আমি মুক্ত, অবরুদ্ধ ,আমি কঠোর আবার কিছুই না .. শীতের আবরণে বঙ্গদেশ সবে ঢাকতে শুরু করেছে । এই মৌসুমটাই নাকি ভ্রমণপিপাসুদের প্রিয় । আমাদের প্রিয় অপ্রিয় ভাববার মতো কিছু ছিল না । অনার্স ফাইনাল পার্ট পরীক্ষা শেষ করে কিছুটা সময় নগরযন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় আনচান করছিল মন । বন্ধুরা মিলে দক্ষিনবঙ্গের মংলা,করমজল, বাগেরহাট আর সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা ঘুরবো বলে ঠিক করলাম ।
১৮ ডিসেম্বর চেপে বসলাম ট্রেন এ । চিত্রা এক্সপ্রেস যোগে ঢাকা থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায়। খুলনায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো গ্যাং এর মধ্যমণি আরিফ । ঢাকা থেকে যাচ্ছি ৪ জন । তারুণ্যের উদ্ভাসে টগবগ করছিলাম যেন আমরা ।
দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার ট্রেন যাত্রার পরেও তাই ক্লান্তির রেশমাত্র নেই আমাদের চোখেমুখে । বন্ধুসম আনিসের কথা বলতেই হচ্ছে । তার সৌহার্দপূর্ণ আতিথিয়তা আর সকালের নাশতা শেষে বেরিয়ে পরলাম ''মিশন দক্ষিণবঙ্গ '' এর উদ্দেশ্যে এ যেন যুদ্ধে নামার মতো। প্রথমেই বাধা !! হরতালের জাঁতাকলে পড়ে আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনার কিছুটা পরিবর্তন করতে হলো। ভ্রমণ এ আয়েশ এর মাত্রা কিছুটা কমলো বইকি ।
আসলে ''আয়েশ'' কথাটি একদম ই যায় না তারুণ্যের সাথে। তাই নয় কি ? আর এ কারণেই আমাদের ৩ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনায় মাত্র একটি রাতই আয়েশ করে ঘুমাতে পেরেছিলাম চাদর মুড়ি দিয়ে !! প্রতিকূলতায় যদি সটান হয়ে দাড়িয়ে প্রতিরোধ করতে না পারি তো কিসের তারুণ্য । হরতালের মতো জিনিস তো ধুর ছাই । মংলা যাবার বাসে উঠবার আগে খুলনা থেকেই কুয়াকাটা যাবার বিআরটিসি বাসের টিকেট কেটে রাখলাম । সারাদিন মংলা,করমজল হয়ে বাগেরহাট এর ষাট গম্বুজ মসজিদ আর খান জাহান আলীর মাজার ঘুরে রাতে বাগেরহাট থেকেই কুয়াকাটা যাবার বাস ধরবো ।
এই রোডে কুয়াকাটা যাবার বাস এই একটাই । যশোর, খুলনা, বাগেরহাট হয়ে কুয়াকাটায় যায় এই বাস । হরতালের হাত থেকে বাঁচার জন্যই এই ভ্রমণ পরিকল্পনা । মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে নিলাম সারাদিনের জন্য । মংলা যাবার বাসগুলো আমাদের ঢাকার ৮ নম্বর,৯ নম্বর বাসগুলোর মতো ।
আমাদের গ্যাং এর দীর্ঘদেহী বন্ধুটির(দা গড ওরফে জনি) জন্য একটু মায়াই হলো । বেচারা বাসে পা রাখতে পারছিলো না ঠিকমতো । যাত্রাপথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীত দিকে অবস্থিত গল্লামারি স্মৃতিস্তম্ভটি চোখে পড়ে । কুয়াশার বাগড়ায় রূপসা সেতু সংলগ্ন রূপসা নদীটি ভালো করে দেখা হল না আমাদের সে যাই হোক , দেড় ঘণ্টা যাত্রা শেষে আমরা মংলা বন্দরে এসে পৌঁছি । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বন্দর থেকে ট্রলার যোগে করমজল ।
