আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিন খন্ড



জুলাইচ (গ্রামের লোকেরা তাই বলে, আসলে জুয়েল আইচ) দেখান মানুষ দুভাগ করার খেলা। আব্দুর রহমান নাকি তিন চার টুকরো করে মানুষ আবার জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে!


আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি একটা গাছের নিচে।
গাছটা দাঁড়িয়ে আছে বাজার সড়কের মাঝখানে। গাছের দুপাশ দিয়ে যে রাস্তা, ওটা গেছে দনিয়া বাজার পর্যন্ত। সেজন্য রাস্তার নাম বাজার সড়ক।

গাছটা ঠিক কবে কে লাগিয়েছে, তার ইতিহাস জানেনা কেউ। তবে বোঝা যায়, সময়ের পর সময় বয়ে গেছে, থেকে গিয়েছে কেবল গাছটা। গাছের দর্শক বদলেছে যুগে যুগে।

গাছের প্রতি আমার এমন কোন টান নেই। তবে আজ শুক্রবার।

প্রতি শুক্রবার এই বিশাল বটবৃক্ষের নিচে আব্দুর রহমান খেলা দেখাতে আসে। তার বিচিত্র খেলা গোটা অঞ্চলে বিখ্যাত। সপ্তাহের সাত দিনই সে নানান যায়গায় খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। শুক্রবারে বসে এই দনিয়া বাজার বট গাছের নিচে। প্রায় প্রতিমাসেই নতুন কোন না কোন খেলা তার আইটেমে যোগ হয়।

খেলার মাঝে মাঝেই সে নানা ধরণের কবিরাজি ওষুধ, তাবিজ ইত্যাদি বিক্রি করে। সে ওষুধ ওই খেলার গুণেই কিনা কে জানে, তুমুল বিক্রি হয়!

সবাই আব্দুর রহমানকে যাদুকর বললেও ঝাঁকড়া চুলের দীর্ঘদেহি আব্দুর রহমান সবসময় নিজের কীর্তিকলাপকে খেলা বলতেই ভালবাসে। ইদানিং নাকি সে ভয়ংকর একটা খেলা দেখাচ্ছে। মানুষ কেটে ফেলার খেলা।

জুলাইচ (গ্রামের লোকেরা তাই বলে, আসলে জুয়েল আইচ) দেখান মানুষ দুভাগ করার খেলা।

আব্দুর রহমান নাকি তিন চার টুকরো করে মানুষ আবার জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে!
শেষ মজমায় সে সবাইকে বলে গেছে, স্কন্ধকাটার খেল দেখাবে সে। এই খেলা দেখাবার জন্য তাকে কামরুপ কামাখ্যার (!!) রানী অনুমতি দিয়েছে। শোনা যায়, কামরুপ কামাখ্যা বড় বিচিত্র স্থান। এবং শুধু নারীস্থান। কোন পুরুষ সে দেশে একবার গেলে নাকি আর আপন দেশে ফিরতে পারেনা।

ওখানকার কামোন্মত্ত নারীরা আজন্ম সেই পুরুষকে বন্দী করে রাখে ভোগের জন্য। তবে মাঝে মাঝে কারও প্রতি তাদের দয়া হলে সেই সৌভাগ্যবান পুরুষ প্রচন্ড অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আপনজনাদের কাছে ফিরে আসে। আব্দুর রহমান সেই সৌভাগ্যবানদের একজন!

দেখতে দেখতে বটগাছের নিচে ভিড় জমে গেল। আমার ছোটখাটো দেহ নিয়ে যত সময় গড়াচ্ছে, ততোই পিছে পড়ে যাচ্ছি। আজ এত ভিড় কেন কে যানে।

অন্যদিনও ভিড় থাকে, এতটা না। চারপাশে উঁকি ঝুকি মেরে দেখলাম, হুমায়ুন আর মিরাজুলও চলে এসেছে যাদু দেখতে! চোখে বিপুল আগ্রহ ফুটিয়ে বটগাছের গোড়ার দিকে চেয়ে আছে। যেখানটায় আব্দুর রহমানের আসন পাতা থাকে। জরি-শালমা লাগানো একটা আসনে আজকাল বসে যাদুকর। খেলা বেশির ভাগ সময় দেখায় তার তিনজন শিষ্য!

