আমি খুব সাধারন .......
সাবিদিন ইব্রাহিম
প্রতিদিনের পত্রিকা এখন নিত্য খুন-খারাবিতে ভর্তি। টিভি চ্যানেলে চোখ রাখলেও একই। নিয়মিতই খবর হচ্ছে- সংঘর্ষে ৫ যুবলীগকর্মী; ৩ ছাত্রদল অথবা পুলিশের গুলিতে ৭ জামায়াত-শিবিরকর্মী নিহত ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতে সাধারণের মনে একটি ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠছে এরা রাজনীতি করে। মৃত্যুটা তাদের জন্য স্বাভাবিক।
এতো আবেগায়িত হওয়ার কিছু নেই। মৃত্যুর মত কঠিন এক বাস্তব যেন দিনকে দিন সাধারণ মানুষের অনুভূতি থেকে মুছে যাচ্ছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের অনুসারিদের মৃত্যু।
কিন্তু কেন? রাজনীতিতে সক্রিয়রা কী আমার আপনার মত মানুষ নন? তাদের মৃত্যু কেন আরেকজনের ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিবে না। কেনই বা শুধুমাত্র মৃত্যুকে রাজনীতিকীকরণ করে মূল ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে? আমরা যদি এর পেছনের দর্শন খোঁজার চেষ্টা করি, আমাদের গা শিউরে উঠার কথা।
কিন্তু আমি জানি তা উঠবে না।
কারণ আমাদের গণমাধ্যম আত্মঘাতী। এসব গণমাধ্যমের নীতিহীন সহায়তায় আমাদের মনোজগতে ভয়ানক এক ‘এন্টি-ভাইরাস’ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে বা হতেই থাকবে। এটি অনেক দিন ধরেই। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদেরকে ঘৃণার বস্তু বানানো হয়েছে বুঝে, না বুঝে কিংবা ইচ্ছে করেই।
রাজনৈতিক কর্মীরা মানুষ পদবাচ্যে গৃহিত হচ্ছে না- আপনি স্বীকার করেন আর না করেন।
তাদের মৃত্যু, হত্যা, গুম আমাদের এখন আর তেমন নাড়ায় না। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কেউ মরলে আমরা এখন অনায়াসেই বলে ফেলি- অমুক দলের এতটা উইকেট পড়েছে।
একটি স্বাধীন দেশে প্রত্যেকটি মানুষই তার নাগরিক। যেখানে রাষ্ট্র আমাদের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করার কথা ছিল, সেখানে আমাদের অমুক দলের কর্মী-সমর্থক বা অমুক দলের নেতাকর্মী হিসেবে দেখছে। এক দলের নেতাকর্মী যদি মারা যায়, খুন হয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় তো অন্য দলের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, বা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই উৎসবের প্রতিক্রিয়া, ভালোই হয়েছে।
আবার আনন্দিত হওয়া দলের যদি কেউ মারা যায় আগের দলটি খুশি (!) হয়। আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। এভাবেই রাজনীতিকদের অমানবিকীকরণ (ডিহিউম্যানাইজ) করা হয়েছে।
এটাই সত্য এবং এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এটা আম-সমর্থক থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত ব্যক্তিবর্গের লেখাপত্র পড়ে দেখতে পারেন।
হেফাজত সমর্থকদের ওপর পুলিশি হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকজনের স্ট্যাটাস পড়ে শিউরে উঠেছিলাম। তখন দেখেছিলাম কয়েকজন শিক্ষক ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচে রান, ছক্কা-চার ও গোল হলে যেভাবে একজন সমর্থক উল্লাসে মেতে উঠে, সেভাবে তারা উল্লাসে মেতে উঠেছিল।
আবার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কোনো কর্মী যদি মারা যায়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় তাহলে বিরোধী পক্ষকেও এমনই উল্লসিত হতে দেখি। কয়টা ‘উইকেট পড়লো’ এ নিয়ে হিসাব করতে বসে। রাষ্ট্র হিসেবে এটা আমাদের চরম ব্যর্থতার খতিয়ান।
খুন, হত্যা, মৃত্যু কখনো আনন্দের বিষয় নয়! এটাই মানবিকতা। প্রাচীন গ্রিসে গ্লাডিয়েটরদের মধ্যে যুদ্ধে একে অন্যকে হত্যা করার পর দর্শকরা যেভাবে উল্লাসে মেতে উঠতো আমাদের উল্লাসের সাথে তার ফারাক কোথায়? তাহলে সভ্যতার, মানবিকতার উৎকর্ষতার যে দাবি তোলা হয়, সেটা বিরাট প্রশ্নের মুখে পড়ে কিনা?
