আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই পার্লিয়া নয় যে গত পরশু বেরিয়ে গিয়েছিল

প্রকীর্ণ করি অর্ণে আলোক বিসর্গী বীথিকায়

অস্ত্রপোচার আর কোনদিন না ভোলার মত যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে ধরে যে মেয়েটি আগামীকাল ঘরে ফিরবে, সে কিন্তু সেই পার্লিয়া নয় যে গত পরশু বেরিয়ে গিয়েছিল। নতুন মেয়েটির দেহ হতে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে থাকা কিছু গ্ল্যাণ্ড কেটে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তার আগের শরীরটি আর হুবহু আগের মতন নেই। তাতে একচিলতে শূন্যতা ঢুকে পড়েছে।
গতকাল সকালের কথা।

পার্লিয়ারা ন’টায় হাসপাতালে পৌঁছে গেলেও আমার পৌঁছুতে দুপুর হয়ে গিয়েছিলো। আমার ওপর রাগ করে থাকা সত্ত্বেও দেখামাত্র সব ভুলে গেলো মেয়েটা। হাসপাতালের ঝকঝকে মেঝেতে ঠিক সংখ্যারেখার মতো ঋণাত্মক অক্ষে ঋণাত্মক ছায়া ফেলে, পাখির মতো হাঁটছিলো সে, আমায় দেখে হাসলো। এ কদরে জানিয়ে রাখছি, পৃথিবীতে এ হাসিটুকু শুধু সেই হাসতে পারে।
হাসপাতালের বারান্দায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করলাম, পার্লই বেশি বলছিলো।

ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ অস্থিরতা বোধ করছিলো। সেটাই কী স্বাভাবিক ছিলো না? প্রথমবারের মতো অস্ত্রপোচার হবে তার অসুঁচবিদ্ধ শরীরে, অনুভূতির শেষ কণাটিকেও টুকে নিয়ে লুকিয়ে রাখবে কোন মাদক রাসায়নিক- কত জিজ্ঞাসা তার মনে। আমি তাকে বললাম,
‘অচেতন হবার মুহূর্তটা যখন ক্রমশ ঘনিয়ে আসতে থাকে, তখন মানুষ বিচিত্র সব রং দেখে, অভিনব সব স্বপ্ন দেখে। তুমি কিন্তু সেসব মনে রেখো। ’
সে পুলকিত হয়ে প্রতিশ্রুতি দিলো, মনে রাখবে।

আমার কথাগুলো সে বিশ্বাস করেছিলো।
ছ’টায় শুরু হবার কথা ছিলো যে অপারেশন, তা শুরু হতে পারলো রাত দশটা দশ মিনিটে; এতোটাই বিলম্ব ঘটিয়ে ডাক্তার মশায় এলেন। মানতেই হবে তিনিও একজন মানুষ, সুবিধা-অসুবিধা, রোগ-শোক, ব্যাক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজ, পিছিয়ে দেবার মতো মানসিক ক্লান্তি- এসব তারও আছে। কিন্তু সকাল ন’টা থেকে যে মেয়েটা এক ফোঁটা জলও মুখে না দিয়ে অপেক্ষা করে আছে সন্ধ্যা ছ’টার জন্যে, সে ছ’টা যখন আসে রাত দশটায়, সেখানেই শেষ নয়, ডাক্তার যখন ক্রমশ ভিড় বেড়ে চলা তার চেম্বারের সব ক’জন রোগী দেখে তারপর স্ক্যাজুল পেরোনো অস্ত্রপোচারটুকু করতে আসেন, তখন ক্ষুধা তৃষ্ণা আর শরীরযাতনায় কাতর অপেক্ষমানা মেয়েটির মুখ চেয়ে ডাক্তারটিকে ভীষণ স্বেচ্ছাচারী মনে হয়, আর মনের গভীরে ক্ষতি করবার ইচ্ছা জেগে ওঠে। মনটা ভীষণ স্বার্থপর কিনা বলতে পারিনা।


ওটিতে নেবার পূর্বে তাকে কিছুক্ষণ পোস্ট অপারেটিভ রুমে রাখা হবে। সেখানে নেবার পূর্বে স্যালাইনের স্বচ্ছতার সঙ্গে তাকে জুড়ে দেয়া হলো। আমি বুঝতে পারিনা চিরকাল সুঁই ফুটিয়ে এসেও, কেন সেবিকারা কখনই কাজটা মসৃণভাবে করতে পারে না। চিরঅদক্ষ চিরঅনভ্যস্ত হাতের অকৌশলে সুঁচ বেঁধালো ওরা পার্লিয়ার ধমনীতে, আর ঠিক সে মুহূর্তটিতেই কৌতুহলী চড়ুইটির মনে ভীতির যাত্রা শুরু করিয়ে দিলো।
অস্ত্রপোচার শুরু হল।

