আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য লিভিং লিজেন্ড

অনেক দিন পর দেশে এলেন, বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ পেলেন, কেমন লাগছে?

অবশ্যই খুব ভালো। নিজের দেশে আসার আনন্দটাই অন্যরকম। মূকাভিনয়ের জন্য এটা অভাবনীয় সম্মান। বাংলা একাডেমি সাধারণত সাহিত্যের জন্য সম্মান জানায়। মূকাভিনয়ের জন্য বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ অনেক বড় পাওয়া।

এত বছর ধরে এই যে শিল্পটা নিয়ে কাজ করছি বা ৬০ বছর বয়সে এখনো কাজ করে যাচ্ছি_ এর ওপর একটা বড় আলো এসে পড়ল। এ সম্মানে আমি অভিভূত। আমি মনে করি, যারা এখন এই শিল্পটি নিয়ে দেশে কাজ করছেন তারা আরও অনুপ্রাণিত হবেন। তাদের মধ্যে মূকাভিনয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়বে।

 

আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাবনা ও কলকাতায়।

ওই সময়ের গল্প শুনতে চাই।

পাবনার কালাচাঁদপাড়ায় আমার জন্ম। কালাচাঁদপাড়ায় জুবলি স্কুলে আমার পড়াশোনার প্রথম পাঠ। এ স্কুলে ভর্তি হওয়ার ঘটনাটাও ছিল একটু অন্য রকম। বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন দাদাকে (বড় ভাইকে) স্কুলে ভর্তি করাতে।

দাদা বাবার সঙ্গে সাইকেলে চড়ে স্কুলে গেল, ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলো আর ফিরে এলো পেছনের ক্যারিয়ারে বাঁধা একটা মস্তবড় মিল্ক পাউডারের কৌটো নিয়ে। তখন স্কুলে ভর্তি হলে একটা করে মিল্ক পাউডারের কৌটা পাওয়া যেত। ওই কৌটা দেখে আমি কান্না শুরু করলাম অমিও স্কুলে ভর্তি হব। আমার তখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। আমার কান্না থামাতে বাবা সাইকেলে চড়িয়ে স্কুলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং যথারীতি মিল্ক পাউডারের কৌটা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

আমরা চার ভাইবোন একসঙ্গে হাডুডু, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ডাংগুলি, চাকা চালানো, মার্বেল খেলতাম। আমার চেহারা ছিল ভীষণ রোগা। সেই শরীর নিয়ে বাড়ির গাছ থেকে নারকেল, আম, পেয়ারা, জাম, জামরুল, সফেদা ইত্যাদি পেড়ে খেতাম। আমার দাদুবাড়ি ছিল পাবনা শহরের সবচেয়ে বড় ঠাকুরবাড়ি। সেখানে রথযাত্রা হতো।

আমরা রথ দেখতে যেতাম। আমার মা সুশ্রিকা বিশ্বাস গান গাইতে ভালোবাসতেন। ভজন গাইতেন। নিজেই গাইতেন, কোনো ওস্তাদ ছিল না। বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিল।

ভাইবোনদের প্রতিদিন সেটা বাজানোর নিয়ম ছিল। আমি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতাম। আমার বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন আলোকচিত্রী শিল্পী। পাবনা শহরেই তার স্টুডিও ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে তিনি ফটোগ্রাফি ও সাংবাদিকতার কাজ করতেন।

আগফা, গেভার্ট, ইলফোর্ট ইত্যাদি ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গেও তার ভালো যোগাযোগ ছিল। বিশ্বখ্যাত আগফা-গেভার্ট কোম্পানি ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র তাকে কালার ফটোগ্রাফিতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বেলজিয়াম ও জার্মানিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি পাবনা শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

 

