আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল-কায়েদার জিহাদি ডাক : কীসের আলামত

বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী সংগঠন আল-কায়েদাপ্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি একটি অডিও বার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের ভাষায় মুসলমান, ইসলাম ও আলেম-উলামাদের রক্ষার জন্য জিহাদের ডাক দিয়েছেন। অডিও বার্তাটি ১৫ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ন থেকে বাংলাদেশে ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো অ্যারিন জেলিন বলেছেন, অডিও বার্তাটি তার 'জিহাদোলজি ডট নেট' ওয়েবসাইটে সর্বপ্রথম ১৪ জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় (ইত্তেফাক-২০ ফেব্রুয়ারি)। এই বার্তাটি আল-কায়েদার সোর্স থেকে তিনি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। প্রায় ২৯ মিনিটের এবং ৪২০০ শব্দের এই বক্তব্যের মধ্যে দুটি অংশ আছে।

এক বছর ধরে, বিশেষ করে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ডাদেশের পর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের পক্ষ থেকে দেশে-বিদেশে যে অপপ্রচার চালানো হয় তার সঙ্গে আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির বক্তব্যের প্রথম অংশের হুবহু মিল রয়েছে। জাওয়াহিরির বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে তার সঙ্গে পাকিস্তান, সে দেশের জামায়াত এবং বাংলাদেশের জামায়াত-শিবিরের কথার হুবহু মিল পাওয়া যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সঠিক ছিল, এ কথা বাংলাদেশের জামায়াত-শিবির প্রকাশ্যে এখনো স্বীকার করে না এবং একাত্তরের পক্ষে আজ পর্যন্ত তারা একটি কথাও বলেনি। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়েছে এবং শহীদ মিনার ভেঙে ফেলেছে। জামায়াতের আদর্শের প্রতি অনুরাগী ইনকিলাব পত্রিকা প্রায় ১০-১২ বছর আগে একবার আমাদের জাতীয় সংগীতের প্যারোডি ছাপিয়েছিল।

পুরান ঢাকার এক মুসলিম লীগ নেতা কয়েক বছর আগে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তার বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা টাঙ্গিয়েছিল। লেখার শুরুতে এ কথাগুলো এ জন্য বললাম, যাতে আমাদের সবার উপলব্ধিতে এই কথাটি থাকে যে, জামায়াত ও মুসলিম লীগের এদেশীয় নেতা-কর্মীরা আজ ৪২ বছর পরেও বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি, যার প্রতিফলন দেখা যায় জাওয়াহিরির বক্তব্যের শেষাংশে। বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকট এখানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার দর্শন ও আদর্শের প্রতি যাদের সামান্যতম আনুগত্য নেই, তারা বাংলাদেশে রাজনীতি করে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আইমান জাওয়াহিরির আলোচ্য বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক এবং যারাই তা তৈরি ও প্রচার করে থাকুক না কেন, অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।

এ কথা বলছি এ জন্য যে, বক্তব্য প্রদানকারীর সত্যাসত্য সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট হওয়া যায়নি। যদিও বক্তব্যটি বাংলাদেশের ইন্টারনেটে আপলোড করার অভিযোগে র্যাব রাসেল বিন সাত্তার নামের একজন শিবির কর্মীকে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতার করেছে। সবার মনে যে কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছে তাহলো, বক্তব্যটি সত্যিই কি আইমান জাওয়াহিরির, নাকি তা অন্য কোনো পক্ষ থেকে তৈরি করে জাওয়াহিরির নামে ছাড়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত. যারাই বক্তব্য প্রদান ও প্রচার করে থাকুক, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি এবং বাংলাদেশের জন্য তার পরিণতি কী হতে পারে। এ বক্তব্য প্রদান ও প্রচার কে বা কারা করতে পারে সে সম্পর্কে এ পর্যন্ত তিনটি সম্ভাব্য পক্ষের দিকেই বেশির ভাগ মানুষের সন্দেহের আঙ্গুল উঠছে।

এই তিন সম্ভাব্যতার প্রতিটির পক্ষে-বিপক্ষের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য উপলব্ধির সুবিধার্থে আল-কায়েদা ও তার স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে একটু ছোট বর্ণনার প্রয়োজন বলে মনে করছি।

