mail.aronno@gmail.com
‘র্যামন সামপেদ্রো ক্যামেন’ স্প্যানিশ মৎস্যজীবী ও লেখক, যিনি ২৫ বছর বয়সে মোটর দুর্ঘটনায় টেট্রাপ্লেজিয়া (অংশত বা সম্পূর্ণরুপে পক্ষাঘাতগ্রস্থ) রোগে আক্রান্ত হন, এবং পরবর্তী ২৯ বছর ইউথানেজিয়ার (দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগিদের জন্য যন্ত্রণাহীন মৃত্যু) মাধ্যমে মৃত্যু বরণের জন্য স্পেনের নিম্ন আদালত হতে শুরু করে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অব্দি তার আবেদন গৃহীত হবার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে চান। মূলতঃ ‘মার আদেনত্রো’ অথবা ‘দ্য সী ইনসাইড’ নামের এই সিনেমাটি র্যা মন সামপেদ্রোর জীবনের নির্মম বাস্তবতার উপর নির্মিত এক প্রামাণ্য দলিল। আলেজান্দ্রো আমেনাবারের পরিচালনায় ১২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যর এই সিনেমাটি ২০০৪ সালে মুক্তি পায়, এবং বলা যায় গত এক দশকে এটি স্পেন তথা বিশ্ব সিনেমার উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর একটি। বলতে দ্বিধা নেই, একটি সার্থক চলচ্চিত্রের বিচারে সিনেমাটি সর্বোতভাবেই উতরে গেছে, এবং মানব জীবনের গভীর সংকটময় এক দিককে এমন সুচারু ও দক্ষভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, আমার কাছে তা মনে হয়েছে নতুনতর আর দর্শক হিসেবে মনে জায়গা করে নিয়েছে পোক্তভাবে।
সিনেমাটি সম্ভাব্য সবগুলো দিক থেকেই প্রশংসনীয়।
চিত্রায়ণ থেকে শুরু করে সংগীত, অভিনয়, কাহিনী বিন্যাস, নির্দেশনা, কলা-কুশলী সবকিছুই যেন যথার্থভাবে উপস্থাপিত এখানে, তবে যে বিশেষ দিকটি সিনমাটিকে প্রশংসার দিকে সবসময় একধাপ এগিয়ে রাখবে, তা হলো এর অসাধারণ সংলাপ। কিছু কিছু সিনেমা আছে যেগুলোর সংলাপ এতটাই শক্তিশালী যে, তা কোনো ভাল উপন্যাসকে ছাপিয়ে যেতে ও শিল্প হিসেবে নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট। এই সিনেমাটির সংলাপও ঠিক তেমনই, যা একে ভিন্নমাত্রা দান করেছে, আর পরিচালনার বাইরে কাহিনীকার হিসেবেও বাড়তি প্রশংসা জমা পড়ে যায় আমেনাবারের ঝুলিতে। গভীর জীবন বোধ আর দর্শনে পূর্ণ চরিত্রগুলোর উচ্চারিত একেকটি সংলাপ দর্শককে কোনোভা্বেই ছেড়ে দেয়না জীবনের গভীরতম বোধ হতে সহজে বেরিয়ে আসতে, আর পুরো ১২৫ মিনিট জুড়েই দর্শকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় জীবনের এই প্রখরতম বোধের সামনে সটান দাঁড়িয়ে পড়তে, যেখানে সে র্যামনের জীবনের সাথে অজান্তেই একাত্ব বোধ করে, আবার পরক্ষণেই নতুনতর প্রশ্নের সামনে নিজেকে পায় উত্তরহীন, যা তাকে একই সাথে আশা ও নিরাশার দিকে সমানভাবে ধাবিত করে, অথচ জীবন তখনও তার বিকাশে সমান জাজ্বল্যমান, আর এখানেই সিনেমাটি হয়ে উঠেছে অনবদ্য এক সৃষ্টি হিসেবে।
সত্য ঘটনার উপর নির্মিত এই সিনেমাটি বারবার আপনাকে এমন জীবনের সামনে দাঁড় করাবে, যা কিনা শীঘ্রই শেষ করে দেয়া হবে, যেখানে মৃত্যু একই সাথে গ্রহনীয়, সঠিক, অথচ হত্যা বা অপরাধের অপবাদ থেকে মুক্ত নয়।