ষাটের দশকে পাবনার থিয়েটার চর্চায় বেশ নাম ছিল।

পাবনাতে বনমালী ইনস্টিটিউট নামে একটা থিয়েটার ছিল।

আমার বাবাও ছিলেন ওই থিয়েটারের সদস্য। ফলে ওরা যে সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করত তা পরিবারের সবাই মিলে দেখতে যেতাম। একবার 'আলী বাবা চলি্লশ চোর' নাটক করল। সেখানে আলী বাবা 'চিচিং ফাঁক' বলে আর শব্দ করে দরজা খুলে যায়। আমরা বাড়ি ফিরে ভাইবোন সবাই মিলে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে 'চিচিং ফাঁক' বলে দরজা খোলার চেষ্টা করতাম।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় এক দিন ভিখারী এলো বাড়িতে 'মাগো দুইটা ভাত দ্যান। ' আমি তার পিছু নিলাম এবং বিকৃত স্বরে বলেছিলাম, 'মাগো দুইটা ভাত দ্যান'। আমার মা ছুটে এসে বললেন, 'ভীম (আমার ডাক নাম), এরা গরিব মানুষ না। এদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করতে আছে!' পাবনায় চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে হাজরা ও গাজন নামে অনুষ্ঠান হতো। একদল লোক সারা মাস ধরে সন্ন্যাস গ্রহণ করতেন।

তারা চৈত্র-সংক্রান্তির দিন রাতের বেলায় ধনী বাড়িতে মাদুর বিছিয়ে হ্যাজাকের আলোয় হাজরা পরিবেশন করতেন। আমরা সবাই মিলে সেগুলো উপভোগ করতাম। অন্যদিকে বনমালী ইনস্টিটিউট বছরে অনেকগুলো অনুষ্ঠান করত। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তীতে অনুষ্ঠান হতো। আমি সেখানে অংশগ্রহণ করতাম।

 

কলকাতায় গেলেন কখন?

আমার কাকা সুধাংশু কুমার (নব) মানুষ হয়েছিলেন বাবার ছত্রছায়ায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে তিনি কলকাতায় চলে যান চাকরি করতে। সেখানকার জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে তিনি চাকরি করতেন। নব কাকা বাড়ি এসে কলকাতার গল্প করতেন। তখন বাবা বললেন, 'ছেলে দুটোকে তবে মানুষ করার দায়িত্ব নে নব।

ওরা কলকাতায় পড়াশোনা করলে দেশে এসে অনেক ভালো কিছু করতে পারবে। ' আমি সবে প্রাইমারি পড়াশোনা শেষ করেছি। এর পর বড়দা আর আমি নব কাকার সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলাম। নব কাকা থাকতেন কলকাতা শহর থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে এক সময়ের ফরাসি কলোনি, চন্দননগরে। সেখানে ড. শীতলপ্রসাদ ঘোষ আদর্শ বিদ্যালয়ে ক্লাস সিঙ্ েভর্তি করিয়ে দিলেন।

ওই স্কুলে আমি পড়াশোনা করি।

 

মূকাভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন কীভাবে?

চন্দননগরে পূর্ণদাশ রোডে আমার এক আত্দীয় থাকতেন। তার বাড়িতে আমার যাওয়া-আসা ছিল। ওই বাড়িতে থাকতেন আলোর জাদুকর তাপস সেন, মূকাভিনেতা যোগেশ দত্ত, সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দিন সেখানে গিয়ে দেখলাম_ একজন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটছে।

আবার নানা রকম মুখভঙ্গি করছে। তার কাণ্ড দেখে আমি চমকে গেলাম। ভাবলাম পাগল বুঝি! কাকিমাকে (ডা. রনেন কাকুর স্ত্রী) বললাম, তিনি আমার কথা শুনে হেসেই বাঁচেন না। কাকিমা বললেন, 'দূর বোকা, উনি পাগল হতে যাবেন কেন? উনি অনেক বড় আর্টিস্ট। কথা না বলে উনি সর্বপ্রকার মনের ভাব, গল্প সব কিছুই প্রকাশ করতে পারেন।

' তার কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। আমি তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যোগেশ দত্তর বাড়ি বাংলাদেশে। এর পর তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমাকে সঙ্গে নিতেন। এক পর্যায়ে আমি তার কাছে মাইম শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করি।