সোভিয়েত দখলদারির বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করার জন্য ওসামা বিল লাদেন ১৯৮৪ সালে গধশঃধন-ধষ-কযরফসধঃ (গঅক বা ম্যাক) নামে একটি মুসলিম সংগঠন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সদর দফতর খুলে ম্যাক নামের সংগঠনটিকে রূপান্তর করে আল-কায়েদা গঠন করেন। তার আগে ১৯৮৬ সালে লাদেন ম্যাকের একটি শাখা অফিস খোলেন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন এলাকায় আটলান্টিক এভিনিউতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন কোনো আপত্তি করেনি।

আল-কায়েদা ও তার সহযোগী সংগঠনের মূল কথা, গণতন্ত্র হলো কুফরি বা শয়তানি মতবাদ এবং সারা বিশ্বে ধর্মতান্ত্রিক ও শরিয়াভিত্তিক মুসলিম খেলাফত পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জিহাদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এ রকম রাষ্ট্রের একটি মডেল তারা শুরু করেছিলেন আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের হেফাজত নেতা মুফতি ইজহার আফগানিস্তানের ওই সময়ের শাসনামলকে বেহেশতের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এই মতবাদের প্রথম উৎপত্তি হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্তমান সৌদি আরবের হেজাজ প্রদেশে, প্রবর্তক মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, যার মতবাদকে এখন ওয়াহাবইজম বলে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের জামায়াত, আল-কায়েদা তালেবানসহ তাদের ঔরসজাত সব জিহাদি সংগঠনের মূল মিলনের জায়গা হলো এই ওয়াহাবিতন্ত্র।

বর্তমানে আল-কায়েদার সাতটি নিজস্ব সংগঠন বিশ্বব্যাপী কাজ করছে। তার মধ্যে আল-কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব (আফ্রিকা) এবং আল-কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (মধ্যপ্রাচ্য) অন্যতম। পাকিস্তানের তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়বা, জঈশ-ই-মুহম্মদ, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদ আল-কায়েদার মিত্র সংগঠন। পাঁচটি প্রধান স্ট্র্যাটেজির ওপর ভিত্তি করে আল-কায়েদা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম পন্থা হলো দেশে ও বিদেশে তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা।

সেই সুযোগে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ওই দেশে ধর্মতান্ত্রিক ও শরিয়াভিত্তিক খেলাফত পদ্ধতির শাসন চালু করা। এই স্ট্র্যাটেজির একটি সফল প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উদাহরণ ২০০১ আগের তালেবান শাসিত আফগানিস্তান। অপারেশনের প্রাথমিক স্তরে তাদের সামরিক কৌশল হলো আত্দঘাতী বোমা হামলা এবং একই সঙ্গে, একই সময়ে বহু টার্গেটের ওপর আক্রমণ করা। কর্মীদের আধ্যাত্দিক মোটিভেশন, মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী এবং বড় ভাইয়ের হুকুম পালন করা ফরজ। ২০১১ সালের ১ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডো বাহিনী কর্তৃক ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর থেকে আইমান আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা।

এখন দেখা যাক আলোচ্য অডিও বার্তাটি কে বা কারা প্রস্তুত ও প্রচার করেছে। অনেকে মনে করছেন, এটা প্রকৃতই আইমান আল-জাওয়াহিরির বক্তব্য। ওয়াশিংটনভিত্তিক 'জিহাদোলজি ডট নেট'-এর মালিকও একই কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মানুষের ধারণা জামায়াত এবং হেফাজত পাকিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে আগের সম্পর্ক ও যোগসূত্রের মাধ্যমে প্রচুর টাকা ও জোর লবিংয়ের দ্বারা আইমান আল-জাওয়াহিরিকে দিয়ে বক্তব্যটি প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। হেফাজত নেতা মুফতি ইজহারুল ইসলাম একই সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের এবং নেজামে ইসলাম পার্টিরও শীর্ষ নেতা বা আমির।

