ক) শুভ জন্মদিন, প্রিয় দুর্নীতি
গত পরশুদিন ছিল ঐতিহাসিক ৪ ফেব্রুয়ারি। আমাদের প্রিয় দুর্নীতির ৩৮ তম জন্মবার্ষিকী। শুনে হয়ত হাসছেন, দুর্নীতি আবার জন্মাল কবে? সবুর করুন বলছি। তবে তার বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করবেন না যেন। মতিকন্ঠ যেমন বলেছে- “কিছু কথা থাক না গুপন!” সেইরকম।
(অবশ্য লেখা পড়ে কেউ দুর্নীতির জনককে চিনে ফেললে আমার দোষ নেই। ) ১৯৭৬ সালের ঠিক এই দিনেই দুর্নীতি নামের কুকর্মটি এদেশেরপ্রাতিষ্ঠানিক বৈধতার পরিকাঠামোতে আনুষ্ঠানিক ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিভাবে? তার বিস্তারিত কাহিনী বলব। তবে, তার আগে সবাই জোরসে বলুন- “(লেইট) হ্যাপ্পি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার দুর্নীতি”।
১৯৭৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি ঠিক তার আগের বা পরের দিনগুলোর মতই জলপাই সবুজ আঁধারে ঢাকা ছিল।
সেই অন্ধকারের আড়ালে অনেক কিছুই ঘটে গেছে এই অভাগা ছাপ্পান হাজার বর্গমাইলে। এইসব ঘটনার মাঝে অন্যতম হলঃ “Martial Law Regulation No- VI of 1976” যার শিরোনাম Income Tax (Disclosure of income) regulation 1976 এই অধ্যাদেশটির প্রভাব ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও সুদূরপ্রসারী, যার ধাক্কা আজো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এটি বহাল থাকলে পারবও না। পুরো অধ্যাদেশটি অনেক বড় । আমি এর উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধৃত করছি, খুউপ খিয়াল কইরা, বাহে।
এর ধারা ৫ বলছেঃ
মজার ব্যাপার হল, সেটার নামধাম আকীকা করা হয়েছে ধারা ৬ এ, যেটা বলছেঃ
ধারা ৭ আবার বলছেঃ
(1) the untaxed income shall not be treated as a part of the total income of the same person but separately, as if it were the total income of another person; and where it pertains to more years than one, the aggregate of the untaxed income of all such years shall be treated as the untaxed income.
(2) in all cases in which the total amount of tax due under the income tax act- 1922, on the untaxed amount is more than twenty-five percent of it, the aforesaid tax shall be compounded as follows:
(a) if full payment is made contemporaneously with the filling of the revised return or statement, it shall be compounded at twenty-five percent of the amount of the untaxed amount.
(b) if full payment is made on or before the 20th april, 1976, it shall be compounded at twenty-seven and a half percent of the amount of the untaxed income.
(c) in all other cases it shall be compounded at thirty percent of the untaxed income:
Provided that the compounded tax on the untaxed income shall not in any case exceed the total amount of tax due on it at rates applicable to the assessment year 1975-76;
(3) while calculating the amount of tax due under the Income-tax Act, 1922, on the untaxed income, no allowance shall be made for any rebate, deduction or exemption admissible under that act.”
সবশেষে ধারা ১২ বলছেঃ
কি বুঝলেন? আপনি যদি অবৈধভাবে ১০০ টাকা পান সেই ১০০ টাকার পুরাটাই তো অবৈধ, তাইনা। অথচ এখানে বলা হল- সেই ১০০ তাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা জমা দিলেই বাকি ৭০ টাকা আপনার। তা সে ঘুষের টাকাই হোক আর চুরির টাকাই হোক। ওই কালো আইনের সুবিধাভোগীরা বেশ গম্ভীর কন্ঠে “বাস্তবতা” বোঝাতে আসেন যে- ‘তবুতো ৩০ টাকা অন্তত পাওয়া যাচ্ছে, নইলে পুরো ১০০ টাকাই জলে যেত। ’ যেনঃ ‘নাই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?’ অথচ ইনারা হাসিমুখে বেশ করে চেপে যান যে আদতে ওই ১০০ টাকার পুরোটাই রাষ্ট্রের প্রাপ্য ছিল।
খ) কেতাবের গরু গোয়ালে নেবার পথ
আসেন দেখি “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান” এ ব্যাপারে কি বলে। সংবিধানে “অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম” শীর্ষক ২০ ধারার ২য় অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছেঃ
রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনও ব্যাক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেননা এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক- সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যাক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যাক্তিতে পরিণত হইবে।
আবার,
“সংবিধানের প্রাধান্য” শীর্ষক ধারা ৭ বলছেঃ
অর্থাৎ “Martial Law Regulation No- VI of 1976” যেহেতু
২০ (২) ধারায় বর্ণিত
“অনুপার্জিত আয়” সংক্রান্ত নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ন, তার বাতিল হওয়াই নিয়তি। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? আইন বিশেষজ্ঞ যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তারা কি দয়া করে এর একটা বিহিত করার কোনও পথ দেখাবেন?
