আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুই যুগ ধরে প্রভাবশালী ও পুলিশের দখলে হলগুলো

প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অন্তত ১০টি হল ভোগদখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ জাল দলিলের বেড়াজালে শিক্ষার্থীদের আবাসনগুলো বেদখল হয়ে আছে বছরের পর বছর। ১৮৮৭ সালে তৎকালীন জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী তার বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯০৭ সালে কলেজে রূপ নেয়। এ সময় জমিদারপুত্র তার স্থাবর একাধিক বাড়ি শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য দান করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর স্থানান্তরিত অনেক প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার তাদের জায়গা-বাড়িঘর লিখিত ও অলিখিতভাবে কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দান করে ভারত চলে যান বলে জানান একাধিক সাবেক শিক্ষার্থী।

দানসূত্রে প্রাপ্ত এসব সম্পদ ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত তৎকালীন কলেজ শিক্ষার্থীরা ভোগদখল করে আসছিলেন। পরবর্তী সময়ে এরশাদ সরকারের শাসনামলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে কলেজ প্রশাসনের দুর্বল কৌশলের কারণে ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যায় শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলো।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, জবি শিক্ষার্থীদের ১০টি হলের মধ্যে তিব্বত হলটি পাটুয়াটুলী ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯ নং জিএল পার্থ লেনে (কুমারটুলী) অবস্থিত। হলটি ৮.৮৯ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত।

বর্তমানে এর কিছু অংশ পুলিশ ও কিছু অংশ ঢাকা-৭ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম ভোগদখল করছেন। ২০০০ সালের পর সেখানে স্ত্রীর নামে গুলশান আরা সিটি শপিং কমপ্লেঙ্ গড়ে তোলেন হাজী সেলিম। এখন তো জায়গাটি তার নিজস্ব বলেই দাবি তার। পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারের ৮২ নম্বর রাধিকামোহন বসাক লেনে ৪.০৯ কাঠা জায়গার ওপর অবস্থিত শহীদ সাহাবউদ্দিন হল। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক এক চিঠিতে এ হলের দখলদার ফারহানা গংয়ের নাম উল্লেখ করেন।

এর আগে ১৮৮৫ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের হামলার ভয়ে হলটি ত্যাগ করে পালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। পরে এর দেখভাল করেন আনসার সদস্যরা। ১৯৯১ সালে আনসারে বিদ্রোহ দেখা দিলে তাদের প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুলিশ সদস্যরা দখল নিয়ে এতে পরিবারসহ বসবাস শুরু করেন। ২০০৯ সালে তা আওয়ামী লীগের নেতা আমিনুল হক বিপ্লব দখল করে সেখানে পাঁচতলা ভবন গড়ে তোলেন।

আরমানিটোলার বটতলায় ৬, ৬/১ এসি রায় রোডে ২৫.৭৭ কাঠা জায়গার ওপর অবস্থিত আবদুর রহমান হল। ১৯৯০ সালের পর থেকে হলটিতে ১৭ পুলিশ সদস্যের পরিবার বসবাস করে আসছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়ার জন্য ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আরমানিটোলা মাহুতটুলীর ১ নং শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডে ৪০ কাঠা জায়গার ওপর অবস্থিত শহীদ আনোয়ার শফিক হল। হলটির দখলদার হিসেবে সমসী ওয়েলফেয়ার সোসাইটিকে চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসক।

হলের কিছু অংশের পুরনো বিল্ডিং ভেঙে গোডাউন বানিয়েছেন স্থানীয় টিন ব্যবসায়ী মোক্তার আলী। আরেক অংশে বসানো হয়েছে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (বাবুবাজার শাখা) ও কিছু ওষুধের দোকান। ১৫, ১৭ ও ২০ নং যদুনাথ বসাক লেনে ২২.৯৭ কাঠা জায়গার ওপর অবস্থিত সাইদুর রহমান ও রউফ মজুমদার হল। এখানে হলের অস্তিত্ব নষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশার গ্যারেজ, দোকানপাট ও ব্যাংকের গোডাউন। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি এ জায়গায় সরকার ও প্রভাবশালী কিছু লোকের মধ্যে বিরোধ-সংক্রান্ত মামলা চলছে বলে ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানায় জেলা প্রশাসক।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম গেটে পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭ নং রমাকান্ত নন্দী লেনে ৫.০৫ কাঠা জায়গার ওপর অবস্থিত শহীদ আজমল হোসেন হল। ১৬ নং অংশটি শহীদ পরিবার পরিচয়ে দখল করে রেখেছে প্রভাবশালী চক্র। ১৭ নম্বরে একটি সমিতি এবং বাকি অংশে পাঁচতলা মার্কেট গড়ে তুলেছে দখলদাররা। বংশালের ২৬ নং মালিটোলায় অবস্থিত বজলুর রহমান হল। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তা ছেড়ে চলে যান শিক্ষার্থীরা।