তেমনই একটি জীবন ঘিরে অন্যান্য জীবন তথা মানবিক দিকগুলোর সার্বিক বিকাশ এই সিনেমাটির মুখ্য দিক, যেখানে সবগুলো চরিত্রই যেন সমবেতভাবে একটি সার্বিক জীবনের দিকে ইঙ্গিত তৈরী করে, অথচ কেন্দ্রীয় চরিত্রের মৃত্যু তথা আত্মহত্যা যেন তাকে এড়িয়ে গিয়ে এমন এক মানবিক জীবন তৈরী করে, যাকে চিরকাল মানুষ বাঁচিয়ে রেখেছে বা রাখতে চেয়েছে। আহা, মৃত্যু, মানুষ চিরকালই তাকে জয় করতে চেয়েছে ভালবাসা,মায়া, প্রেম ও ক্ষমতার অধিক কোনো অদৃশ্য ক্ষমতা দিয়ে, আর সে সবসময়ই এসেছে নির্মমভাবে, মানুষকে জীবনের দিকে আরেকটু অধিক লোভী করে তুলতে! মূলতঃ, সিনেমাটি জীবনের সমাপ্তির মধ্যে দিয়ে ভীষণভাবে জীবনের দিকেই আমাদের মনোযোগ আকর্ষিত করেছে। যদিও র্যামনের অবস্থান থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রশ্নবিদ্ধ, তারপরও আমরা যদি তার জীবনকে সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যাবে প্রথম যৌবনে নাবিক হিসেবে পৃথিবী চষে বেড়ানো থেকে শুরু করে, পরবর্তী জীবনে দীর্ঘ ৩০ বছর বিছানায় শুয়ে শুয়েও গভীরভাবে সে সমুদ্র-স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থেকেছে, যা তাকে বারবারই টেনে নিয়ে গেছে অতীত জীবনে, কিংবা সে নিজেই পরিভ্রমণ করে বেড়িয়েছে কল্পনায়, ইচ্ছে মতো, আর এসবের মধ্যে দিয়েই জীবন স্বভাবজাত রূপে উঠে এসেছে, প্রবলভাবে।
সিনেমাটি নিয়ে আরও কিছু লিখতে গেলে অবশ্যই জুলিয়া চরিত্রে অভিনয় করা ‘বেলেন রোদা’ এবং রোজা চরিত্রে ‘লোলা দোনাস’-এর কথা বলতে হয়। উভয় নারীই র্যামনের প্রেমে পড়ে, যেখানে জুলিয়া র্যামনের দীর্ঘ সংগ্রামকে আইনী সহায়তা দিতে তার জীবনে আসে আইনজীবী হিসেবে, আর রোজা মানবিক অনুভূতিতে সাড়া দিয়ে তাকে দেখতে এসে প্রেমে পড়ে যায়, যা সিনেমার কাহিনীকে রোমান্টিক টুইস্ট এনে দিয়েছে।
তবে জুলিয়ার চেয়ে আমার কাছে রোজা চরিত্রটিই অধিকতর আকষর্ণীয় হয়ে ধরা দিয়েছে, কেননা একজন সাধারণ রমণী যেভাবে কাঁদে, হাসে বা হতাশা প্রকাশ করে, ঠিক সেভাবেই রোজা চরিত্রটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য জুলিয়া চরিত্রটিও কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, এবং হয়ত সেই একমাত্র মানুষ যে হৃদয়গতভাবে কাছে আসতে পেরেছিল র্যামনের, কারণ সে নিজেও ছিল এমন এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, যা তাকে র্যামনের মতোই ক্রমশঃ করে তুলেছিল অসহায় ও স্বেচ্ছা মৃত্যু গ্রহণে আগ্রহী। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরে থাকা এই দুই নারী চরিত্রকে সবচেয়ে ভালভাবে বলা যেতে পারে এভাবে, একজন স্বপ্নের কাছাকাছি বাস করা কেউ, যার কল্পনায় বিভোর হওয়া যায়, প্রেম বোধে পুনরায় আশ্বান্বিত ও লোভী হওয়া যায়, জীবনের দিকে। অপরদিকে আরেকজন সেই মানুষ যাকে পাশ ফিরলেই কাছে পাওয়া যায়, এবং নিরবছিন্ন ও নির্ভরশীল জীবন অংশ হিসেবে সবসময়ই ধরা দেয়, খুব কাছে।
এভাবে লিখতে গেলে হয়ত পাতার পর পাতা ভরে উঠবে, কেননা এই সিনেমাটি আপনাকে মুগ্ধ করার সবগুলো উপাদান যথার্থভাবে ধারণ করে রেখেছে, আর যখন এটি দেখা শেষ তবে, আপনি তখনও এর মধ্যেই আটকে থাকবেন আরও কিছুক্ষণ, দিন, মাস অথবা বাকী জীবন।
