আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

।। দূরের আলো ।।




আমার অ্যাস্টিগম্যাটিজম আছে।

ছয় বছর বয়সে প্রথম এই শব্দটার সাথে আমি পরিচিত হয়েছিলাম। ফার্স্টগ্রেডের ক্লাসটিচার মিস গোল্ডবার্গ বাৎসরিক ফিজিক্যালের পাশাপাশি আমার আইটেস্টের জন্যও রেকমেন্ড করলেন, কারণ ডেস্ক থেকে বোর্ডের লেখা পড়তে কিছুটা অসুবিধা হত। বাবা একদিন নিয়ে গেলেন অপথ্যালমোলজিস্টের কাছে। বিশালকায় যন্ত্রপাতির ভেতরে টেকনিশিয়ান একের পর এক পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন-ডান চোখ, বাম চোখ, দু'চোখ একসাথে।

কিছুক্ষণ পর ডঃ ব্রেইল এসে আমার সাথে হাত মেলালেন, পরিচিত হলেন, নিজেকে অনেক বড় মনে হলো। বাবার সাথে তাঁর আলোচনায় সেদিনই প্রথম জানলাম, মাইওপিয়ার পাশাপাশি আমার অ্যাস্টিগম্যাটিজম আছে।

চোখের এই ত্রুটিটাকে অবশ্য আমি ক্রমশঃ ভালবেসে ফেলেছি। তেইশ বছরের জীবনে কেন যেন মনে হয়, অ্যাস্টিগম্যাটিজমের কারণে পৃথিবীটাকে আমি অনেকের থেকে কিছুটা অন্যরকম দেখি। আমার পৃথিবী কিছুটা অস্বচ্ছ, সূক্ষ্মতার সীমারেখা অন্যদের থেকে আমার অনেকটাই হয়ত আলাদা।

চশমা খুলে রেখে প্রায়ই চেনা পৃথিবীর অস্পষ্ট, ঝাপসা ক্যানভাসে কোমল রঙে ইচ্ছেমত ছবি এঁকে অচেনা কিছু খুঁজতে ভাল লাগে আমার। কলেজে মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গিয়ে মনে হল সময় বৃথা নষ্ট করছি। পাততাড়ি গুটিয়ে একদিন তাই বাড়ি চলে এলাম। বাবা অখুশি হলেও কিছু বলল না। স্যাক্রামেন্টোর দুই বেডরুমের ছোট এপার্টমেন্টের লিভিংরুমে বসে আমি দিনরাত টিভি দেখতে শুরু করলাম।

পুরনো দিনের ঐতিহাসিক মুভি থেকে এডভেঞ্চার, গ্যাংস্টার, সেইণ্ট, কাউবয়, অ্যাস্ট্রোনট, এসপিওনাজ স্পাই-সবকিছুর সাথে নিজেকে যেন গুলিয়ে ফেললাম। শেলফ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর বইসব সরিয়ে স্টোরেজ থেকে স্কুলজীবনের বেশ কিছু পছন্দের বই এনে সাজালাম। পুরনো বইগুলো পড়তে বেশ ভাল লাগছিল। আমার পনেরো বছরের জন্মদিনে লেখা জার্ণাল পড়ে হাসলাম; সেখানে লেখা, মনুষ্যপ্রজাতি অযথাই প্রাণিকুল নিয়ে চিন্তিত হয়; বস্তুতঃ প্রাণিদেরই উচিত মনুষ্যকুল নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত হওয়া।

সেদিন দুপুরে প্লেটোর Symposium পড়ছিলাম।

জানালা দিয়ে একবার আকাশের দিকে চোখ পড়লো। গতসন্ধ্যায় আমার চোখের সামনে ঘন সবুজ হয়েছিল আকাশ, তারপর কালো। ফেব্রুয়ারীর ঝড়বিক্ষুব্ধ সেইরাতে কি তুমুল শিলাবৃষ্টি হলো! সকালে অনেক পাখিকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল রাস্তায়। রাতভর শিলগুলো মাটিতে ব্ল্যাক আইসে পরিণত হয়েছে। ভয়ানক পিচ্ছিল এই ব্ল্যাক আইস, ধুমধাম পিছলে পড়ে মানুষজন ভীষণ আহত হয় এতে।