পূর্ব সুন্দরবন বন বিভাগ এর আওতাধীন এই অঞ্চলটি থেকেই নাকি সুন্দরবন এর শুরু । বেশ বেগ পেতে হলো ট্রলার ভাড়া করতে । নতুন জায়গায় নতুন লোকদের সাথে যা হয় আর কি ! গ্যাং এর সঞ্জু আর আরিফ আবার বারগেনিং এর ব্যাপারে সিদ্ধহস্থ । অবশেষে এক যুতসই ট্রলার ভাড়া করা হলো । পশুর নদীর উপর দিয়ে পঞ্চপাণ্ডবের ট্রলার এগিয়ে চলছে করমজলের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে ক্ষণে ক্ষণেই বড় বড় জাহাজ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো।
সাথে সাথে চলছিলো হরেক রকম ফাজলামি আর হাসিতামাশা। ১ ঘণ্টা যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছলাম করমজলে । খুব একটা বড় না হলেও অনেকটা জায়গা নিয়ে এই সংরক্ষিত বন এলাকা । এর সামনের অংশটিতে হরিণ ও কুমির এর প্রজনন কেন্দ্র ও ভিতরের অংশটি বন । এছাড়াও ছোট করে চিড়িয়াখানার মতো তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে ।
উন্মুক্ত অবস্থায় বানর গুলো তো আমাদের সামনে দিয়েই ঘুরোঘুরি করছিলো । হঠাৎ বানর কর্তৃক ছিনতাই এর শিকার হলাম আমি আমার হাতের চানাচুরের প্যাকেট ছোঁ মেরে নিয়ে সে এক ভঁ দৌড় !! ঢাকা শহরেও যার কোনো ছিনতাই এর অভিজ্ঞতা নেই তার এই করমজল এ এসে ছিনতাই এ পড়া একই সাথে ভয়,বিরক্ত এবং অবশেষে আনন্দের জন্ম দিল। বনের ভিতর বিচিত্র ম্যানগ্রোভীয় উদ্ভিদ,উদ্ভিদের শ্বাসমূল, কাঁকড়া ইত্যাদি নজরে এলো । এরই মধ্যে আমাদের যাত্রাসঙ্গী ,দীর্ঘদেহের অধিকারী দা গড ওরফে জনি করে ফেলল এক অসাধ্য সাধন !! অনেক চেষ্টার পর কাঁকড়া ধরে সে কি এক বিজয় উল্লাস । তার থেকেও বেশি উল্লসিত ঘুরতে আসা একটি পরিবারের এক সুন্দরী মেয়ে ।
মেয়েটির উত্তেজনা দেখে আমরা কিছুক্ষণ থ মেরে ছিলাম । এভাবে আমাদের জনি , দা গড থেকে দা হিরো হয়ে গেলো এতক্ষন বনের মধ্যে কাঠের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম । এবার কিছুটা দূর এগিয়ে একটু ভিতরে ঢুকলাম । আশা একটাই , বনের নির্জনতা ও গহীনতা স্পর্শ করা । যদিও বাঘের ভয় দেখানো হলো সাইনবোর্ড এ ।
তারপরেও সংরক্ষিত এলাকা ছেড়ে কিছুটা দূর যাওয়া হলো , কিন্তু পথ না পেয়ে আবার পিছু ফেরা । নিশ্চিত করেই বলা যায়, করমজল এর সবুজ অরণ্য আর বিচিত্র বৃক্ষরাজি দৃষ্টিসুখকর । কিন্তু আমার আশা ছিল বেশি, তাই মন ভরল না । আসলে বিশাল সুন্দরবনের এই কিয়দাংশ দেখে তো আর পুরো সুন্দরবন দেখার মজা পাওয়া যায় না । আমরা দেড় ঘণ্টা করমজলে কাটালাম ।
ফিরতি পথেও ট্রলারে চললো একই রকম খোশগল্প । মোদ্দাকথা ট্রলার ভ্রমণটা সত্যিকার অর্থেই ছিলো আনন্দদায়ক । গ্যাংনাম স্টাইল এ নাচ থেকে শুরু করে টাইটানিক এর রোমাণ্টিক আবহ তৈরি করা কিছুই বাদ যাইনি । মংলা বন্দরে পৌঁছে আবার বাস এ উঠে বাগেরহাট যাত্রা।
যা শঙ্কা ছিলো তাই হলো ।
দিনের আলোয় ষাট গম্বুজ মসজিদ আর খান জাহান আলীর মাজার দেখা হলো না । বাগেরহাট পৌছতে লেগে গেলো প্রায় সন্ধ্যা । বাগেরহাট শহর থেকে ১০-১২ টাকা রিকশা ভাড়া লাগবে মসজিদ এ পৌছতে । আমাদের আর সে কষ্ট করতে হয়নি । মংলা ছেড়ে আসা বাস মসজিদ এর সামনেই আমাদের নামিয়ে দিলো ।