দেখতে দেখতে বেলা গড়াচ্ছে।

কিন্তু আব্দুর রহমানের টিকিও দেখা যাচ্ছেনা। মন খারাপ হয়ে গেল। আজ রিতিমত বাসায় না বলে নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে এই দুরের গ্রামে চলে এসেছি যাদু দেখতে। বাড়ি পৌঁছুলে মায়ের ধোলাই তো ফরজ হয়েই গিয়েছে এতক্ষণে! অথচ আব্দুর রহমানের দেখা মিলবেনা? আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি প্রায়, আব্দুর রহমান তার বিশাল দেহ আর ঝাঁকড়া চুল নিয়ে হাজির হল! অন্যদিন এসেই সে নানান রঙ্গ করে কথা বলে। আজ কোন কারণে তাকে খুব মনমরা লাগছে।

তবে দেরিতে পৌছুনোর কারণে সে ক্ষমা চাইলো সবার কাছে।

বেঁটেখাটো তিন সাগরেদ পাটি বিছিয়ে তাদের ছোট স্টেজ সাজিয়ে নিল মুহুর্তেই। সব সময়ের মত পল্টি আর ডিগবাজি খেয়ে খেলা শুরু করতেই, তুমুল হাততালির শব্দে কেঁপে উঠলো চারপাশ! পায়ালম্বা এবং লাল মখমলে ঢাকা একটা ছোট তক্তপোশের উপর সবচেয়ে বেঁটে সাগরেদটি শুয়ে পড়ল। বাকি দুজন তাকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল সাদা চাদর দিয়ে।
খানিক বাদে আব্দুর রহমান নিজেও অদৃশ্য হল তক্তোপোশের নিচে।

দুই সাগরেদ উন্মাদের মত তক্তোপোশের চারপাশ ঘিরে নাচতে লাগলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম শুয়ে থাকা লোকটি ধিরে ধিরে তিনখন্ড হয়ে যাচ্ছে। একটা মানব দেহের তিনটি খন্ড একটি আরেকটি থেকে সরে যাচ্ছে দূরে! আর ধবধবে সাদা চাদরের নিচটা ভেঁসে যাচ্ছে লাল রক্তে…

বাসায় ফিরলাম একরাশ বিস্ময় নিয়ে। এক মানুষ তিনটুকরো হয়ে আবার জোড়াও লেগে গেল! এও সম্ভব! মায়ের ধোলাই থেকে বাঁচতে সত্যি কথাটাই একটু ঘুরিয়ে বললাম। দনিয়া বাজার মসজিদে নামাজ পড়েছিলাম ওদিন আব্দুর রহমানের যাদু দেখার শেষে।



এই ঘটনা শৈশবের। তখন আমার স্বভাবই ছিল এমন। ঘুরে ঘুরে ফুটপাথের ক্যানভাসারদের কীর্তিকলাপ দেখা। বাজিকরদের আসর দেখলেই দাঁড়িয়ে যাওয়া মুগ্ধ চোখে। অনেকের অনেক রকম ম্যাজিকই তো দেখলাম এ জীবনে।

রাস্তার পাশে। টিভিতে। নিত্য দিনের ভুলে যাওয়া অজস্র মুহুর্তগুলোয়! তবে আব্দুর রহমানের মত অমন রহস্যময় কোন বাজিকরের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটেনি আজ পর্যন্ত। হয়তো আর কখনও হবেওনা।

কিছুদিন আগে গ্রামের এক ছেলের সাথে দেখা।

কথায় কথায় তারমুখেই শুনলাম ব্যপারটা। ট্রেন দুর্ঘটনায় যাদুকর আব্দুর রহমান কাটা পড়েছে গত বছর। রেললাইনের উপর তার বিশাল দেহটা নাকি তিন খন্ড হয়েই পড়ে ছিল। তার সেই বিখ্যাত খেলাটার মত। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, খেলাই তো।

নিয়তি আমাদের নিয়ে কত অদ্ভুত সব খেলাই না খেলে!
--------------------
লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।