গ) এক কানা কয় আরেক কানারে
এই আইনের অস্তিত্ব বহাল রেখে দুর্নীতি উচ্ছেদের চেষ্টা করা আর গাছের গোড়া কেটে সোনারপাথরবাটিতে করে আগায় দুবেলা পানি ঢালা একই কথা। আশংকার কথা এই যে- এই আইনের সুবিধাভোগীরা আছে সমাজের সর্বস্তরে।
সবার যদি জানাই থাকে যেঃ “৩০% দিয়ে দিলে ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, তহবিল তছরুপ, রাহাজানি সব জায়েজ। কেউ টাকার বৈধতা নিয়ে টুঁ শব্দ করবে না, এমনকি আদালতে নালিশও করতে পারবে না। ” তবে নিতান্ত বোকা না হলে মানুষ কোন দুঃখে সাদা টাকার পেছনে ছুটবে? তাই তথাকথিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ’ ঘোষণার আগে প্রয়োজন ‘দুর্নীতির রক্ষাকবচ’ ধ্বংস করা। আর কোনও সন্দেহ নেই সে রক্ষাকবচ হলঃ “Martial Law Regulation No- VI of 1976” রূপকথার রাক্ষসের প্রাণভোমরা বেঁচে থাকতে যেমন রাক্ষসের ধ্বংস নেই, সংসদের অনুপস্থিতিতে সামরিক ফরমানের এক খোঁচায় করা এই কালো আইনটি টিকে থাকলেও দুর্নীতি নামক রাক্ষসের মৃত্যু নেই।
আমাদের সংবিধানের
৭ (১) ধারা যে বলেঃ
“প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগন”।
এটি যে কেবল কেতাবি কথা নয় তা কিন্তু গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারিতে বেশ বোঝা গেছে। আমরা একবার কিন্তু পেরেছি। তাহলে আবার কেন পারবনা, বলুন তো? আমাদের যে পারতেই হবে। নিশ্চয় ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ এও আমাদের “হ্যাপ্পি বার্থডে টু ইউ, দুর্নীতি” বলতে হবেনা। শাহবাগ প্রজন্মের কাছে এইটুকু আশা তো করতেই পারি।
সহসচল রায়হান আবীর গতকাল বলছিলঃ “এককথায় শাহবাগের বাস্তবতা এটিই যে গত ৫ ফেব্রুয়ারিতে কাদের মোল্লা উদ্ধত আঙুল উঁচিয়ে জীবিত ছিল, এই ৫ ফেব্রুয়ারিতে নেই। ” আমরা সকলে আন্তরিকভাবে চাইলে নিশ্চয় দুর্নীতির আঙ্গুলদুটোও ঘ্যাচাং করে কেটে দিতে পারি। আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি নিশ্চয় আমরা আয়েশ করে ছাগুর কাচ্চি সমেত দুর্নীতির কুলখানি উপভোগ করব। মান্না-সালওয়া কিন্তু আকাশ থেকে ঝরে পড়বে না, সে আয়োজন করতে হবে আমাদের সবাইকে মিলেই। আর সেজন্যইঃ বাঁচতে হলে- জানতে হবে, জানাতে হবে।
কালোকে সাদায় বদলে দেবার দিন শেষ- আসুন জোরসে বলি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।