বন্ধ অস্বচ্ছ দরজার এপাশে আমার কণ্ঠনালী হলো মরুভূমি। কত শত মন্দ চিন্তা লাথি মেরে বারবার সরিয়ে দিলাম, কিন্তু আমার কটিতে সেসব যেন ছিলো সহনক্ষম সুতো দিয়ে বাঁধা। যতোই শক্তি সহকারে সরিয়ে দিই ততই শক্তি সঞ্চয় করে এসে আমার তলপেটে, বুকে পাল্টা আঘাত হানে। আমার এতোই তেষ্টা পাচ্ছিলো যে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীতে বুঝি অতো জল নেই। আমি রক্তে ক্রমাগত নিকোটিন মেশালাম, কোন লাভ হলো না।


দু’ ঘন্টা পর অস্ত্রপোচার শেষ হলো। ও.টি থেকে পার্লিয়ার অচেতন দেহটি বের করে পোস্ট অপারেটিভে রাখা হলো।
যেন একশ বছর পর পর দেখতে পেলাম আমার মুক্তোটাকে, যে একই সাথে শাদা ও গোলাপি। চোখ বুজে শুয়ে আছে। দুটি হাতের মোহনা পুরু ব্যাণ্ডেজে মোড়া।

শাদা গজ ছাপিয়ে একটা হলুদাভ রসায়নিক ত্বকে ছড়িয়ে পড়েছে। মুখ ফ্যাকাশে রক্তশূন্য, ঠোঁটদুটো আনারফলের মতো লাল।
হঠাৎ তার চোখের পাতা জোড়া কাঁপতে কাঁপতে খুলে গেলো। কিন্তু সে কিছু দেখতে পেল কি? আমি জানি লেন্স ছাড়া সে খুব অল্পই দেখে। তার লেন্সহীন চোখে দেখা পৃথিবী শুধু কিছু বিমূর্ত আলোছায়ার নড়চড়।

আমি ছিলাম তার শিয়রের কাছে। অস্ফুটে তাকে ডেকে চলেছিলাম। আমার ডাক শুনেই হয়তো, সে আপন শিয়রের পানে তাকালো। এমন অপূর্ব ভেজা একজোড়া রক্তাভ চোখ আমি আর কোনদিন দেখিনি। সাত স্বর্গের মায়া পাপড়িতে ধরে রাতের শিশিরে ভিজে ভিজে দুলছে যেন একজোড়া রক্তজবা ফুল।


সময় গড়াল। নার্স প্যাথেড্রিনের সিরিঞ্জের পর সিরিঞ্জ পুশ করে চললো, কিন্তু কিছুই কোন কাজে এলো না। অমানুষিক যন্ত্রণায় তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। তার চাপা বুকচেরা যন্ত্রণাকাতর ধ্বনি আর এলোমেলো প্রলাপের কোলাজ আমার চোখে জল নিয়ে এলো। হয়ত এখনই সে দেখছে সেই বিচিত্র রংগুলো, আর রহস্যময় স্বপ্ননিচয়, যার কথা আমি তাকে বলেছিলাম।

কিন্তু সেসব মনে রাখবার বিপরীতে স্মৃতির কর্মক্ষমতা এখন সর্বোচ্চ মাত্রায় ট্রানজিয়েন্ট; ক্ষণস্থায়ী। কষ্টপ্রক্ষালিত অভিজ্ঞতার স্মৃতি, যা মস্তিষ্ক এ মুহূর্তে স্বপ্নরূপে গল্প তৈরি করে জমা করে রাখছে। আমি দেখলাম, সকালে আমাকে দেখে খুশীতে লাফিয়ে ওঠা ছোট্ট চড়ুইটি বিছানায় ব্যাকুল ভাবে ছটফট করছে, প্রতিকারহীন। কেউ যেন তার ডানার নিচে ভয়াল ছোরার ধারালো দিকটা চেপে ধরে কাঁটাতার দিয়ে কষে বেঁধে তাকে ভীষণভাবে তাড়া করছে, বাধ্য করছে উড়ে যেতে। যতক্ষণ ছিলাম শুধু দেখতে পেলাম পাখিটা বারবার বারবার উড়তে চাইলো আর মুখ থুবড়ে থুবড়ে পড়লো বিছানায়।

ছুরি আর কাঁটাতারের ধারালো আঘাতে আঘাতে ডানাকাটা রক্তে ভিজে ভিজে গেলো শুভ্র বিছানাটা।
আমি সারা রাত জুড়ে তার শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। এজন্যে আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করবো না। আর আমি চিরকাল মনে রেখে দেবো একটি ছবি : আমি যাবার বেলায় পার্লিয়া আয়ত চোখজোড়া মেলে তার শিয়রের কাছে আমাকে খুঁজে বেড়ালো, কিন্তু পেলো না, আমি তখন দরজার কাছে। তারপর ব্যর্থ অবসন্ন চোখজোড়া বন্ধ করতেই রূপালি মুক্তোর মত দু’ ফোঁটা জল, টপাটপ গড়িয়ে পড়লো চোখের কোণ গলে।

শুভ্র বালিশটা ভিজিয়ে দিলো।
আমি নিচে আরও বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি যাব না, কিছুতেই যাব না। কিন্তু আমাকে যেতে হয়েছিলো।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।