শেষ পর্যন্ত খুন রাজনীতিকীকরণ না হওয়ায় একজন বিশ্বজিৎ হত্যার বিরুদ্ধে মানুষের এত আক্ষেপ খুব ভালো, আশাব্যঞ্জক। আবার এটা এ প্রশ্নও কি ছুঁড়ে দিচ্ছে না যে এটা ‘সাধারণ মানুষ’ ক্যাটাগরিতে পড়ার ফলে এমনটা হয়েছে? বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্য নির্মম ও করুণ, এটা তার নিজের ও তার পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। এটা দেশ ও জাতি হিসেবেও চরম ব্যর্থতা ও কষ্টের ব্যাপার।
কিন্তু অপ্রিয় একটা প্রশ্ন ছুঁড়তেই হয়-‘অন্য খুন, হত্যা, অপমৃত্যু কি সমান কষ্টের নয়? অন্য কোনো প্রকারের হত্যা, খুন কি কম নির্মম, কম ট্র্যাজিক? যারা বিভিন্ন দল করে, যারা বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী, যারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত তারা কি দেশের মানুষ নন, তাদের কি পরিবার নেই? ছেলে-মেয়ে নেই? তাদের রক্ত কি লাল নয়?
এমন প্রশ্ন আসা উচিত ছিল না যদি না আমরা দেশের মানুষকে ‘নাগরিক’ হিসেবে গ্রহণ করতে শিখতাম।
যদি না আমরা গ্লাডিয়েটরদের মধ্যে প্রতিযোগিতার দর্শক হিসেবে হাত তালি না দিতাম। বড় ভয়ানক দৃশ্য হলো- একদল অন্য দলের কর্মীর মৃত্যুকে ‘উইকেট পড়া’ হিসেবে দেখছে। হরতাল-অবরোধ কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচি দিন হাসিমুখে অনেককেই আমরা দেখতে পাই বলতে- ‘কয়টা উইকেট পড়লো আজকে?’
গণমাধ্যমগুলো ‘গণশত্রু’তে পরিণত হয়েছি কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে অবাক হব না। জাদুর বাক্স বিটিভি আগের সরকারের স্তাবক হিসেবে যেমনটি ছিল এখনো তেমনটিই আছে। বরং বিটিভির চেলা-চামুণ্ডার ভূমিকা পালন করছে অনেকগুলো মিডিয়া।
সরকারের বিভিন্ন নেতা ও ব্যবসায়ীদের মালিকানায় যে নতুন মিডিয়াগুলো এসেছে তার সবগুলোই বিটিভির মত সরকারের মাহাত্ম প্রচারে দিনরাত ব্যস্ত। এখানেও সমস্যা। এসব গণমাধ্যমের সমর্থকদের হয়তো এটি শুনতে একটু খারাপই লাগছে। কিন্তু বাস্তবতা তো এড়িয়ে থাকার উপায় নেই।
আর বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন একটি সংযোজন হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের কমার্সিয়াল বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছে। সেখানে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে শুধুমাত্র একটি দলের অর্জন হিসেবে দেখানো হচ্ছে। পক্ষ-বিপক্ষ বিভেদের দেয়াল তুলে জাতিকে বিভক্ত করার অপপ্রয়াস চলছে। সরকারের সাথে সাথে এই সারেঙ্গি বাজিয়েছে এবং বাজিয়েই চলছে বেশিরভাগ গণমাধ্যম। এটা কি তাদের অজ্ঞতা না ষড়যন্ত্র না পরিকল্পিত? তা বুঝতে হাবুডুবু খাচ্ছে জনগণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভিন্নমত-পথের অনুসারি কেউ থাকতে পারে না, অন্ততপক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল। এতো অবিশ্বাস রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়। এই বিভেদ-অবিশ্বাস আমাদের মাঝে ফারাকটা বাড়িয়ে দেয় কেবল। রাষ্ট্র হলো এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে বিভিন্ন দল-মতের মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের আপাত বিরোধিতা নিয়েই একত্রে থাকার চেষ্টা করে।
