কাবাসীদেরকে সমবেত করলেন। তারপর বললেন বিশাল এই বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোন শক্তি ও সামর্থ আমাদের নেই। আবরাহার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতাও নেই। সে আল্লাহ ও তাঁর ঘরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করছে।
এরপর তিনি আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন- হে আল্লাহ! তোমার ঘর রক্ষা করতে আমরা অপারগ। তাই তোমার ঘর তোমার জিম্মায় দিয়ে আমরা পরিবার পরিজন এবং গবাদি পশু নিয়ে নিকটস্ত পাহাড়ে চলে গেলাম।
আবরাহা কয়েকদিন অপেক্ষার পর যুদ্ধ করার জন্য কোন প্রতিপক্ষ পেলেন না। ক্রোধে আত্মহারা হয়ে তিনি একতরফা ভাবে কাবা শরীফ ধ্বংশ করতে গেলেন। আর তখনই চলে এলো আল্লাহর সাহায্য ’আবাবিল পাখি’।
বর্তমান জমনায় আল্লাহ কিভাবে সাহায্য করবেন তা তিনিই ভালো জানেন। কিন্তু যে নির্ভরতা ও সততা নিয়ে আব্দুল মোত্তালিব আল্লাহর সাহায্য চেয়েছিলেন সেই রকমভাবে সরকার বিরোধিরা পারছে কিনা তা আমার জানা নেই।
যে কোন যুদ্ধে নামার পূর্বে অবশ্যই সেনাপতিকে পূর্বাপর অনেক ঘটনাই বিবেচনাতে আনতে হয়। পরিকল্পনাহীন যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস কেউ বলতে পারবেনা। যেখানে বঙ্গবন্ধু কন্যা ভারতের মত সুবিশাল প্রতিবেশী এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন, দলের সব বাঘা বাঘা নেতা তার কথায় লেফ্ট রাইট করে, সামরিক - বেসামরিক প্রশাসনের আনুগত্য সীমাহীন এবং অর্থ বানিজ্য, সুশীল - কুশিল সবই তার করায়ত্বে সেখানে বিরোধী পক্ষের কর্মকৌশল কেবল ফাঁকা বুলি হলে চলবেনা।
বিরোধীদের প্রতিটি কর্মসূচী, বক্তব্য এবং কৌশল সরকারী দলের তুলনায় কয়েকগুন শক্তিশালী এবং আকর্ষনীয় না হলে কোন ফল আসবেনা। কেবল আমাদের মতো হাদারাম জনগনই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আমি মনে করি বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের খুব ভালো করে পড়া উচিত বিশ্বের নামকরা সব পট পরিবর্তন ও জয় পরাজয়ের ইতিহাস। কারন তাদের প্রতিপক্ষ এই কর্মটি করেন খুব মনোযোগ সহকারে। তাদের জানা উচিত গাউগামেলার যুদ্ধ সম্পর্কে।
আলেকজান্ডার দি গ্রেট ৩৩১ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে কিভাবে মাত্র ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে সুবিখ্যাত পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় দারায়ুসকে তার ২ লাখ ৮০ হাজার বাহিনী সমেত পরাজিত করেছিলেন ?
আরো উদাহরন আছে। ২০৭ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে কার্থেজ সেনাপতি মহাবীর হানিবলের ভাই হাসদ্রুবাল মেটাউরাসের যুদ্ধে সুবিশাল রোমান বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন যাকে ইতিহাস দ্বিতীয় পিউনিখের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাতি দিয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধটি করেছিলেন হানিবল নিজে-২১৬ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের ২রা আগষ্ট তারিখে। যুদ্ধের নাম ব্যাটল অব ক্যাননাই। মাত্র ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে হানিবল পিরেনিজ ও আল্পস পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে দক্ষিন ইতালীতে ঢোকে দেখেন মাত্র ২৫০০০ সৈন্য অবশিষ্ট আছে।
বাকী সব মারা গেছে। সৈন্যরা দাবী তুললো ফিরে যাবার জন্য। হানিবল সৈন্য সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে বললেন- যদি এই পরিবেশে পুনরায় ফিরে যাই তাহলে বাকী ২৫০০০ ও মারা পড়বো নির্ঘাত; তাই লড়াই করে মরাই শ্রেয়।
সৈন্যরা হানিবলের বক্তব্যে প্রান ফিরে পেল। স্থানীয় ছোট খাটো কয়েকটি যুদ্ধে জয় লাভ করে মনোবল চাঙ্গা করলো।
তারপর বিভিন্ন উপজাতির আরো ২৫০০০ সৈন্যকে ভাড়া হিসেবে সংগ্রহ করা হলো। এরপর রোমান সেনাপতি গাইয়াস টোরনটিয়াস ডেরোর ৮০ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ৭৫ হাজার রোমান সৈন্য মারা পড়লো। বাকী পাঁচ হাজার মাত্র পালাতে পারলো। জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত বিজয় ব্যাটল অব অ্যালেসিয়ার ইতিহাসও সবাই এখনো অধ্যয়ন করেন।
৫২ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ফ্রান্সের গ্যালিক উপজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে কৌশলে জয়লাভ করেছেন তাতে সামরিক শক্তির তুলনায় মানুষের নেতৃত্বের অসাধারন গুনাবলীর মহত্বই ফুটে উঠেছে।
কাজেই সরকার বিরোধীগন যদি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে শিক্ষিত না হয়ে অকৌশলের আন্দোলন করেন তবে এ জাতি নিঃশেষ হতে বেশী সময় লাগবে না। তার চেয়ে বরং আমাদেরকে আল্লাহর হাতে সপে দিয়ে আপনারা ধর্ম-কর্ম করুন-আর আমরা এস্মে আজম সহ আবাবিল পাখির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।