রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকালীন স্নাতকোত্তর কোর্স বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গতকাল যৌথভাবে হামলা চালিয়েছে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। তাদের দফায় দফায় আক্রমণ, ককটেল ও গুলিতে আট সাংবাদিকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। আহতদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তৌহিদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
শিক্ষার্থীদের আজ সকাল ৮টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে ছাত্রলীগ ও পুলিশকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে অভিযোগ তুলে কোনোভাবেই হল ছেড়ে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা আগের তিন দফাসহ হামলাকারীদের শাস্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহতদের চিকিৎসার ভার নেওয়ার পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমবারের মতো সহিংস রূপে হাজির হলো।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সকালে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো ধর্মঘট শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
তারা পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ক্যাম্পাস ও প্রশাসন ভবন ঘেরাও করে সমাবেশ শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর পাশে দুটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দলীয় টেন্ট থেকে একটি মিছিল নিয়ে সমাবেশের ভেতর ঢুকে যান ছাত্রলীগ নেতারা। আন্দোলনকারীরা এ সময় উঠে গিয়ে মিছিলের জন্য জায়গা করে দেন। কিন্তু মিছিলটি সমাবেশস্থল অতিক্রম করে কিছু দূর ছাত্রলীগ-পুলিশের যৌথ হামলা
[প্রথম পৃষ্ঠার পর] যাওয়ার পর আকস্মিকভাবে ঘুরে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়।
তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে প্রথমে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরে গুলি ছোড়ে। ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত সালাম, মোস্তাকিম বিল্লা, ফয়সাল আহম্মেদ রুনুকে এ সময় গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সমাবেশের পাশে লিচুতলায় আগে থেকে অবস্থান করা পুলিশ সদস্যরাও একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস শেল ছোড়েন। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। হামলায় অন্তত ২৫ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
আহত হয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের আটজন সাংবাদিকও।
হামলার পর ছত্রভঙ্গ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিলে সেখানেও আরেক দফা হামলা চালান ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া পুলিশের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে আবাসিক হলগুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা মাদার বখশ হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। ছাত্রলীগ ও পুলিশ এ সময় তৃতীয় দফায় হামলা চালায়।
শিক্ষার্থীরা আবারও ছত্রভঙ্গ হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাদার বখশ হলের ভেতর ঢুকে যান। পুলিশ হল দুটি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে হলে ঢুকে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনার প্রতিবাদে বেলা ৩টার দিকে আবারও জড়ো হয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করলে রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। পরে বিকাল থেকে হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারসহ অন্যান্য দাবিতে পৃথক বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্লোগান দিতে থাকেন ছাত্রীহলসহ প্রতিটি হলের শিক্ষার্থীরা।
তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম রুবেল বলেন, 'শিক্ষার্থীদের সমাবেশ থেকে ছাত্রলীগের শান্তিপূর্ণ মিছিলে জামায়াত-শিবির হামলা চালিয়েছে। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গুরুতর আহত হয়ে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ' ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর বর্ধিত ফি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বেলা আড়াইটার দিকে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সাংবাদিকদের ই-মেইলে পাঠিয়েছে জনসংযোগ দফতর।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দীনের সভাপতিত্বে তার বাসভবনে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা শুরু হয়। রাত পৌনে ৯টার দিকে প্রশাসন জানায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং আজ সকাল ৮টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপাচার্য বলেন, 'আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীর বিপক্ষে কখনো অ্যাকশনে যেতে পারি না। এ ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
' দিনভর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক। তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে আরও যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- রুবেল, অমিত গোস্বামী, তারিন, স্বপন, রাজিব, বিলকিস নাহার, আতিক, শোভন, সালমা, মায়া, আশুরা, রবিউল, পরাগ, আশিক, রাখি, সাজু, আবদুর রশিদ ও যুঁথি। আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম রাব্বানী, রুমি, নাজিম মৃধা, তমাল ফাহিম, জীবন ও মুন। সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি ও সাংবাদিক সমিতি।
সংগঠন দুটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিন সহকারী প্রক্টর হেলাল উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, জুলফিকার আলী ও মহানগর পূর্ব জোনের উপপুলিশ কমিশনার প্রলয় চিসিমকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আবাসিক হলগুলোতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ পুলিশের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বিপুলসংখ্যক আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে দুপুরে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিজিবি মোতায়েন করা হলেও পরে তা তুলে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে সান্ধ্যকালীন স্নাতকোত্তর কোর্স চালু এবং পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ফি দুই থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
আর আইন ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে আগে থেকেই সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। মঙ্গলবার থেকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও প্রশাসনিক ভবন ঘেরাওয়ের পর বৃহস্পতিবার থেকে ক্লাস বর্জন করে ধর্মঘট করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বর্ধিত ফি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। কিন্তু দাবিতে অনড় হাজার হাজার শিক্ষার্থী গতকাল সকালে ফের আন্দোলনে নামেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।