বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
গত ১২ জানুয়ারি রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত ‘ত্রয়োদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এ ‘জোনাকির আলো’ চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। প্রিমিয়ারে উপস্থিত ছিলেন ছবির পরিচালক এবং ছবির অভিনেতা মাসুদ আলি খান, মৃণাল দত্ত ও শিশুশিল্পী ফারহান। প্রিমিয়ারে বক্তব্য প্রদানকালে মিঠু জানালেন মুম্বাইয়ে ‘থার্ড আই’ আয়োজিত দ্বাদশ এশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শক জরিপে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার জিতে নিয়েছে 'জোনাকির আলো' চলচ্চিত্রটি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের যেকোন সময়ে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে পারে। এর আগে ‘গহীনে শব্দ’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে আলোচনায় এসেছিলেন খালিদ মাহমুদ মিঠু।
চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতানের শিশুদর্শনকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে ‘জোনাকির আলো। ’ একই সঙ্গে নারীর জীবনের নানা টানাপোড়েন তুলে ধরার পাশাপাশি নারীর স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সৃজনশীলতার জয়গানও গেয়েছে ছবিটি। চলচ্চিত্রটির গল্প গড়ে উঠেছে ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনীর উপর নির্ভর করে। এই ত্রিভুজ প্রেমের কুশীলব মীম, কল্যাণ ও ইমন। মীম হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে সহয়তা করার জন্য সাংগঠিনভাবে কাজ করে।
পরিচয় হয় ফটোগ্রাফার কল্যাণের সঙ্গে। কল্যাণকে ভালো লাগলেও ভালোবাসাটা হয়ে উঠেনি মীমের। তাই কল্যাণ যখন ভালোবাসার প্রস্তাব দেয় ততদিনে মীমের পরিবার ধনী পরিবারের ছেলে ইমনের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। অগত্যা প্রত্যাখ্যাত হয় কল্যাণ। ইমন-মীমের সংসার চলছিল ভালোই কিন্তু তাদের কপালে এই সুখ বেশিদিন সইলো না।
জানা গেল মীম কখনই মা হতে পারবেনা। ইমন তার স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসে, তাকে হারাতে চায়না কিন্তু ওদিকে বংশহীন হওয়ার ভয়ে সে ও তার পরিবার মর্মপীড়ায় ভুগতে থাকে। মীম তাদেরকে এই দ্বিধা থেকে মুক্তি দেয়, বাপের বাড়ি ফিরে যায়। এরই মাঝে এস এম সুলতানের সঙ্গে পরিচয় হয় মীমের। মীম জানতে পারে গ্রামের দরিদ্র মানুষ এখনও কেবলমাত্র একটি ঘরে স্ত্রী সন্তান-সন্ততি ও অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে বসবাস করে।
রাতে যখন স্বামী-স্ত্রী শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় তা শিশু সন্তানদের মনে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিন্তু এ স্পর্শকাতর বিষয়ে কেউই ওয়াকবিহাল নয় আর চিন্তিত হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। অখচ শিশুর মানসিক বিকাশে দারুন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এ বিষয়টি। এসএম সুলতান মীমকে গ্রামাঞ্চলে বহুকাল দরে চলে আসা এই সমস্যাটিন সমাধানে কাজ করতে উৎসাহিত করেন। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মীমও বাঁচার একটি অবলম্বন পায় ।
সমাধানের পথ খুঁজতে শুরু করে প্রয়োজনীয় গবেষণা। এভাবেই ছবির কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে।
প্রিমিয়ারে বক্তব্য প্রদানকালে মিঠু জানান যে তিনি এই ছবিতে কিছু সিম্বলিক শট ব্যবহার করেছেন। ছবিতে তার কিছু নমুনা পাওয়া গেল। কল্যাণ মীমের কাছ থকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার বাসায় ফিরে যায়।
খাঁচায় বন্দী পাখিটি ছেড়ে দিয়ে যতবরাই সে ফিরে আসে, দেখে খাঁচায় পাখিটি তখনও আটকা পড়ে আছে। আবার ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে অনেকগুলো পাখি তার রুমে তাকে ঘিরে রেখেছে। কল্যাণের বিষাদ ও ভালোবাসার টানে আটকে পড়ার এ সিম্বলিক দৃশ্যগুলো চমৎকার ছিল। ছবির ক্যামেরাওয়ার্কও কিছু কিছু জায়গায় দারুন ছিল। সূর্যাস্তের সময় সমুদ্রের তীরে মীমের বেহালা বাজানোর দৃশ্যটি চোখে লেগে আছে।
