আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী দল জামাতে ইসলামীসহ হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কথা-কাজে জামাত-হেফাজতের প্রতি একাধিকবার ‘সফট কর্নার’-এর প্রকাশ দেখিয়েছে দেশটি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আল-কায়েদার তৎপরতা নিয়েও নীরব মার্কিন প্রশাসন। অথচ এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে, আল-কায়েদা প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরির বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অডিওটি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই ছড়ানো হয়েছে।
কূটনীতিকদের অনেকে মনে করছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদের ধোয়া তুলে যুদ্ধ চালানোর অনেক নজির রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ‘খবরদারি’, ‘নজরদারি’র অংশ হিসেবে নানা প্রসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে দেশটি।
জামাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকলেও দলটির পক্ষে একাধিকবার সাফাই গেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দলটির অন্যতম নেতা কাদের মোল্লার বিচার প্রক্রিয়াসহ মৃত্যুদ- নিয়েও সরব ছিল দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সরাসরি বলেছিল, কাদের মোল্লা ন্যায়বিচার পাননি।
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের ফলে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদ- লঙ্ঘিত হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তারা যেকোনো পরিস্থিতিতেই মৃত্যুদ-ের বিরোধী। কারণ মৃত্যুদ- নিষ্ঠুর এবং অমানবিক শাস্তি।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেখা যায়, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার, জামাত-জঙ্গি প্রসঙ্গ, হেফাজতের তা-ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সেই অর্থে ‘কঠোর’ নয়। বিভিন্ন সময় সেসব সংগঠনের পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বলেছেন মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
এমনকি হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল না হলেও সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করার নজির সৃষ্টি করেছেন মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ক্যাথলিন গিবিলিস্কো এবং সহকারী রাজনীতি বিশেষজ্ঞ লুবাইন চৌধুরী মাসুম। ওইদিন সকাল ১০টায় মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তারা হাটহাজারীর দারুল উলুম মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। এসময় হেফাজত নেতারা তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে আমিরের কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে ঘণ্টাদুয়েক আলোচনা হয়।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মওলানা আনাস মাদানী, যুগ্ম-মহাসচিব মওলানা মুঈনুদ্দীন রুহী, সাংগঠনিক সম্পাদক মওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে ক্যাথলিন হেফাজত নেতাদের কাছে সংগঠনটির ১৩ দফার আন্দোলন, নীতি-আদর্শ, সাংগঠনিক তৎপরতা, গত বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। হেফাজত নেতারা এসব বিষয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার পাশাপাশি সংগঠনের অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করেন। এসময় ক্যাথলিন শাপলা চত্বরে হতাহত ও পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনা এবং জঙ্গিবাদ নিয়েও আলোচনা করেন। এসময় ক্যাথলিন বলেন, শাপলা চত্বরের ঘটনার সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম।
পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানোর মতো ঘটনার সঙ্গে হেফাজতের লোকজন জড়িত থাকতে পারে এমন অভিযোগ তখন ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস হয়নি।
উপজেলা নির্বাচনের দিন ওই এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকলেও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের
নামে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি অনেকের মনেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, আর কোনো সংগঠনের কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে সেদিন মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা এতো দীর্ঘ সময় বৈঠক করেননি। এর ফলে ওই বৈঠকের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়েও ‘সন্দেহ’ রয়েছে বিশ্লেষকদের।
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, জামাত-হেফাজত ইস্যুতে মার্কিনিদের ভূমিকার সমালোচনা করছেন বিভিন্ন মহল।
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসনের দ্বৈত ভূমিকা নতুন নয়। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ বি এম নাসির এক নিবন্ধে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতে, জামাতে ইসলামী একটি মডারেট ইসলামিক দল। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জামাতে ইসলামীকে এ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু জামাতকে ‘মডারেট’ ইসলামিক দল নামে তকমা দেয়া হলেও আদতে দলটি চরমপন্থী। দলটির তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে ‘মওদুদীবাদ’।
মওদুদী জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি হচ্ছেন প্রথম ইসলামিক চিন্তাবিদ যিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ বি এম নাসিরের মতে, একটি চরমপন্থী মতাদর্শের দলকে এভাবে নিজেদের রূপ লুকিয়ে রাজনীতি করতে দেয়ার পরিণতি তো ভালো হবে না।
তবে পরিণতি যা-ই হোক, বাংলাদেশে জামাতের রাজনীতির পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা একাধিকবার জামাতের রাজনীতির পক্ষে কথা বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা নিউজওয়ার্ল্ড জানায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে এক অনুষ্ঠানে মজিনা জানান, তিনি আশা করেন, ‘ভায়োলেন্স’ পরিহার করে জামাত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে।
জামাত-হেফাজতসহ জঙ্গিবাদ ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার করার দাবি বিভিন্ন সময় এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে বরাবরের মতো তা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বাংলাদেশ সেন্টার ফর পিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট গতকালও এ বিষয়ে একটি সেমিনারে তাদের দাবি তুলে ধরে। জঙ্গিবাদের উত্থান : বাংলাদেশ ভাবনা শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শক্তিশালী করে।
অন্যদিকে বিভিন্ন অঞ্চলকে জঙ্গিদের মাধ্যমে কৌশলে অস্থিতিশীল করে খবরদারি করে। তাদের কর্তৃত্ব দেখানোর পাশাপাশি শোষণের সুযোগ নেয়। তারা বলেন, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা। এরপর সেখানে সদ্য-সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে জিতে আসে জামাত-হেফাজতের প্রার্থীরা।
এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে সচিবালয়ে তার সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, সেদিন অর্থমন্ত্রী মজিনাকে বলেন, জামাত-শিবির বাংলাদেশে যে কর্মকা- করছে, সেজন্য দলটিকে টেরোরিস্ট পার্টি হিসেবে ডিক্লেয়ার করা উচিত।
মজিনা এতে ডিসএগ্রিড হননি বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। তবে বাস্তবে জামাত-শিবির তোষণের অভিযোগ রয়েছে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
গত বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের তা-বের পরদিনই পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ড্যান ডব্লিউ মজিনা। সহিংস ঘটনার একদিন পরই পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এখনই উপযুক্ত সময় একটি পথ বের করা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিকেলে সাড়ে ৫টা থেকে পৌনে ৭টা পর্যন্ত ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
হেফাজতে ইসলামের তা-বের ঘটনা নিয়ে মজিনা বলেন, সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবারই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমানেরও মুক্তি চান ড্যান মজিনা। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নিহতের মনগড়া সংখ্যা উল্লেখ করার অভিযোগে আটক হওয়ার পর ১৪ আগস্ট অধিকার কার্যালয় পরিদর্শনকালে মজিনা আদিলুরের মুক্তি চান।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাওয়াহিরির নামে ছড়িয়ে পড়া অডিও-ভিডিও নিয়ে দেশটি মাত্র একটি শব্দেই তাদের প্রতিক্রিয়া শেষ করেছে। বিষয়টি তাদের ‘নজরে’ আছে বলেই ক্ষান্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সুত্র
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।