আধো আলো আধো আধারের দোলাচলে দেখতে থাকলাম ১৫শ শতাব্দী ও তার অধিক প্রাচীন ষাট গম্বুজ মসজিদ । যদিও এর নামকরণে ষাটটি গম্বুজ এর কথা বলা হয়েছে , প্রকৃতপক্ষে এতে ৮১ টি গম্বুজ আছে । মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পে নির্মিত এই মসজিদ বর্তমানে একটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা ভুক্ত অন্যতম ঐতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শন । শত শত বছর আগে নির্মিত এই মসজিদটির নির্মাণ শৈলী সত্যিই অবাক করার মতো । এখনকার যুগের স্থাপত্য নিদর্শনগুলো এর কাছে যেনো কিছুই না ।
ষাট গম্বুজ মসজিদ এর সাথে অবস্থিত খুলনা- বরিশাল সড়কের বিপরীত দিকে অবস্থিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট সিঙ্গাইর মসজিদটিও পঞ্চদশ শতাব্দীর তৈরি । এ জায়গা থেকে খানিক দূরে ভ্যান(জন প্রতি ৫ টাকা) ভাড়া করে এবার আসলাম খান জাহান আলীর মাজার এ । ভ্যান দিয়ে আসার পথটা ছিলো দারুণ উপভোগ্য । খুলনা-বরিশাল সড়কের নির্জনতা , ঘুটঘুটে অন্ধকার ,মাথার উপর আধকাটা চাঁদ আর ক্ষণে ক্ষণেই শ শ শব্দে ছুটে চলা বাস, ট্রাক ! গুনগুন করে হুমায়ূন স্যার এর ''চাঁদনি পশরে কে আমায় স্মরণ করে'' (যদিও চাঁদনি রাত ছিলো না) গান টা গাচ্ছিলাম আসলে এই অদ্ভুত সুন্দর মুহূর্তে কেউ যদি স্মরণ করেও থাকে তো দোষ কি যাই হোক, আমরা মাজার এ পৌঁছলাম । এতক্ষণে পেটে ইদূর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে ।
মাজার এ যাবার পথেই অনেক গুলো খাবার হোটেল । একটা হোটেল এ বসে রাতের খাবার সেরে নিলাম । হোটেল ম্যানেজার এর কথা না বললে বড় ভুল হবে । আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি ,অভুক্ত মন উনার আচরণ ও ব্যবহারে নিমিষেই ধুয়ে মুছে গেলো । কথিত আছে,মধ্যযুগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য তুরস্ক থেকে খান জাহান আলী এই ভূখণ্ডে আসেন।
তার মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা স্মৃতিরক্ষার্থে এই মাজার প্রতিষ্ঠা করেন । মাজার এর পেছনের দীঘি ও দীঘিসংলগ্ন সিঁড়ির জায়গাটি যে খুব যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে তা সহজেই অনুমেয় । যদিও রাতের আঁধারে দীঘিটাই ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না । এই দীঘিতে নাকি বড় বড় কিছু মাদ্রাজি কুমীর আছে এ সম্পর্কে সতর্কতা মূলক সাইনবোর্ডও দেয়া ছিলো । মাজার ও মাজার সংলগ্ন এলাকা ঘুরতে ঘুরতে রাত ৯ টা বেজে গেলো ।
আমাদের কুয়াকাটার বাস আসবে ১০ টায় । এ সময়টা সবাই নিজের মতো কাটাতে লাগলাম । কেউ হেডফোনে গান শুনে, কেউ মোবাইল এ চার্জ দেয়াতে ব্যস্ত ,কেউ ঝিমাতে আর কেউ বা নিজের সাথে কথা বলতে । প্রত্যেকটা মানুষেরই বোধকরি নিজের জন্য এরকম সময় দরকার হয় । সারাদিনের হইহুল্লোড় , ঘুরোঘুরির পর হয়ত আনমনেই এই মন কিছুটা আড়াল চায় ।
নতুন আনন্দের শক্তি সঞ্চয় করে । কারন পরদিনই তো ঝাপিয়ে পড়তে হবে সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।