প্রথমে যোগেশ দত্ত উৎসাহ দেখাননি। তিনি আমাকে রনেন কাকার মতো ডাক্তার হতে বললেন। ডাক্তার হলে অনেক নাম হয়, টাকা হয়। আর শিল্পী জীবন বড়ই কষ্টের। আমি যোগেশ দত্তের পেছনে পেছনে তার সব অনুষ্ঠানে যেতাম।

এক দিন যোগেশদাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁটাটা দেখালাম। তিনি বললেন, 'আবার কর। ' করে দেখালাম। এর পর দত্ত বললেন, 'দেয়াল ধরে প্র্যাকটিস করিস। আরও ভালো করবি।

' তিনি তার পাশের দেয়ালটা চট করে ধরে ফেলে একটুখানি দেখিয়েও দিলেন। তারপর তার কাছে তালিম শুরু হলো। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতার যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমিতে মূকাভিনয়ের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করি। দেশ স্বাধীনের পর পাবনায় ফিরে আসি।

 

এর পর সম্ভবত পণ্ডিত বারীণ মজুমদার আপনাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন।

পণ্ডিত বারীণ মজুমদার (মিউজিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা) ছিলেন আমাদের সম্পর্কে দূর-আত্দীয়। আমার বাবা তাকে মামা ডাকতেন। তিনি প্রায়ই আসতেন আমাদের পাবনার বাড়িতে। যুদ্ধের সময় তিনি তার একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছিলেন। এক দিন তিনি বাবাকে বললেন_ 'হিমাংশু, তোর তো চার ছেলেমেয়ে আর তোর মামীর তো বড় ছেলে ছাড়া কেউ নেই।

তুই তোর মেজ ছেলেটিকে আমাকে দে। ওর শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা। আমার কাছ থেকে কিছু শিখুক। ' বাবা রাজি হলেন। তার পর তিনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে এসে মিউজিক কলেজে ভর্তি করালেন।

মিউজিক কলেজে পড়ার সময় কলেজের সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতাম। ১৯৭৬ পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর যত ভাষণ তার আগে মিউজিক কলেজ আর উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী গাইত। আমি মিউজিক কলেজকে লিড করতাম। রেসকোর্স, পল্টন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, প্রেসক্লাব সব জায়গায় গাইতাম।

রেডিওতে গানের অনুষ্ঠান করতাম। ১৯৭৫ সাল থেকে আমি বিটিভিতে প্রথম মূকাভিনয়ের অনুষ্ঠান করি। '৭৪ থেকে '৮১ পর্যন্ত আমি এখানে ছিলাম। প্রতিদিন অনুশীলন করতাম। কোনো জায়গায় পারফর্ম করার আগে প্রচুর খাটতাম।

সারাটা দিন কাটাতাম স্টেজ-এর পেছনে। লাইটিং কে করল, মিউজিক কী হবে এসব নিয়ে ভাবতাম। মিউজিক এখানে পাচ্ছি না তো সংগ্রহ করতে চলে যেতাম কলকাতা। এখন তো সারা পৃথিবীর সব ধরনের মিউজিকই এখানে পাওয়া যায়। এর পর আমার ডাক এলো ঢাকাস্থ ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টার অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ থেকে।

তারা আমাকে বলল, 'মাইম কর ভালো কথা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর। আমাদের দেশে মাইম বেশ পপুলার। তুমিও চলো। সেখানে মাইম করবে। ' তখন অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এ উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো মাইমের ওপর একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করল।

কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়লাম। তখন আলী যাকের ও আতাউর রহমানের আন্তরিক চেষ্টায় দুবছর পর আমি ক্লিয়ারেন্স পেলাম এবং ১৯৮১-তে ফ্রান্সের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

 

তারপর ফ্রান্সের জগদ্বিখ্যাত মূকাভিনেতা মার্শাল মারচুর ছাত্র হলেন এবং আমৃত্যু তার সঙ্গে কাজ করছেন। পৃথিবীর বহু দেশে মাইম শোতে অংশ নিয়েছেন। মূলত কী ধরনের কাজ আপনি করে থাকেন?