সিটি থেকে ড্রাইভ করতেও মানা করা হলো। ঘরে বসে থাকতে সেদিন অনেকেই বিরক্ত হচ্ছিল, আমার কিন্তু ভালই লাগছিল। বইটার কিছু কথা আমাকে খুব আকর্ষণ করছিল, মন্ত্র জপার মত ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে পড়ছিলাম কয়েকটি লাইন, Starting from individual beauties, the quest for the universal beauty must find you ever mounting the heavenly ladder, stepping from rung to rung-that is, from one to two, and from two to every lovely body, from bodily beauty to the beauty of institutions..." আমি চমৎকৃত হলাম। The Heavenly Ladder! স্বর্গীয় মই! স্বর্গীয় মইয়ে আরোহণ করে ব্যক্তিগত সৌন্দর্য থেকে সার্বজনীন সৌন্দর্যে চোখ ফেরানো যাবে। মইয়ের প্রথমধাপ থেকে দ্বিতীয়ধাপ, দেহজ সৌন্দর্য থেকে ক্রমশঃ প্রাতিষ্ঠানিক সৌন্দর্য! কি অদ্ভুত! ধীরে ধীরে উচ্চতায় যাও সৌন্দর্যের।

দৈনন্দিন নগ্নপাশ ছেড়ে, সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে যাও উপরে, পৃথিবী ছেড়ে একসময় মুক্ত আকাশে সুন্দরতমকে খুঁজে নাও!

আহ! আমাকে আকাশ টানছে!

-আমি একটা টেলিস্কোপ বানাবো বাবা। নিজের হাতে একটা কিছু বানাতে চাই।
- সায়েন্স ক্লাবের জন্য একসময় অনেক কিছু বানিয়েছ! রকেট বানিয়েছিলে একবার, মনে আছে?
-সেটা তোমার আইডিয়া ছিল বাবা, আমার না। আর সত্যিকারের রকেটও ছিল না সেটা, ছিল একটা মডেল, খেলনা।
-টেলিস্কোপ দিয়ে কি হবে?
-আকাশের তারা দেখব।


-তারা দেখে কি হবে?
-দেখলে অসুবিধা কী বাবা? কমেট, নেবুলা, ব্ল্যাকহোলস, পালসার, কোয়েযার- কতকিছু দেখার আছে আকাশে, জানার আছে!
-সুপারবৌল দেখতে যাবে এরিক? দুটো টিকেট আছে।
- না বাবা। টেলিস্কোপটা কিভাবে বানানো যায় সেটা নিয়ে ভাবতে আমার কিছুটা সময় দরকার।


বাবার মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পারছি, কিন্তু করার কিছু নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই আকাশ, তারা আর টেলিস্কোপ নিয়ে ভাবছি আমি।

গ্রিফিথ অবজারভেটরি আমার সবচে' পছন্দের জায়গা, সেখানকার আইমেক্স থিয়েটারে শো'গুলো দেখতে গিয়ে স্থানু হয়ে যেতাম, আমার পুরো অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে যেত মহাশূন্যে। স্কুল বা বিভিন্ন ক্লাব থেকে, বাবা- মার সাথে-অনেকবারই আমি স্টার-গেযিং ক্যাম্পিংএ গেছি। টেন্টের বাইরে বসে ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ছবি আঁকা বইগুলো ঘেঁটেছি, ঘন্টার পর ঘন্টা রাতের আকাশের ঝকঝকে পরিষ্কার নীলাভ-কালো খোলা বুকে লক্ষ লক্ষ তারার মাঝে বইয়ে আঁকা প্রানীদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছি, সুপ্রাচীন ঊষর মরুর বালুর পাহাড়ের উপর বসে নগ্নচোখে তারাদেখা সেই যুবক আরব বেদুইনের মত। তারা থেকে তারায় লাইন টেনে খুঁজে ফিরেছি এক ব্যাধকে। সহজ নয়, মোটেও সহজ নয় তাদেরকে খুঁজে বের করা।

