আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গান খেকো - শ্রোতা চোথা ১

জোর হোক শুধু গলার আওয়াজ, গায়ের জোরটা তোলাই থাকুক


1. শাস্ত্রিয় সঙ্গীত (Classical Music)

সুরের মুল উৎস প্রকৃতি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকেই বিচিত্র সব সঙ্গীতের সৃষ্টি। বড় গোলাম আলি খাঁ সাহেব বলতেন “সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সব লোকালয়ে সুর ভাগ করে দিয়েছেন, প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের (element) মত করেই। কোথাও নদী দিয়েছেন, মরুভূমি দিয়েছেন, পাহাড় দিয়েছেন, দীর্ঘ বসন্ত দিয়েছেন, দীর্ঘ খরা দিয়েছেন। ওভাবেই ভাগ করে দিয়েছেন – নদীর, খরা, মরু, পাহাড়ের সুর”।

এসব সুর একেকজন দক্ষ ওস্তাদদের হাতে পড়ে, ক্রমশ সুবিন্যস্ত একটি কাঠামোর রূপ নিয়েছে। তারা সেই সুরের কাঠামোর মধ্যে চমৎকার সব চলন (phrase) তৈরি করে, ওই সুরকে আরও সুন্দর, সুশোভিত হয়ে করে দিয়ে গেছেন। সেই সংকলনগুলো কালেকালে হয়ে উঠেছে শাস্ত্র। আমাদের আজকের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। তাই আপনি যদি রাগ পাহাড়ি তে কোন গান/বাজনা (composition) শোনেন, রাগের নাম না জানলেও, বলতে পারবেন এটা পাহাড়ি গান।

অথবা যদি কখনও পাহাড়ি গান না শুনে থাকেন, তারপরেও পাহাড় এলাকায় বসে, রাগ পাহাড়ি তে যেকোনো গান/বাজনা শুনতে ভালবাসবেন।

প্রকৃতি ছাড়া, সুরের আর একটি বড় উৎস হচ্ছে মানুষের মন। স্থান, কাল, ঘটনা ভেদে আপনার মন যখন যে স্তরে থাকবে, আপনার কথাবার্তাতে সেই স্তরের ভাব-আবেগ (mood) প্রকাশ পাবে। তেমনিভাবে যাদের সুর আসে, তারা গলা খুললেই, ওই সময়ের ভাবাবেগ ধরা পড়বে। সঙ্গীতজ্ঞরা প্রকৃতির সুরের মতোকরে একইভাবে, মানুষের বিভিন্ন ধরনের ভাবাবেগকে, ভিন্ন ভিন্ন সুরের কাঠামোতে বেঁধে দিয়ে গেছেন।

সেগুলোও কালেকালে আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অংশ হয়েছে।

পরবর্তী ওস্তাদ/পণ্ডিতেরা সেসব কাঠামোগুলো নিয়ে আরও গবেষণা করেছেন। কিভাবে গাইলে নিখুঁতভাবে রাগের ছবিটি ধরা দেবে, তার রূপরেখা উন্নয়ন করেছেন। এই রাগই আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মুল ভিত্তি। বংশপরম্পরায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত লেখা-পড়ার জন্য গ্রামার তৈরি করা হয়েছে।

রাগ, ঠাট, জাতি, স্কেল - বিভিন্ন কারিগরি নাম দেয়া হয়েছে। এসবের সর্বশেষ কারিগরি রুপী আমাদের আজকের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। তাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কোন আলাদা করে আবিষ্কার করা নতুন বিষয় না। বরং আমাদের আশপাশের প্রকৃতি আর জীবনআচারের মধ্যে ফুটে ওঠা বিভিন্ন ভাবাবেগের শ্রেণীবদ্ধ এবং শুদ্ধ সঙ্গীতরূপ।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে, একটি নির্দিষ্ট ভাবাবেগ কে স্পষ্টতরে ফুটিয়ে তোলার জন্য, যে নির্দিষ্ট সুরের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই বলে রাগ (*)।