ছবির সিচুয়েশন বোঝানোর জন্য পরিচালক বেশ কিছু জায়গায় রঙের সার্থক ব্যবহার দেখিয়েছেন। নীল রংয়ের ব্যবহারটাই সবচেয়ে চোখে পড়ার মত। ছবিটিতে সাম্প্রতিক সময়কে ধারন করলেও এস এম সুলতান চরিত্রটির উপস্থিতি বেশ চমক সৃষ্টি করেছে। এখানে পরিচালক বেশ মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। এস এম সুলতান চরিত্রটি দিয়ে পরিচালক তার বার্তাটি দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দারুনভাবে সফল হয়েছেন।
তবে ছবিটি মার খেয়ে গেছে গল্প, বিষয়বস্তু আর বুননে। গল্পের কাঠামোটি একদমই মজুবত ছিলনা। পুরো ছবিতে ছিল সমন্বয়তার অভাব। কী চিত্রনাট্য কী নির্মাণশৈলীতে! যে বার্তাটি পরিচালক দিতে চেয়েছেন তা এ সময়ের জন্য কতটা বাস্তবিক ও যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। ত্রিভুজ প্রেমের গল্পটি দিয়ে ছবির মূল সূতো গাঁথতে যাওয়ার যে চেষ্টা ছবিটিতে ছিল তা মোটেও যুতসুই হয়নি।
তাই সুন্দর দৃশ্যধারণ আর সিম্বলিক শট দিয়েও পরিচালক দর্শক হিসেবে আমাদের আশা পূরন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে পরিচালক একাই ছবিটির গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ, শিল্পনির্দেশনা, চিত্রধারণ ও সম্পাদনার কাজটি করেছেন সেজন্য তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। প্রিমিয়ারে ছবিটির রানিং টাইম ছিল ১১৮ মিনিট। ছবির গতি এম্নিতেই যথেষ্ট শ্লথ এবং কিয়দাংশ অপ্রয়োজনীয়। বড় পর্দায় মুক্তি দেয়ার সময় গানগুলো সম্পূর্ণ যুক্ত করে রানিং টাইম হবে আড়াই ঘন্টার মত!
সিনেমাটিতে ওভারঅল অ্যাক্টিং বেশ ভালো।
মূল ভূমিকায় মীম, ইমন আর কল্যাণ এই তিনজনের মধ্যে কল্যাণই ভালো কাজ দেখিয়েছেন। তার চরিত্রটিও স্ট্রং ছিল। পার্শ্বচরিত্রে মাসুদ আল খান আর অতিখি চরিত্রে (এস এম সুলতান) গাজী রাকায়েত দারুন অভিনয় দেখিয়েছেন। ছবির মূল চরিত্র মীম চেষ্টা করেছেন ঠিকই কিন্তু অভিনয়ে তাকে এখনও পাড়ি দিতে হবে বহু দূরের পথ। তবে ছবির সৌন্দর্য বর্ধনে তিনি কোন কার্পণ্য করেননি।
লাক্স সুন্দরী মীমকে এর আগে অন্য কোন চলচ্চিত্র বা নাটকে সম্ভবত এতটা সুন্দর লাগেনি।
ছবির গানগুলো বেশ শ্রুতিমধুর। যার মধ্যে সাগরের ঢেউ, আহবান, পান-সুপারি গানগুলো উল্লেখযোগ্য। গানগুলোতে সুর দিয়েছেন ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা, ইবরার টিপু, সাদ ও হায়দার হোসেন । লিখেছেন রফিকুজ্জামান, জুয়েল মাহমুদ, ইউসুফ আল মামুন ও কবির বকুল।
আর কণ্ঠ দিয়েছেন ন্যান্সি, কণা, পড়শি, বাপ্পা মজুমদার, আগুন, ইবরার টিপু ও হায়দার হোসেন।
জোনাকির আলো ছবিতে নারী ও নারীর সামাজিক সমস্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নারীকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে একলা চলার পথও দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা ছিল। কিন্তু জোনাকির আলো ইতিবাচক ভাবে নারীবাদি চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পারেনি দুর্বল কন্টেন্টের জন্য। তাই চলচ্চিত্র হিসেবে যতটুকু আলো ছড়ানোর কথা, জোনাকির আলো শেষ পর্যন্ত সেই আলোটুকু ছড়াতে পারেনি।
জোনাকির আলো
পরিচালনা: খালিদ মাহমুদ মিঠু
প্রযোজনা: ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা ও সম্পাদনা: খালিদ মাহমুদ মিঠু
সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা: ইমন সাহা, ইবরার টিপু, সাদ ও হায়দার হোসেন
গীতিকার: রফিকুজ্জামান, জুয়েল মাহমুদ, ইউসুফ আল মামুন ও কবির বকুল
কন্ঠ: ন্যান্সি, কণা, পড়শি, বাপ্পা মজুমদার, আগুন, ইবরার টিপু ও হায়দার হোসেন
অভিনয়ে: বিদ্যা সিনহা মীম, কল্যাণ, ইমন, দিতি, মিতা চৌধুরী, তারিক আনাম খান, করভী মিজান, শামস সুমন, গাজী রাকায়েত, মাসুদ আলী খান ও শিশুশিল্পী ফারহান
__________________________________________________
**মুখ ও মুখোশ অনলাইন সিনে ম্যাগাজিন এর ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত**
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।