আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলু উৎপাদন কম হলেও লোকসান, বেশি হলেও লোকসান

দেশে এ বছর আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে 'উৎপাদন হয়েছে' ৮৬ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের প্রায় ৮০ ভাগ আবাদি জমির আলু এখনো তোলা হয়নি। ২০ ভাগ আবাদি এলাকার আগাম আলু তোলা হয়েছে মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে আলু আবাদের এই তথ্য কীভাবে সরবরাহ ও পরিবেশন করা হচ্ছে? এমন বিভ্রান্তিকর ও মনগড়া তথ্যের কারণেই জনসাধারণের মধ্যে ধারণা জন্মাচ্ছে যে, এক লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়ার কারণেই আলু নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বিষয়টি কোনো পক্ষ থেকেই জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে স্পষ্ট করা হচ্ছে না। অথচ আলু নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। উৎপাদন খরচের হিসেবে স্মরণকালের সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে আলুর দাম। প্রতি কেজিতে কৃষক লোকসান গুনছে ৫-৬ টাকা। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিনিয়োগ করে কৃষক আলু আবাদ করে এখন সমূহ-লোকসানের শিকার।

কৃষক এখন তার পাশে কাউকেই পাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই কয়েক দিন আগে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে রাস্তায় আলু ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন তারা।  

গত মঙ্গলবার সকালে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী আলু আবাদি এলাকা মুন্সীগঞ্জের কৃষক বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন। ১৫ দিনের মধ্যে কার্যকরভাবে আলু রপ্তানি শুরু করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলারও ঘোষণা দিয়েছেন তারা। যা হোক, পরিস্থিতির প্রতি সরকারের যথোপযুক্ত দৃষ্টি আছে বলে মনে করেই কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করতে চাই।

প্রথমত, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সরকারের বহুমুখী তৎপরতার উল্লেখযোগ্য সাফল্য আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখতে পাই। খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে সবজি-ফসল উৎপাদন পর্যায় পর্যন্ত এই সাফল্য ছড়িয়ে পড়েছে। এক মৌসুমে একটি ফসলে লাভের মুখ দেখলে পরের মৌসুমে হাজারো কৃষক ঝুঁকে পড়ে সেই ফসলে। এতে সেই ফসলের উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বাজার চাহিদা স্বাভাবিক থাকলে কৃষক লাভ পায়, উৎসাহ টিকিয়ে রাখতে পারে, স্বাভাবিক না থাকলে কৃষকের পুঁজিপাট্টা জলে যায়।

পরে সে ধারদেনা করে লাভজনক ফসল খুঁজতে থাকে। এক্ষেত্রে কৃষক বরাবরই অসহায়। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। বাজার মূল্যের গ্যারান্টি সরকারের কাছেও নেই। ফসল চাষ-পূর্ববর্তী পর্যাপ্ত গবেষণা ফসল আবাদ বিষয়ে কৃষকদের উদ্দেশে কোনো দিকনির্দেশনার ব্যবস্থা নেই।

অথচ এসব ক্ষেত্রে সরকারের আগাম ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেকগুলো প্লাটফরম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আলু উপদেষ্টা বোর্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। ওই বোর্ড চাইলেই মৌসুমভিত্তিক আলু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, উৎপাদন পরিস্থিতির আগাম পর্যালোচনা, সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও বাজার মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা করতে পারে।  

কিন্তু যতদূর জানি, গত তিন বছর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ওই কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে। এর মধ্যে ওই কমিটির কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

গত বছর ২০১৩ সালে দেশে আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে অস্বাভাবিক ধস নামে। এতে কৃষক অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলু উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজার মূল্য একেবারে পড়ে যাওয়ার ঘটনা গত ১০ বছরে বহুবারই ঘটেছে। কিন্তু সমাধানের কোনো পথ বের করা হয়নি। গতি সৃষ্টি হয়নি রপ্তানিতেও।

দেশের চারটি আলুজাত শিল্পকারখানা রয়েছে। তিনটি পটেটো ফ্লেঙ্ ও একটি পটেটো স্টার্চ কারখানা। এগুলো সবই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় স্থাপিত। সবগুলোর পেছনেই শত কোটি টাকার ঊধের্্ব বিনিয়োগ। আলুর চাষ বৃদ্ধি থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনে গতি এনে মূল্য সংযোজন করার অংশ হিসেবেই ওই কারখানাগুলো গড়ে ওঠে।