ভিন্ন ভিন্ন স্থান,কাল ও ভাবের জন্য স্বতন্ত্র রাগ।

যারা শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তারা স্থান-কাল মাথায় রেখে, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ভাবাবেগ কে প্রকাশের জন্য, শুদ্ধরুপে যেকোনো একটি রাগ গান/বাজান। এ ধরনের সঙ্গীতে শুদ্ধতার বিষয়টা খুব কঠোরতার সাথে নিশ্চিত করা হয়। শোনার বৈচিত্র্যের জন্য বা অন্য কোন কারণে নিয়ম ভাঙ্গা যায় না। এ ধরনের গানবাজনার অনুষ্ঠানকে আমরা - শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান বলি।



শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি, উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত (semi classical music) নামে একটি ধারা আছে। এই ধারা নির্দিষ্ট রাগের উপরে ভিত্তি করে, শ্রবণবৈচিত্র্য তৈরির জন্য অনেক রকম অলংকরণ (ornamentation) করা হয়। বিভিন্ন ধরনের অলঙ্করণের কারণে, মাঝে মধ্যে সামান্য রাগ ভ্রষ্ট হতে পারে। উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিয়মকানুন শিথিল হলেও, রাগের মুল মেজাজটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। শুদ্ধ গানের শ্রোতারা হালকা মেজাজে এধরনের সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করেন।

এই ধারা শুদ্ধ গানের শ্রোতাদের পাশাপাশি সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যেও জনপ্রিয়।

আমাদের প্রচলিত সাধারণ গানগুলোও কিন্তু রাগের বাইরে নয়। গানের অংশগুলোকে আলাদা আলাদা করে ভেঙ্গে নিয়ে, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ওই অংশগুলো কোন একটি রাগ চলনের সাথে মিলে যাবে। কিন্তু যেহেতু বহু রাগের অপরিমিত মিলমিশ হয় এবং কোন রাগের মুল মেজাজ ধরে রাখা হয় না, তাই এগেুলোকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাতারে ফেলা যায় না। এ ধরনের গানকে শাস্ত্র অনুযায়ী বলা হয় “লঘু সঙ্গীত”।



2. ভারতিয় শাস্ত্রিয় সঙ্গীত
ভারতবর্ষে দুই ধরনের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচলন আছে। ১) হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত (Hindustani classical বা North Indian style of Indian classical music) বা হিন্দুস্থানি সিস্টেম ২) কার্নাটিক সিস্টেম (Carnatic music বা South Indian style of Indian classical music)। দুটি ব্যবস্থাই স্বতন্ত্র এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ।

কার্নাটিক সিস্টেম প্রচলিত আছে মূলত দক্ষিণ ভারতের - তামিল নাড়ু, কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক রাজ্যে। ওখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবারে, পারিবারিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও ধর্মের অংশ হিসেবে চর্চা হয়।



হিন্দুস্থানি সঙ্গীত রীতি মূলত মুঘলদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ভারত ছাড়াও – বাংলাদেশে, নেপাল, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে প্রচলিত হয়েছে। আমাদের দেশের সব ধরনের গানবাজনা ওই রীতিতেই হয়। আমরা আমাদের এই নোটটি তৈরি করেছি হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রীতি মেনে।

3. হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত
হিন্দুস্থানি সিস্টেম বা হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আলাদা আলাদা ভাবাবেগের প্রকাশ করা হয় স্বতন্ত্র রাগ দিয়ে। রাগগুলো যথারীতি ঋতু, সময় এবং মেজাজ ভিত্তিক।

কণ্ঠের পাশাপাশি হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যন্ত্র সঙ্গীতে সমান জনপ্রিয়। তানপুরা তে সুর ধরে রেখে, তবলা বা পাখোয়াজকে তালবাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করে পরিবেশন করা হয়।

এই রাগগুলোতে বিভিন্ন জনরার সঙ্গীতগুলো গাওয়া/বাজানো হয়। রাগের শুদ্ধতা বজায় রেখে – ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, সাদরা, তারানা রীতির (genre) সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে উপশাস্ত্রীয় ধারাগুলোর মধ্যে – গজল, ঠুমরী, কাওয়ালি, টপ্পা, কাজরি, হরি, সুফি রীতিগুলো জনপ্রিয়।

তাছাড়া উপশাস্ত্রীয় ধারায় আমাদের দেশে – রবীন্দ্র, নজরুল, কীর্তন গান রয়েছে। একসময় উপশাস্ত্রীয় ধারার অসখ্য প্লেব্যাক এবং আধুনিক গানও হয়েছে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।