আমাদের খুব অবাক করে দিয়ে আবেগের সওদাগর সরকার নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে তিনদিনের শোক ঘোষণা করেছিল।
অনেক বুদ্ধিজীবী এবং ‘বুদ্ধি ব্যবসায়ী’ ম্যান্ডেলার আদর্শের ফেরি করেছেন। আদর্শকে না নিয়ে শুধু আবেগের এই ভাওতাবাজিতে কি আমরা এখনো ক্লান্ত হই নাই? এখনো রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়ানোর কথা না বলে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে নিধনের এক পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠেছি।
দেশের নাগরিকদের সকল বৈধ আন্দোলনকে সরকারি বাহিনী পেছন থেকে পিটিয়ে, ঠেঙিয়ে, দাবড়ানি দিয়ে, হতাহত করার মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করছে আর গণমাধ্যম সামনে থেকে ওইসব দৃশ্য ধারণ করে, গণতন্ত্র হত্যার এই দৃশ্য বিক্রি করে বেশ মুনাফা কামাচ্ছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা কী তা বিশদ পরিসর। তবে গণমাধ্যমের কাজ এক কথায় বলতে গেলে ‘সংবাদ সরবরাহ করা, সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া’।
আমরা একটি আদর্শিক রাষ্ট্রে এমন গণমাধ্যম কল্পনা করতেই পারি যারা ‘সত্য প্রচার করবে যদিও তা যাক নিজের বিপক্ষে’।
গণমাধ্যমগুলো ‘ডিপলিটিসাইজেশনের’ মত কাজে লিপ্ত। অরাজনৈতিক ও বিভিন্ন সাধারণ মানুষের উদ্যোগকে ব্যাপক প্রচার করছে এটা খুব ভালো। আবার ‘সাধারণ মানুষ’ বলতে কিছু আছে কিনা এটা প্রশ্ন করতে হবে। ‘সাধারণ মানুষ’ অরাজনৈতিক প্রাণী এটা অতিমাত্রার সরলীকরণ।
‘আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ’ বলে একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপনে যে অরাজনৈতিক ছবি দেখানোর চেষ্টা করে এটা একটা ফাও কথা। ‘সাধারণ মানুষ’ রাজনৈতিক প্রাণী। এটা কোনো দল করেও হতে পারে, না করেও হতে পারে।
তারা রাজনীতির বাইরে যেতে পারে না। ইচ্ছে করলেও পারে না।
কারণ রাজনীতি করতে না চাইলেও রাজনীতি তাদেরকে ‘করে’ সকাল-বিকাল, রাতে-বিরাতে। তাদের ঘুমে, তাদের জাগরণে রাজনীতি তাদেরকে আষ্টে-পিষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এক্ষেত্রে বার্টল্ট ব্রেশট এর একটি উক্তি যথোপযুক্ত। তার কথাটি এমন-
‘সবচে বড় মূর্খ হল রাজনীতিমূর্খ; সে না শোনে কিছু, না বলে কিছু, না অংশ নেয় কোনো রাজনৈতিক ঘনঘটায়। সে জীবনের মূল্য বোঝে না, না বোঝে সে মূল্য শিমের, কিংবা মাছের, কিংবা ময়দার, কিংবা ভাড়ার কিংবা জুতার কিংবা ওষুধের, সে সব ছেড়ে দেয় রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর।