কিছু কিছু জায়গায় পরিচালক বিশেষ কিছু দৃশ্য এমনভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, যা দেখার পর মনে হবে, ‘এমনটি আর কখনও দেখেননি’ কিংবা ‘এই আমার দেখা সেরা চিত্রায়ণ’। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, বিছানায় শায়িত র্যামনের কল্পনায় সমুদ্র পাড়ে চলে যাওয়া, যেখানে জুলিয়া সমুদ্র পাড়ে হাঁটছে আর র্যামন সেখানে পৌঁছে তার পেছনে দাঁড়ায় আর গভীরভাবে তাকে চুমো খায়। কল্পনায় এই ভ্রমণের শুরু থেকে চুমোর দৃশ্যায়ন অব্দি দৃশ্যটি আপনাকে এতটাই বিমুগ্ধ করবে যে, আপনি তা মনে রাখবেন আজীবন। কিংবা সমুদ্র পাড়ে দাঁড়ানো যুবক র্যামন, যে কিনা সমুদ্রের পানিতে লাফ দেয় আর নিচের অগভীর বালুমাটিতে তীব্রভাবে আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায় এবং ডুবন্ত অবস্থায় দু’পাশে হাত ছড়িয়ে জলের মধ্যে ভেসে থাকে। পানির নিচে ভেসে থাকে অজ্ঞান র্যামনের প্রশান্ত, স্থির মুখের নিচ থেকে যে চমৎকার চিত্রায়ণ, যা সিনেমাটি জুড়ে বেশ কয়েকবার দেখানো হয়েছে, তা আপনাকে এমন এক বোধে পূর্ণ করবে যে, আপনি চোখ বন্ধ করলেই র্যামনের মুখের পরিবর্তে নিজের মুখটি দেখতে পাবেন, কিংবা নিজেও চাইবেন লাফ পরবর্তী র্যামনের যে প্রশান্ত সুন্দর অভিজ্ঞতা, তার মধ্যে দিয়ে যেতে।
জাভিয়ার বারদেম, যাকে আমার বর্তমান সময়ের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা বলে মনে হয়, তাকে তাকে প্রথম দেখেছিলাম মার্কেজের লেখা ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিতে, এবং সম্ভবত মার্কেজের ‘ফ্লোরেনতিনো’ চরিত্রটি এত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা বারদেম ছাড়া আর কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এরপর এক এক করে দেখা হলো, ‘গোইয়াস গোস্ট ২০০৬’, ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান ২০০৭’, ‘বিউটিফুল ২০১০’,‘স্কাইফল ২০১২’ আরও অনেক, এবং প্রতিটি সিনেমাতেই এই অভিনেতা আমাকে পূর্বের চেয়ে অধিক বিস্মিত করেছে, আর তাই তাকে স্ক্রিনে দেখা সবসময়ই হয়ে দাঁড়িয়েছে এক নতুন অভিজ্ঞতা, যেন তিনি নিজেই প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসে মগ্ন।
সিনেমাটি দেখার পর থেকেই আমি আটকে আছি র্যামন চরিত্রটির মধ্যে, আর মাঝে মধ্যেই কানের মধ্যে ভেসে আসছে ‘নায়েগ্রা সোমব্রা (ডার্ক শ্যাডো)’ শিরোনামে লুজ ক্যাসলের গাওয়া অনবদ্য সেই গানটি, যা আমাকে নিজের মধ্যেই যেন আরেকটু অধিক ডুবে যেতে সাহায্য করেছে। পরিশেষে সবাইকেই অনুরোধ করব সিনেমাটি দেখতে, কেননা আমার মতে সিনেমাটি বিশেষ প্রতীকিরূপে জীবন তথা মানুষের জন্য সুগভীর এক বার্তা বয়ে এনেছে, যেখানে মানুষ হিসেবে আমরা সবাই কম-বেশি প্যারালাইজড এবং হতাশগ্রস্থও বটে, আর সেই অর্থবতা ও হতাশা কাটিয়ে সম্পূর্ণরূপে জীবনের দিকে দারুণভাবে উজ্জীবিত হবার অনুপ্রেরণা রয়েছে এই সিনেমাটি, যা আপনাকে আরেকবার ভাবতে বাধ্য করবে জীবন নিয়ে ও উজ্জীবিত করবে ছুটে যেতে অভ্যন্তরীণ অর্থবতা তথা হাতাশা থেকে চিরমুক্তির দিকে।
অরণ্য
০৩.০৩.১৪
ঢাকা, বাংলাদেশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।