এর আগে সরকার তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুযায়ী নিশ্চয়ই এগুলোর সম্ভাব্যতা, বাস্তবতা, উৎপাদনের সামনে-পেছনের বিষয়গুলো ভালোমতো যাচাই করেই বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠার পর থেকেই বিভিন্ন সময় অচলাবস্থার মুখে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশীয় ওই চারটি আলু শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয় গ্র্যানুলা জাতের আলু। অথচ আমাদের দেশে কৃষক পর্যায়ে প্রধানত উৎপাদিত হয় কার্ডিনাল ও ডায়ম্ল জাতের আলু। ওই কারখানাগুলোর প্রয়োজনে এখন বিচ্ছিন্নভাবে গ্র্যানুলা জাতের আলু উৎপাদিত হচ্ছে।

  

প্রশ্ন হলো, ওই কারখানাগুলো স্থাপন-পরবর্তী সম্ভাব্যতা যাচাইকালে বিষয়গুলো কেন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলো না? পরিকল্পনা ক্ষেত্রে এমন অসংখ্য ত্রুটিযুক্ত হয়েই কৃষক পর্যায়ে এমন হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। যার মূল কারণ বাজার ও সরবরাহ। টানা অবরোধের কারণে আগাম উৎপাদিত আলু মৌসুমি বাজার ধরতে পারেনি। কৃষক ক্ষেত থেকে আলু তোলেনি। কিন্তু আগাম আলুর মৌসুমের শেষ দিকে এসে একবারে বাজারে আলুর সরবরাহ ব্যাপক বেড়ে গেছে।

অন্যদিকে আলুর মূল মৌসুমও এসে গেছে একেবারে দোরগোড়ায়। এমন সময়ে আলুর বাজারের এই ধস শুধু আলু চাষিদের জন্যই নয়, গোটা কৃষি ও উৎপাদন সেক্টরের জন্য বড় ধরনের একটি ক্ষতির আগাম সংকেত। যদিও এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মন্তব্যটি আশাজাগানিয়া। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, 'প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা ভোগ করতে রাজি আছি, কিন্তু না খেয়ে মরতে রাজি নই। ম্যানেজ করার ক্যাপাসিটি অর্জন করতে পারিনি বলে তো আমরা আলুকে বর্জন করব না।

' বিশ্বাস করি, সরকার আলু চাষিদের হতাশা দূর করতে সত্বর কার্যকর একটি পথ বের করবে। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের প্রত্যাশা যথেষ্ট মূল্যায়নের দাবি রাখে। তারা বলছেন, ধান-চাল ও গমের মতো খাদ্যশস্য ক্রয়ের একটি ব্যবস্থা আলুর ক্ষেত্রেও চালু করা হোক। সরকার যদি অন্তত ১৫ লাখ টন আলু উচিত-মূল্যে কিনে তা ভিজিডি, ভিজিএফ, টিআর ইত্যাদি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিতরণের উদ্যোগ নেয় তাহলেও কৃষক ক্ষতির হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পেতে পারেন।  

অন্যদিকে আমাদের দেশের আলুর পুষ্টিমান ও স্বাদ পৃথিবীর অনেক দেশের আলুর চেয়ে ভালো।

এক্ষেত্রে পৃথিবীর দেশে দেশে আলু রপ্তানির জন্য কার্যকরভাবে তৎপরতা শুরু করার প্রয়োজন রয়েছে। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চাহিদা, পুষ্টিগুণ, চাষের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুসরণ করে আলু উৎপাদনেরও একটি পথ সৃষ্টি হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দেশের মধ্যে অনুকূল বাজার কাঠামো তৈরি করা এবং বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে কমিয়ে আনা। যেটি একমাত্র সরকারের কঠোর পদক্ষেপেই সম্ভব হতে পারে। যত দ্রুত এসব দিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে ততই মঙ্গল।

 

শাইখ সিরাজ, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।   ংযুশযং@মসধরষ.পড়স

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।