আবার ইসলামী ঐক্য জোট এবং নেজামে ইসলাম দুটোই পৃথক পৃথক সত্তায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির অবস্থান এবং বৃক্ততা-বিবৃতি প্রমাণ করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা মূল স্রোতের একটি রাজনৈতিক দল হয়েও শর্টকাট পথে ক্ষমতা আরোহণের প্রলোভনে অশুভ শক্তির ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারেনি বিএনপি। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভয় ও আশঙ্কার মূল জায়গাটি এখানে। ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর হেফাজত নেতা মুফতি ইজাহার পরিচালিত চট্টগ্রামের লালখান মাদ্রাসায় বোমা বিস্ফোরণ, প্রচুর বোমার সরঞ্জাম ও গ্রেনেড উদ্ধার, বিগত কয়েক মাস পুলিশ কর্তৃক শিবির ক্যাডারদের আস্তানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার প্রমাণ করে বাংলাদেশে একটা সশস্ত্র জিহাদের ক্ষেত্র তৈরির প্রচেষ্টা ওই সব জঙ্গি সংগঠন ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা বহুদিন ধরেই করে আসছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তানের স্ট্যান্ড, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন জামায়াত-বিএনপির কোণঠাসা অবস্থা ইত্যাদি সব কিছু মিলে কেউ যদি মনে করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার শেষ অস্ত্র হিসেবে জামায়াত তাদের পাকিস্তানি ব্রাদারদের মাধ্যমে জাওয়াহিরিকে দিয়ে এমন একটি বক্তব্য আদায় করেছে, তাহলে সেটিকে খুব বেশি অমূলক বলা যাবে না।

অন্যদিকে আইমান জাওয়াহিরির বক্তব্য এটা নয়, এমন কথার পেছনেও কিছু যুক্তি আছে। একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার মতো বক্তব্য দেওয়ার নজির আল-কয়েদার এতদিনের ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায় না। তাছাড়া আল-কায়েদা প্রধানের ভিডিও বা অডিও বার্তা প্রচার হওয়ার পর আল-কায়েদার পক্ষ থেকে তার দায়িত্ব স্বীকার করে বক্তব্য দেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তা এখনো দেখা যায়নি। তা ছাড়া প্রকৃতই বার্তাটি যদি জাওয়াহিরির পক্ষ থেকে লেখা হতো তাহলে ওই বক্তব্যের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতের কথার হুবহু প্রতিধ্বনি এমন নগ্নভাবে হয়তো যুক্ত করা হতো না।

তখন বক্তব্যের ভাষা ও শব্দ চয়নে তারা আরও কৌশলী হতেন। দ্বিতীয়ত. দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা, এ অপকর্মটি জামায়াত-শিবির নিজেরা করে জাওয়াহিরির নাম ব্যবহার করেছে। বড়জোর তারা পাকিস্তানের সহায়তা নিয়ে থাকতে পারে এবং দেশের বাইরের কোনো ওয়েবপেজ থেকে তা আপলোড করা হয়েছে।

জামায়াতের দিকে যারা সন্দেহের আঙ্গুল তুলছেন, তাদের কাছে হাজারও যুক্তি আছে। ইতোমধ্যে তার অনেক কারণ উপরে উল্লেখ করেছি।

খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করা আর কি। এই প্রচারের ফলে মুসলিম বিশ্ব থেকে সরকারের ওপর যদি একটা চাপ সৃষ্টি হয় তাহলে হয়তো সরকার বিএনপির সঙ্গে একটা আপসরফায় আসতে পারে, আর তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের গতিটা যদি একটু কমানো যায়, এই আর কি। আলোচ্য অডিও বার্তাটি কারা তৈরি ও প্রচার করেছে সে সম্পর্কে তৃতীয় যে মতটি বাজারে শোনা যায় তা সত্যিই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। কিছু বামপন্থি রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীসহ বেশ কিছু বোদ্ধা রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা হয়তো এ কাজ করেছে। এই সন্দেহের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও ভূমিকা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের সঙ্গে একই অক্ষে নেই।