পুরনো ইচ্ছেটা আবারো যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল- পাবলিক লাইব্রেরির স্পেস-সেকশানে Sky, Telescope- Making , Zenith, Azimuth- কতশত পিরিয়ডিক্যালস ঘেঁটে এক অস্পষ্ট স্বর্গরাজ্যের সন্ধান পেলাম। নিউটনিয়ানস, রিফ্রেক্টরস, ক্যাসেগ্রেইন-যাবতীয় টেলিস্কোপের রাজত্বে উদ্ভাবকদের নিজস্ব অবজারভেটরির সাথে সাথে কেন যেন তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও জানতে ইচ্ছে হলো; কখনই বুঝতে পারিনি এতোশত লোক নিজেদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে ছোট একঘরে নিজেকে আটকে রেখে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, আকাশের মাঝে নতুন তারা খুঁজে ফিরেছেন! মহাশূন্যে নিজেদের অস্তিত্বই খুঁজে ফিরেছেন হয়ত। তাঁদের একজনের চিঠি পড়লাম, "৭ই জুলাই, উজ্জ্বল অভূতপূর্ব শনিগ্রহ দৃষ্টিগোচর হল, সময়ঃ ২৩১৭ ঘন্টা। আমার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম দেখানোর জন্য..."

রাতে খাবার টেবিলে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম।

-একটি বস্তু যত দূরে, তার আলো আমাদের চোখে পৌঁছাতে ততবেশি সময় লাগে।

এই ডাইনিংরুমেরই আরেক পাশে তাকাও বাবা, এক সেকেন্ডের একবিলিয়ন ভাগের একভাগ আগের ছবি দেখবে তুমি। চাঁদের দিকে তাকালে এক সেকেন্ড আগের চাঁদকে দেখবে। এমনকি, সূর্য যদি হঠাৎ জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায় সেটাও আমরা জানব আট মিনিট পর! বলতো বাবা, তাহলে সূর্যের থেকে আরো দূরে যে তারাগুলো আছে, তাদের ক্ষেত্রে কি হবে?
-কি হবে?
-আমরা যদি রাতের আকাশে তাকাই, যে তারাগুলোকে দেখব, তাদের আলো হয়ত বিশ, তিরিশ, অথবা কয়েকশ' বছর লেগেছে আমাদের চোখে পড়তে! তার মানে, সেটা তাদের বর্তমান চেহারা না, তুমি সময়ের পেছনে গিয়ে তাদেরকে দেখছ। তুমি অতীত দেখছ বাবা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই দূরত্ব এত বেশি যে বিজ্ঞানীরা একে মাপতে এককের নাম দিয়েছেন লাইট ইয়ার।

এক বছরে আলো দশ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব পরিভ্রমণ করে- ভাবতে পারো! একের পেছনে ১৩টা শূন্য! ধরো, এখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ১০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্যালাক্সির ছবি তুললো। তাহলে আমরা সেই গ্যালাক্সির ১০০ মিলিয়ন বছর আগের চেহারাটা দেখবো। কত পুরনো দিনের ছায়াপথটাকে দেখছি তাহলে!!!! সেসময় পৃথিবীতে ডাইনোসররা ঘুরে বেড়াত, মানুষের পৃথিবীতে আসারও মিলিয়ন বছর আগের সময়! যত দূরের ছায়াপথ দেখতে যাবো, তত তারা তরুণ। আরও দূরে তাকাতে পারলে জানতে পারব তাদের উন্মেষ। যত কাছে আসব, জানব তাদের কৈশোর, যৌবন, তাদের পরিণত আর বৃদ্ধাবস্থা।

তাদের বুকের ক্ষত। আনন্দ আর দুঃখের সময়গুলো। মানুষের মতই তাদের জীবনক্রম!