পরবর্তী সময়ে ভূমিদস্যুরা এর দখল ধরে রাখতে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চবিদ্যালয় নামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। গোপীমোহন বসাক লেনের ৫/১, ২, ৩, ৪ ও ৬ নং টিপু সুলতান রোডে এক বিঘা জায়গার ওপর অবস্থিত শহীদ নজরুল ইসলাম হল। এর কিছু অংশে গড়ে তোলা হয়েছে মাদ্রাসা। আর বাকি অংশ ক্ষমতার দাপটে দখল করে রেখেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী গোলামুন্নবী। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য পাটুয়াটুলীর ২৬ নং হোল্ডিংয়ে ছিল তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ কর্মচারীদের আবাস।

সেখানে সাততলা ক্রাউন মার্কেট গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালী হাজী ওয়ালীউল্লাহর ছেলে মো. ওবায়দুল্লাহ। ৩৫-৩৬ প্যারীদাস রোডে অবস্থিত বাণী ভবন। ভবনটির দুই-তৃতীয়াংশ বেদখল এবং এক অংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অধীনে রয়েছে। বেদখল অংশে সাতটি দোকান, একটি প্রেস ও বাইন্ডিং কারখানা রয়েছে। এর মালিকানা দাবি করছেন জাহানারা বেগম নামে এক মহিলা।

বংশালের মালিটোলার ৩৫, ৩৬ ও ৩৭ নং গোলক পাল লেনে ৯.৩৯ কাঠা জায়গার ওপর অবস্থিত ড. হাবিবুর রহমান হল। দুই যুগ ভোগদখলের পর ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে ২০১১ সালের পর নিয়ন্ত্রণে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাংলাবাজারের ৩/১-ক নং জনসন রোডে ০.৩৪২২ একর জায়গার ওপর গত বছরের ২২ অক্টোবর প্রস্তাবিত ছাত্রীহলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এর চার মাস অতিবাহিত হলেও শুরু হয়নি নির্মাণকাজ। এ জায়গার কিছু অংশ দখল করে ব্যক্তিগত দফতর বসিয়েছেন ৩৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান মিয়াজী।

তিনি বলছেন, এটি মহানগর আওয়ামী লীগ কর্তৃক বরাদ্দ দেওয়া। অন্যদিকে একই ওয়ার্ডের সভাপতি মাহবুবুর রহমান আলীজান অভিযোগ করছেন, এটি তার ব্যক্তিগত অফিস, যেটি সদরঘাটের চাঁদাবাজদের আড্ডাখানা। গত বছর শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনার এক সপ্তাহ পর শিক্ষার্থীদের হল উদ্ধার আন্দোলন শুরু হলে জায়গা কিনে হল নির্মাণের আশ্বাস দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ২১ এপ্রিল জমি কেনার জন্য জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু ভূমি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় পড়ে থমকে যায় সেই প্রক্রিয়া।

এ কারণে প্রতিষ্ঠার নয় বছরেও আবাসন-সুবিধার মুখ দেখতে পাননি জবি শিক্ষার্থীরা। হলগুলো বেদখলের ঘটনা বর্ণনা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ও শিক্ষার্থী আলমগীর শিকদার লোটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা ১৯৮২ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বসবাস করতেন। ১৯৮৩ সালে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বে তিব্বত নিহত হন। তারই নামানুসারের নাম রাখা হয় তিব্বত হল। ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ধসে পড়ার ঘটনার পর ১৯৮৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের পুরাতন হলগুলোকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের সেগুলো ত্যাগের নির্দেশ দেয়।

এরপর শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে দিলে পুলিশ সদস্যরা সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করে দেন। তিনি আরও জানান, ১৯৯০ সালের পর থেকে এই হলগুলো স্থানীয় ছাত্রদলের নেতারা বিভিন্ন সময় জাল দলিল তৈরি করে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করেছেন।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।