সুইডিশ বংশোদ্ভূত খ্যাতনামা সাংবাদিক 'বার্টিল লিন্টনার' তার লেখা 'গ্রেট গেইম ইস্ট' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই, ওটা শুধুই তাদের মুখের বুলি। এই অঞ্চলে আমেরিকার মুখ্য উদ্দেশ্য এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয়ে চীনের প্রভাব ও প্রসারকে প্রতিরোধ করা। এই লক্ষ্য অর্জনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ এখন ফ্রন্টলাইন স্টেট। তাই বাংলাদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার তালিকা অনেক লম্বা হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে তার কোনটি বাংলাদেশের স্বার্থকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করবে সে ভাবনা বাংলাদেশের মানুষকেই ভাবতে হবে, যদিও সে তালিকা যুক্তরাষ্ট্র কখনো প্রকাশ্যে আনবে না।

তবে আমেরিকা তার ফ্রন্টলাইন স্টেটের কাছে কি কি সুবিধা চায় তা বোঝার জন্য পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের জিসিসি (গল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল) দেশগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব চাহিদার পেছনে আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থান কি তাও জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে। আমেরিকা নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক্যাল স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সন্ত্রাসী জঙ্গিদের লালন-পালন ও সমর্থন দিতে দ্বিধা করে না তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তানের তালেবান ও আল-কায়েদার জন্ম এবং প্রসার। আবার বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ফেলতেও আমেরিকার সময় লাগে না। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পর ওই তালেবান এবং আল-কায়েদাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়।

বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো তৎপরতায় লিপ্ত আছে কিনা তা কে বলবে। জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা জামায়াত, তা জানা সত্ত্বেও আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব জামায়াতের সঙ্গে এক ধরনের সখ্য সব সময় রক্ষা করে চলেছে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রসঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির যে সমীকরণ তার সঙ্গে একাত্তরের সমীকরণের অনেক মিল এখন পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের স্ট্যান্ড দেখলেই তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করার মাত্র ৫০ দিনের মাথায় ভয়ঙ্কয় পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সম্মুখীন হয়।

সে ধাক্কায় কিছুটা হলেও সরকারের চলার গতি মন্থর হয়ে পড়ে। এখন আবার ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নতুন সরকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। এই সরকারের গতি যদি সমান তালে অব্যাহত থাকে তাহলে অল্প দিনের মাথায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের রায় হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হওয়া শুরু হবে। এর ফলে কোথার পানি কোথায় গড়ায় তা নিয়ে তো মামলার অভিযুক্তদের ভাবনার বিষয় আছে। সুতরাং বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে প্রতিরোধ করার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হবে সেটাই স্বাভাবিক।

এ ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে সব ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে গিয়ে সব উদার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসীদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলা ছাড়া অন্য বিকল্প কোনো পথ নেই। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ও দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থনই কেবল এই মহাষড়যন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। দৃশ্যমান জনসমর্থন থাকলে আমেরিকাও যে নতিস্বীকারে বাধ্য হয় তার প্রমাণ ভারতের নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা। কথিত ভিডিও বার্তাটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরের নিরাপত্তার প্রশ্নে বাড়তি হুমকি সৃষ্টির আশঙ্কা যে নেই তা বলা যাবে না।

কারণ জঙ্গিদের মূলমন্ত্র নেতার হুকুম পালন করা ফরজ, এই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অভ্যন্তরে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা কিছু জঙ্গি সংগঠন পুনরায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। আবার আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত থেকে কিছু জঙ্গি বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু না থাকলেও রাষ্ট্রের তরফ থেকে এটাকে খাটো করে দেখা বা আত্দতুষ্টিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এই হুমকিকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং কার্যকরভাবে তা কাউন্টার করার জন্য রাজনৈতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপসহ জঙ্গিদের অর্থ সরবরাহের চ্যানেলগুলোকে বন্ধ করার নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা নেওয়া অতি জরুরি। একই সঙ্গে পাকিস্তান যদি না-ও আসে তাহলে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মিয়ানমারকে নিয়ে জঙ্গিবিরোধী আঞ্চলিক সমন্বয় সংস্থা গঠন করা আবশ্যক।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ই-মেইল : ংরশফবৎ৫২@মসধরষ.পড়স

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।