বাবাকে Azimuth এর একটা আর্টিকেল দেখালাম, The Telescope-Window into a Lost World নামের। সেটাতে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, যদি কোনভাবে একটি অতিকায় লেন্সকে পৃথিবী থেকে অনেকদূরে স্থাপন করা সম্ভব হয়, তাহলে পুরনো পৃথিবীকে দেখা যাবে। প্লেটো, সক্রেটিস, মিকেলেঞ্জেলো, ভ্যান গগ- সবাইকে দেখা সম্ভব।



-এতদূরে মানুষের পক্ষে যেয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা তো সম্ভব না। এলিয়েনরা পারবে; কিন্তু তারা কেন প্লেটোকে দেখতে চাইবে?
-কাম'ন বাবা! এটা পয়েন্ট না! গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, টেলিস্কোপ সবসময় পশ্চাদবর্তী। পেছনে তাকানোর, অতীত দেখার জানালা।
-এরিক, লিজের বিয়ে হয়ে গেছে গত নভেম্বরে, জানো তো?
-না।
-এক ব্যাংকারের সাথে।


-ওহ, আচ্ছা।
-তুমি তাকে পছন্দ করতে। কখনো ওকে বলোনি কেন?

খাবার সামনে রেখে আমি চুপ করে থাকি। মাথার বামপাশে একটা ব্যথা শুরু হয়েছে, দপদপ করছে। লিজকে কি আমি পছন্দ করতাম? অপছন্দ করতাম না সেটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।

আমি মানুষ ভালবাসি; শিশু, যুবক, বৃদ্ধ-সব বয়সের মানুষকে পছন্দই তো করি! লিজকেও নিশ্চয়ই করতাম! আমরা একই হাইস্কুলে যেতাম- স্কুলটিমে দুজনেই খেলতাম, মাছ ধরতে গেছি অনেকবার একসাথে, স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে একদিন লিজকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম। এতদিন আমার কিছুই মনে পড়েনি। আমি মনে করতে চাইও না। আমার লিজ। ডেনিম শর্টস, স্নিকার, আর পনিটেইলে শক্ত করে বাঁধা আর্গন অয়েলের সুগন্ধিমাখা ঝরঝরে লম্বা চুল।

উচ্ছল হাসি। সবাই চলে যায়। লিজ, মা। বাবার উপর রাগ করে মা সাউথ ক্যারোলাইনা চলে গেছে আটবছর হলো। মা'র সাথেও আমি কথা বলতে চাই না।

সবাই শুধু চলে যেতে শিখেছে। হুট করেই পুরনো এক বাতাস যেন হু হু করে ঘরে ঢুকে পড়ল আজ; চৌদ্দবছরের সেই লিজকে দেখার জন্য, ঘরজুড়ে মা মা গন্ধটা ফিরে পাবার জন্য, আমার কৈশোরের সেই উদ্দাম দিনগুলোকে নিজচোখে একবার দেখার জন্য হঠাৎই যেন উন্মুখ হয়ে উঠলাম। টেলিস্কোপটা আমার ভীষণ দরকার, এখুনি।

নিউটনিয়ানস টেলিস্কোপটা অবশেষে আজ পূর্ণাঙ্গরূপ পেয়েছে। বারান্দায় বসে বেইসের শেষ স্ক্রুটা লাগালাম, খুব অপেক্ষা করছিলাম রাতের জন্য।

সুনিপুণ এক মিউজিক্যাল কনডাক্টরের মতই, আমার দু'হাত সামনে থেকে দু'পাশের খোলা বাতাসে সাঁতার কাটল। স্বর্গীয় মইয়ের প্রথম ধাপে পা রাখার জন্য আজ আমি প্রস্তুত। সন্ধ্যা নেমে আসছে, দিগন্তছোঁয়া লেকের আরেকপাশে ফোকাস করলাম। খেয়াল করলাম দুটো ব্যাপার কাজ করছে টেলিস্কোপটায়-এক, বিশেষ একটা কিছুতে ফোকাস করা বেশ কঠিন; দুই, যা দেখছি সব উলটো প্রতিচ্ছবি। নিউটনিয়ানস এর এই বৈশিষ্ট্য আমার জানা ছিল অবশ্য, প্রতিচ্ছবি উলটোভাবে আসে; তবে মহাশূন্যের বিশালতায় সোজা বা উলটো বলে কিছু নেই।