মার্শাল মারচুকে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ চেনে।

পৃথিবীর মানুষের অসীম শ্রদ্ধেয় সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। এক সময় তিনি ৩৬৫ দিনের বছরে ৩০০টি শো করতেন। আমি বাংলাদেশ থেকে গিয়ে মার্শাল মারচুর গুরু এতিয়েন দ্যু ক্রর কাছে করপোরাল মাইম শিখি। তার সঙ্গে কাজ করেছি এবং সমগ্র পৃথিবীতে শো করেছি। মাইমো ড্রামা কথাটি আজকাল বেশ চালু হয়েছে।

মাইম হচ্ছে ছোট গল্প আর মাইম উড ড্রামা হচ্ছে উপন্যাস। তার সঙ্গে ভ্রমণ করে আমরাই পৃথিবীতে মাইম উড ড্রামা চালু করি। সারা পৃথিবীর লোক তা জানে। আমি যখন দেশে কাজ করতাম তখন মাইমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। তারপরও বিদেশে চলে গেলাম।

এখন খারাপ লাগে। ওখানে কাজ করতে করতে মনে হয়েছে আমি এখনো ওস্তাদ আমজাদ খাঁ, ওস্তাদ বেলায়েত খাঁ বা পণ্ডিত রবিশঙ্কর আজও হইনি যে আমেরিকা কিংবা বিদেশ থেকে কেউ টিকিট পাঠিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি যদি ইউরোপে থাকি, তাহলে অনেক বেশি কাজ পাব, প্রোগ্রাম পাব, জানতে-শিখতে পারব- সে কারণে ইউরোপে থাকা।

ইউরোপে কিংবা অন্যান্য স্থানে যখন আপনার নামের সঙ্গে বাংলাদেশ কথাটি চলে আসে তখন কেমন লাগে?

মার্শাল মারচুর দলের শো পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, তার প্রচারপত্রে দলের প্রতিটি সদস্যের নামের পাশে দেশের নাম লেখা থাকে। সুতরাং সবাই জানে আমি বাংলাদেশি।

তবে প্রথম দিকে মারচু আমাকে ভারতীয় ভাবত। তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। আমি জানানোর চেষ্টা করেছি। আর এখন তো বিভিন্ন মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো-খারাপ সব তথ্য আসে। ফরাসি টেলিভিশনে বাংলাদেশের বহু ডকুমেন্টারি দেখানো হয়।

আমার জন্মভূমি পাবনা, বাংলাদেশ_ এ কথাটি আমি তো পরিবর্তন করতে পারব না। বিদেশের মিডিয়ায় যখন আমাকে কিংবা মার্শাল মারচুর দলের সদস্যদের নিয়ে লেখা হয়, তখন আমার পাবনার কথা উল্লেখ থাকে, এ জন্য আমি বিস্মিত হই। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার সময় আমার ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। সেটা ইত্তেফাক, মানবজমিনে ছাপা হয়েছিল। আমার তো ভীষণ-ভীষণ ভালো লেগেছিল।

 

ইউরোপে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পর্কে বলবেন কি?

যেহেতু এ দেশের ছেলে আমি। ফ্রান্সে গিয়ে ওদের কাজকর্ম দেখে প্রথমে বেশ অবাক হই, তারপর প্রতিদিন ১৬-১৭ ঘণ্টা অনুশীলন করেছি। পাবনায় দেখেছি মহরমে লাঠিখেলা হতো, তখন দেখতাম খেলোয়াড় লাঠি যতখানি না ঘুরাত তার চেয়ে অঙ্গ সঞ্চালন করত। এসব আমাকে অনুপ্রাণিত করত। মারচুর কাছে শিখেছি মাইমের পারফেকশন।

ওরিয়েন্টাল মাইমের সৌন্দর্যবোধ একেবারেই অন্য রকম।

মারচু যে রকম ভারতের ভরতনাট্যম থেকে প্রচুর মুদ্রা নিয়েছেন, জাপানের নৌ এবং কাবুকি থেকে নানা উপাদান নিয়েছেন, তেমনি আমি বাঙালির নানা ঐতিহ্যকে তাদের কাছে পরিচিত করেছি। মারচুর বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন, 'পার্থ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মাইমের বেজের সঙ্গে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ' আমি কী করেছি জানি না, তবে আমি চেষ্টা করি। ইতোমধ্যে ফরাসি সিনেমা এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে মাইমের কাজ করছি।