রাজনীতিমূর্খ মানুষ এতটাই হাঁদারাম যে সে বুক ফোলায়ে সগর্বে বলে সে, রাজনীতি ঘেন্না করে। এই বোকাও জানে না যে তার রাজনৈতিক অজ্ঞানতার দরুণ সমাজে বেশ্যাবৃত্তির অনাসৃষ্টি বেড়ে চলে, অনাসৃষ্টি বেড়ে চলে পরিচয়হীন শিশু টোকাইদের, সবচে জঘন্য চোর-ডাকাতদের, জঘন্য রাজনৈতিক নেতাদের এবং দুর্নীতিগ্রস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংস্থাগুলার’-বার্টল্ট ব্রেশট (উক্তিটির বাংলা তরজমা: এসএম মনিরুজ্জামান)
রাজনীতির ভুক্তভোগী ওই ‘সাধারণ মানুষেরা’। ব্রেশট-এর গালি বা ‘সুবচনটা’ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের জন্য। ওই দুই শ্রেণীর অনেকেই ইচ্ছে করলে রাজনীতির প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারে। রাজনীতি থেকে ধরা-ছোয়ার বাইরে চলে যেতে পারে, সীমানা অতিক্রম করে অন্য দেশে চলে যেতে পারে।
কিন্তু ‘সাধারণ মানুষ’দের এই ভূ-খণ্ডেই অবস্থান করতে হয়। রাজনীতির সুফল তারা ভোগ করে অল্প-স্বল্প আবার রাজনীতির কুফলের সবচেয়ে বড় ভাগিদার তারা-ই। তাদের নিয়ে প্রত্যেকটি দল রাজনীতি করে আবার ‘সগৌরবে’ তাদের ভুলে যায়। আর গণমাধ্যমগুলো তাদের নিয়েই তাদের ‘সংবাদ ব্যবসা’ টিকিয়ে রাখে। তাদের বন্ধু নামে, গণমাধ্যম নামে ‘গণশত্রুর’ ভূমিকা পালন করে।
লেখার শুরুতে যে কথা বলছিলাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের যেভাবে গণমাধ্যমগুলোতে প্রদর্শন করা হচ্ছে। যেভাবে তাদের মৃত্যুকে একটি স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তাদের মৃত্যু যেন স্রেফ একটা সংখ্যা, প্রচারের ভঙ্গিটা এমন যেন রাজনৈতিক কর্মীদের জন্মই হয়েছে মরার জন্য, মারার জন্য।
কিন্তু তার লক্ষ্য যদি হয় ‘ডিপলিটাইজেশন এবং ডিহিউম্যানাইজেশন’, তাহলে ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে। সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার এশীয়-প্রশান্তসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক সাংবাদিক মাহের সাত্তার ‘আন্ডারস্টান্ডিং বাংলাদেশ’স পলিটিকাল ভায়োলেন্স’ শিরোনামে আল জাজিরার ব্লগে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন। ওখানে এক জায়গায় বলেন- ‘বাংলাদেশের বেলায় সমস্যা হলো ‘রাজনৈতিক কর্মী’ একটা অমানবিক টার্মে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক সংঘর্ষে এই বছরে কয়েকশ’ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু যেহেতু তারা ‘রাজনৈতিক কর্মী’ সেহেতু মানুষ ক্ষেপছে না। কিন্তু ওই মারা পড়া মানুষগুলোও আসল মানুষ, তাদের আত্মীয়-স্বজন আছে, তাদের মৃত্যু ওই পরিবারের সদস্যদের গায়ে লাগে এবং এর প্রভাব পড়বে আগামীতে। ’
আহমদ মুসা ヅ ahmed musa’s blog
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।