আমার দৃষ্টির উপরভাগ জুড়ে লেকের সুনীল পানি, গাছগুলো সেই পানির নীচ থেকে আমার দিকে হাত নাড়াচ্ছে, তারও নিচে সারি সারি পাহাড়- আকাশের অন্তহীন গাঢ় নীলে ডুবে আছে। দূরের পাহাড়গুলোকে ভাল করে দেখতে গিয়ে হুট করেই লেন্সের ভেতর চলে এলো পাহাড়ের খাঁজ ছুঁয়ে আয়তাকার একটি বাসা; একটি মেয়ে- সেই বাসার পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে। টেলিস্কোপের অন্যান্য সব দৃশ্যপটের মত এই ছবিটাও উল্টানো। লম্বা বাদামী চুলের অরণ্য, একহাতের আঙ্গুল ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করছে তাতে। মুঠোবদ্ধ দু'হাত উপরে তুলে মৃদু হাই তুললো সে, ঈষৎহেলানো মুখে আধখোলা ঘুম ঘুম চোখ।

তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন, শ্রাবস্তীর কারুকাজ করা অপরূপ সেই মুখ। এক উলটে থাকা রেনেসাঁর পেইন্টিংয়ে নিখুঁত এক মানবী। দৃশ্যমান যে কোন মেয়ের থেকে সে আলাদা, যেন ধরা-ছোঁয়া-জানার বাইরের অপার্থিব কিছু। পেছনের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে নিঃসৃত আলো তার স্বচ্ছ জামা ছুঁয়ে, শরীরের প্রতিটি সূক্ষ্ম অণু-পরমাণুসম ছিদ্র ভেদ করে যেন ছুটে যাচ্ছে, ত্রিমাত্রিক ছবির মত। ঘুরে দাঁড়ালো সে, আমার সাথে চোখাচোখি হলো ক্ষণিকের; মুহুর্তের জন্য মনে হলো, আমি নিজেই অপ্রতিরোধ্য আলোকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছি, ছুটে যাচ্ছি সেই সুতনু অবয়বের ভেতর, তার অস্থিমজ্জার সাথে মিশে যাচ্ছি ক্রমশঃ, শূন্য থেকে মহাশূন্যে, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে অবিরত ঘূর্নিপাক খাচ্ছি।



একপলকের সেই নিগূঢ় দেখা ক্রেশেন্ড্রোর মতই উচ্চকিত হয়ে আমাকে অবশ করে দেয়। চিত্রবৎ দাঁড়িয়ে আছি আমি, কতক্ষণ তা জানি না। সংবিৎ ফিরতেই লেন্সটা দ্রুত এডজাস্ট করার চেষ্টা করলাম। মেয়েটি কোথাও নেই। বাসাটা চেনার চেষ্টা করলাম, আর দশটা স্টাকো বাড়ীর ভিড়ে তা হারিয়ে গেছে, চিনতে পারছি না কিছুতেই।

চশমাটা খুলে রেখে টেলিস্কোপে একবার আকাশ, আবার পৃথিবী দেখার চেষ্টা করলাম। মহাকাশের শূন্যতাকে অদ্ভুত মনে হচ্ছে আমার এখন-বড় বেশি বিস্তৃত যেন, বড় বেশি নিঃসঙ্গ! অনন্ত অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই সেখানে। অজানা এক মিষ্টিসুর শুধু আমার অস্তিত্বজুড়ে-আমার চেতনাকে ক্রমশঃ আচ্ছন্ন করে তুলছে। স্বপ্নদর্শী তাৎক্ষণিক সেই সময় আমাকে গোপন এক কথা বলে গেছে আজ। এক ধ্রুবসত্য।

বলে গেছে, জীবন থেকে আসলে কিছুই হারায় না, বিশ্বচরাচরে কোথাও না কোথাও সে থেকে যায়। অবিনাশী তাকে কখনো ধরা যায়, কখনো যায় না। যাওয়া আসার খেলায় এই ছবিটাও তাই, দূরের তারা থেকে আমার কাছে ফিরে আসা তেমনি এক মহার্ঘ আলো।



 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।