ফরাসি সিনেমা 'ওয়ান ডলার কারি', 'জেনিস অ্যান্ড জন', 'ফার্মাসি দ্য গার্ড', 'দ্য মর দ্য বেলভিল', 'ভাই ভাই'সহ সুইডেনের 'হান্ড্রেড স্টেপ অব জার্নি' ও নরওয়ের 'ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান' সিনেমায় কাজ করেছি। এ ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইমের ক্লাস নিই। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, নাইকি, আইবিএম ও ম্যাকডোনাল্ডের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির পণ্যের প্রচারে আমি মডেল হয়েছি। এসব আমার অ্যাচিভমেন্ট।

 

মাইমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকগান কিংবা উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগীত ব্যবহার করার সুযোগ কতখানি?

আমি সবসময় দেশীয় জিনিস ব্যবহার করতে চেষ্টা করি।

আগে সবসময় শোতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল, এখন সেটা বন্ধ করে শুধু প্রয়োজনীয় অংশে মিউজিক ব্যবহার করি। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আমি মাইম উড ড্রামা 'দুঃস্বপ্ন'-এর শো করি। সেখানে কিন্তু উপমহাদেশের সেতার, সরোদসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছিলাম।

 

বাংলাদেশে মাইম শিল্পের সম্ভাবনা কেমন বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের দেশে চর্চাই হয় না। আমি যখন দেশে আসি, ছেলেমেয়েরা আসে, কিছু ওয়ার্কশপ করি; কিন্তু তা মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়।

কারণ মাইমের পেছনে দীর্ঘ সময় দেওয়া প্রয়োজন। যে শিল্পের চর্চাই হয় না, তার সম্ভাবনা থাকবে কি করে। যদি একটা স্কুল থাকত, মাইমের জন্য সরকার যদি এগিয়ে আসত কিংবা বিত্তশালীরা, তাহলে মাইম শিল্পকে আরও এগিয়ে নেওয়া যেত। আমি সবসময় দেশে আসতে চাই। আমি যা শিখেছি তা দেশের ছেলেমেয়েদের দিতে চাই।

আমার চেষ্টায় কেউ সাড়া দেয়নি। আমার দেশের মানুষ আজও অনেকে এ শিল্প সম্পর্কে জানে না। যারা নাটক, নাচ কিংবা মডেলিং করে, তাকে মাইম শিখতে হয়। আমি আমেরিকা মাইম ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ক্লাস নিই। সেখানে পৃথিবীর বহু লোক শিখতে আসে।

তারা সেখানে ম্যানার শেখে। অফিসে কীভাবে তারা কাস্টমারদের সঙ্গে কথা বলবে, কাজ করবে, সেসব শেখে। আমাদের দেশে যদি সরকারিভাবে মাইম স্কুল হয়, তাহলে সরকার নানাভাবে উপকৃত হবে। সেক্ষেত্রে মাইমের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বাংলাদেশে আমি একটি মাইম ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে চাই।

এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে বলেছি, আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই। তারা আশ্বস্ত করেছেন মাইম ইনস্টিটিউটের ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন। আমি প্রচণ্ড আশাবাদী এবার কিছু একটা হবে। এটা যদি হয়ে যায়, তাহলে আমার স্বপ্ন সফল হবে।

আপনি লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত।

বর্তমানে লেখালেখি কেমন চলছে?

আমি মাঝে মধ্যে লিখি। তাই বলে নিয়মিত নয়। প্যারিসের বিভিন্ন মিউজিয়ামে গেলাম কিংবা অন্য কোনো প্রদর্শনীর স্থানে, তখন সেসব বিষয়ের ওপর লিখি। কখনো মূকাভিনয়ের ওপরও লিখি। আমেরিকার 'ঠিকানা' পত্রিকাতেও লিখি।

লন্ডনের পত্রিকাগুলো আমার লেখা ছাপে। ভালো লাগা থেকে লিখি।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/index.php     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।